জীবিত মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য

45

মুফতি মুহাম্মাদ আকতার আল-হুসাইন

মা -বাবা ছোট দুটি শব্দ, দুটি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা যা দুনিয়ার কোন মাপযন্ত্র দ্বারা পরিমাপ করার কারো সাধ্য নাই। মা-বাবা সন্তানদের জন্য কত কষ্ট করেছেন তার হিসেব বুঝতে পারেন যাদের মা-বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। মা-বাবা সন্তানদের জন্য বড় নিয়ামত। সৃষ্টিকর্তা মানব জাতিকে মা-বাবার মাধ্যমেই ধরনীর আলো বাতাস দেখিয়েছেন। পৃথিবীর মাঝে মা-বাবাই সন্তানের আপনজন। সন্তানের জন্য মা-বাবার মতো আপন পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ নেই। সন্তান জন্ম নেয়ার পর মা-বাবা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। সৃষ্টিকর্তা মা-বাবার খেদমত করার জন্য সর্বাধিক তাগিদ দিয়েছেন। মহান প্রভু তাঁর ইবাদতের পর মা-বাবার খেদমত করার নির্দেশ দিয়েছেন। মুসলিম জাতির উপর সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করা ফরজ ঠিক মা-বাবার খেদমত করা প্রত্যেক মানুষের উপরও ফরজ। সর্বাস্থায় আল্লাহর সকল হুকুম পালনে বাধ্য থাকতে হবে, তেমনি জীবনের প্রতিক্ষেত্রে মা-বাবার অনুগত থেকে তাঁদের খেদমত করতে হবে।
সূরা লোকমানের ১৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- আমি মানুষকে তার মা-বাবার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই। সুরা নবী ইসরাঈলের ২৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- তোমাদের প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত তোমরা অন্য কারো ইবাদত করোনা, এবং মা-বাবার প্রতি সর্বদা সদ্ব্যবহার কর। তাদের একজন বা উভয়েই তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধ্যকে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ শব্দ বলোনা (বিরক্তি, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, ক্রোধ ও ঘৃণাসূচক কোনো কথা) এবং তাদেরকে ধমক দিওনা, তাদের সাথে সম্মান সূচক নম্র কথা বল। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল “হে আমার রব ! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। তোমাদের অন্তরে যা আছে তা তোমাদের প্রতিপালক ভালো করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তবে তিনি তওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল”। অন্যত্রে সূরা নিসার ৩৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম-অনাথ, অভাবগ্রস্ত, নিকটাত্মীয়, দূর, প্রতিবেশী, সঙ্গি-সাথী পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে”। মানুষের সম্পদ সৃষ্টিকর্তার জন্য ব্যয় যেমনি করতে হবে ঠিক সন্তানরাও মা-বাবার খেদমতের জন্য ব্যয় করতে হবে। মা-বাবা সন্তানের অতি আপনজন। তাঁদের সর্বাবস্থায় সন্তুষ্ট রাখতে হবে, সম্মানপ্রদর্শন করতে হবে, সেবা করতে হবে। বর্তমান সমাজে অশিক্ষিত লোকেরা মা-বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করছেই; আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের অবস্থা করুণ ও ভয়াবহ। অশিক্ষিত লোকদের চেয়ে শিক্ষিতরা আধুনিকতার দম্ভে মা-বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করছেন। শিক্ষিত ছেলেরা যদি শিক্ষিত স্ত্রী পেয়ে যান তাহলে মা-বাবার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ বয়োবৃদ্ধ মা-বাবার সেবায় এগিয়ে এলে তাদের বর্তমান আধুনিক স্টাইল নষ্ট হয়ে যাবে। বিধায় মা-বাবার খেদমতের ধারে কাছে আসতে রাজি হননা- বরং দূরে দূরে থাকতে চান।
