নতুন সড়ক আইন আজ থেকে কার্যকর হচ্ছে ॥ চালকের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণী, লাইসেন্স না থাকলে ছয় মাসের কারাদন্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা

23

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঢাকঢোল পিটিয়ে আজ থেকে নতুন সড়ক আইন কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রশাসনের ন্যূনতম প্রস্তুতি নেই। তাই এ উদ্যোগ শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়বে। সুষ্ঠু পরিকল্পনাহীন এ ছক বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরিবহন সেক্টরে নতুন করে নানামুখী বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এমনিতেই দেশের পরিবহণ মালিক-চালকরা স্বাভাবিকভাবে কোনো আইন মেনে চলতে ততটা আগ্রহী নন। এর ওপর সড়ক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে পুরোপুরি প্রস্তুত না করে তা কার্যকরে উদ্যোগ নেওয়া হলে তা নিঃসন্দেহে হিতে বিপরীত হবে। কেননা যথাযথ সরঞ্জাম ও লজিস্টিক সাপোর্ট না নিয়ে আইন প্রয়োগে মাঠে নামলে তাতে পদে পদে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ সুযোগে পরিবহণ মালিক-চালকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবেন বলে মনে করেন তারা।
অন্যদিকে নতুন সড়ক আইন কঠোরভাবে পালন করা হলে বরাবরের মতো এবারও গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে; প্রয়োজনে রাস্তায় বাস-মিনিবাস ও লেগুনাসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল কমিয়ে দিয়ে গণপরিবহন সংকট সৃষ্টি করে যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলবে- এমন আশঙ্কাও করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, এ ইস্যুতে অচলাবস্থা তৈরি করা হলে সে সংকট মোকাবিলা করার সামর্থ্য যে সরকারের নেই, তা গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আগেভাগেই জেনে গেছেন। তাই বরাবরের মতো এবারও তাদের এ ইস্যুতে সোচ্চার হওয়ার শঙ্কা রয়েছে- যোগ করেন তারা।
এদিকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগ নতুন সড়ক আইন কার্যকরে আজ থেকে মাঠে নামার উদ্যোগ নিলেও এ ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি না থাকার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সারা দেশে ১৭ লাখের বেশি অবৈধ চালক রয়েছেন। নতুন আইনে বলা আছে, কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হবে।
চালকের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস। লাইসেন্স না থাকলে চালকের ছয় মাসের কারাদন্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। দুই যানবাহনের পাল্লাপাল্লিতে দুর্ঘটনা ঘটলে চালকের তিন বছরের কারাদন্ড অথবা জরিমানা হবে ২৫ লাখ টাকা।
অথচ পেশাদার চালকদের এক-চতুর্থাংশেরও কম অষ্টম শ্রেণি পাস। ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ চালক প্রাথমিকের গন্ডিও পার হননি। এ অবস্থায় নতুন সড়ক আইন কার্যকর করতে গেলে দক্ষ চালকদের একটি বড় অংশ স্বাভাবিকভাবেই বাদ পড়বে। এ অবস্থায় অনেকে শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ জোগাড় করে নতুন করে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার চেষ্টা করবে। এতে মূল লক্ষ্য ভেস্তে গেলেও বিআরটিএর একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা নিজের পকেট ভারী করার সুযোগ পাবেন।
সরকার দক্ষ চালক তৈরির তেমন কোনো ব্যবস্থা না করেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে যে নতুন সড়ক আইন কার্যকর করতে যাচ্ছে তা পরিবহণ খাতে ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়াবে। জেল-জরিমানার ভয়ে লাইসেন্সধারী পেশাদার নিরক্ষর চালক এ পেশা থেকে সরে যাবে। ফলে স্বল্পসংখ্যক চালককে বিরতিহীনভাবে দিনের পর দিন গণপরিবহণ চালাতে হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা আরও বাড়বে। এছাড়া বিগত সময়ে অষ্টম শ্রেণিতে বোর্ড পরীক্ষা না থাকায় সহজেই এর ভুয়া সনদ মিলবে। যা যাচাই করে জাল প্রমাণ করা যথেষ্ট কঠিন হবে।