শিক্ষিত-অশিক্ষিত ছেলেরা তাদের স্ত্রীর কুপরামর্শে মা-বাবার স্বগীয় সাহচর্য চিন্ন করতে বাধ্য হন। যা অনেক হৃদয় বিদারক ও মর্মস্পর্শী। বর্তমান সমাজে এটার অন্যতম কারণ ইসলামি সুশিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। শিক্ষিত লোক মা-বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করবে কেন ? স্ত্রীর সুপরামর্শ সায় না দিয়ে কুপরামর্শে সায় দেবে কেন ? শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা মা-বাবার অবাধ্য হলে জাতি নৈতিকতা শিখবে কোথায় ? সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চয় মা-বাবার বাধ্য থাকতে হবে এবং তাঁদের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে মা-বাবার দায়িত্ব ও গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিসে বর্ণিত- আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোক রাসূল (সা:)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল، হে আল্লাহ্র রাসূল (সা:)! আমার নিকটকে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? রাসূল (সা:) বললেন- তোমার মা। লোকটি বললো অত:পর কে? রাসূল (সা:) বললেন- তোমার মা। সে বললো অত:পর কে? রাসূল (সা:) বললেন- তোমার মা। সে বললো অত:পর কে? রাসূল (সা:) বললেন- অত:পর তোমার বাবা (বুখারী শরীফ )। যখন কোন সন্তান তার আপন মা-বাবার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকায়, তখন সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে তার আমলনামায় একটি ‘মকবুল হজ্ব’ এর ছওয়াব লিপিবদ্ধ করে দিবেন। সাহাবায়ে কেরামগণ আরজ করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা:)! যদি কোন ব্যক্তি দৈনিক একশত বার এরূপ থাকায় তবুও কি সে এই ছওয়াব পাবে ? তিনি জবাবে বললেন ‘হ্যাঁ’। আল্লাহ অতি মহান, অতি পবিত্র। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, তার নাসিকা ধূলিসাৎ হোক, তার নাসিকা ধূলিসাৎ হোক , তার নাসিকা ধূলিসাৎ হোক- একথা রাসূল (সা:) তিন বার বললেন। জিজ্ঞেস করা হল- ইয়া রাসূলুল্লাহ ! কে সে ? যার নাসিকা ধূলিসাৎ হোক । তিনি বললেন – যে ব্যক্তি তার মা-বাবার একজনকে অথবা উভয়জনকে তাদের বার্ধক্য অবস্থায় পেল অথচ (তাদের খেদমত করে ) সে বেহেশতে প্রবেশ করলো না (মুসলিম )। অন্যত্রে হযরত আবু হুরাইরাহ (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন- যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহ তায়ালার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না (আবু দাউদ)। যে তার মায়ের চক্ষুদ্বয়ের মধ্যভাগে চুমা দিবে সে দোযখ থেকে মুক্তি পাবে। অনত্রে বর্ণিত- যে ব্যক্তি তার মায়ের পা চুম্বন করলো (কদমবুছি করলো) সে যেন বেহেশতের চৌকাঠে চুম্বন করলো।
যারা মা-বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার, তাঁদের অবাধ্যতা, কষ্ট দেয়া, এবং তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করে তাদের উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:) এবং ফেরেস্তার অভিসম্পাত করেন। এরূপ কাজে সৃষ্টিকর্তা কখন ক্ষমা করবেন না। মা-বাবার অবাধ্য ছেলে ও মেয়ে যত বেশি ইবাদত করুক না কেন সে কখনো সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ করবে না। সারাজীবন মা-বাবার খেদমত করি না কেন তবুও তাঁদের ঋণ শোধ করা যাবে না। মা-বাবার খেদমত ও তাদের দোয়া নেয়া একান্ত জরুরী। তিন ব্যক্তির দোয়া সাথে সাথে কবুল হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নাই- মা-বাবার দোয়া, মুসাফিরের দোয়া ও মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবিত মা-বাবার নেক হায়াত দান করুন। তাদের খেদমত করার তৌফিক দান করুন এবং যারা কবরে চলে গেছেন তাদের কবর গুলোকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন। আমিন।

লেখক: ইমাম ও খতিব, ওল্ডহাম জামে-মসজিদ, যুক্তরাজ্য।