এদিকে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বন্ধে পরিবহন নতুন আইনে চালকের জন্য রাখা হয়েছে ১২ পয়েন্ট, যা প্রতিটি অপরাধের পর কাটা যাবে। ৬ পয়েন্ট কাটা গেলে এক বছরের জন্য চালকের লাইসেন্স স্থগিত এবং সব পয়েন্ট কাটা গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। অথচ বর্তমান নিরীক্ষে তা কতটা যাচাই করা সম্ভব সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কেননা দেশের সিংহভাগ সড়ক-মহাসড়কেই গতি পরিমাপ যন্ত্র নেই। দেশের ৩ হাজার ৮৪৬ কিলোমিটার মহাসড়কের জন্য হাইওয়ে পুলিশের কাছে আছে মাত্র ১০৫টি স্পিড ডিটেক্টর। যার একটি বড় অংশই নষ্ট। এছাড়া যানজট এড়াতেও অনেক সময় স্পিড ডিটেক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে না। এ বাস্তবতায় গাড়ির বেপরোয়া গতি নির্ধারণ করে অভিযুক্ত চালকের পয়েন্ট কাটা কতটা সম্ভব হবে সে প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিবহণ-সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর সাজা নির্ধারণ নিঃসন্দেহে প্রয়োজন রয়েছে। তবে তার আগে যানবাহনের গতি পরিমাপের ব্যবস্থা করা জরুরি। তা না হলে এ আইন শুধু খাতা-কলমেই রয়ে যাবে। পাশাপাশি এর আইনের অপব্যবহারের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এদিকে নতুন সড়ক আইনে দুটি গাড়ি পাল্লা দিয়ে (রেসিং) চালানোর সময় যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদন্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালক মুঠোফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। গণপরিবহনে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য সংরক্ষিত আসনে অন্যরা বসলেও একই শাস্তি রাখা হয়েছে। অথচ এসব বাস্তবায়ন করতে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা ট্রাফিক পুলিশ কতটা কাজ করতে পারবে তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েই গেছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আইনের এসব বিধান আগেও ছিল। এবার এর কিছু হেরফের করা হয়েছে। কিন্তু আগেও এসব আইনের যেমন প্রয়োগ হয়নি, এখনো তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি পরিসংখ্যানেই দেশে লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা দুই লাখের বেশি। অথচ মাসের পর মাস অভিযান চালিয়ে বিআরটিএ কিংবা ট্রাফিক পুলিশ কখনো এক হাজার গাড়ি জব্দ করতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের আটঘাট না বেঁধে লোক দেখানো আইন করে লাভ নেই বলে মন্তব্য করেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির ওই নেতা।
পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালক যেমন সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তেমনি ফিটনেসবিহীন যানবাহনও যাত্রী সাধারণ ও পথচারীর লাশের স্তুপ গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। তাই পুরানো আইনের সামান্য হেরফের করে ঢাকঢোল না পিটিয়ে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলে সহায়তাকারীদের আগে সাজার আওতায় আনা জরুরি। পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন যানবাহন মালিকদের সাজার আওতায় আনতে হবে বলে মনে করেন পরিবহণ পর্যবেক্ষকরা।
এদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশে অন্তত ১৩ লাখ নছিমন-করিমন-ভটভটি, ইজিবাইক চলাচল করছে। নছিমন-করিমন চলছে অন্তত তিন লাখ ৭০ হাজার। অন্তত ১০ লাখ ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক আমদানি করার তথ্য খোদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েই রয়েছে। এছাড়া সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের হিসাবে, গাড়ির শ্রেণি পরিবর্তন করে অন্তত দুই লাখ হিউম্যান হলার লেগুনা তৈরি করা হয়েছে। এসব যানবাহনের যেমন লাইসেন্স নেই, তেমনি চালকেরও লাইসেন্স নেই। অথচ এসব যানবাহনই মহাসড়কে ছোটবড় নানা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতাদের অভিযোগ, এসব লাইসেন্সবিহীন যানবাহন কারা আমদানি করেছে; কারা প্রভাব খাটিয়ে তা রাস্তায় নামিয়েছে- এর সবই সরকারের জানা। অথচ সেদিকে নজর না দিয়ে নতুন সড়ক আইন কার্যকরের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা গণপরিবহণের শ্রমিক নৈরাজ্য উসকে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না বলে মন্তব্য করেন নেতারা।