বাবা-মা হত্যায় পুলিশ কন্যা ঐশীর ডাবল ফাঁসি

57

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যা মামলার প্রধান UYTREWআসামি তাদের মেয়ে ঐশী রহমানকে “ডাবল” ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত।
ডাবল মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি আদালত ঐশীকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেন। রায় ঘোষণার সময় ঐশী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক সাঈদ আহমেদ এ রায় ঘোষণা করেন। তিনি ডাবল মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আদেশের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তার পরযবেক্ষণে।
রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করলেও আসামিপক্ষ রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী জানান, হত্যাকাণ্ডের সময় ঐশীর বয়স ছিল ১৭ বছর। দেশের সংবিধান অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের কাউকে শিশু হিসেবে ধরা হয়। সে হিসাবে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ঠিক হয়নি। তা ছাড়া হত্যাকাণ্ডের সময় সে মাদকাসক্ত ছিল। উত্তেজনাবশত সে হয়তো এমন কাজ করেছে। এ জন্য তার সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া ঠিক হয়নি।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রভাবে রায় এমন হয়েছে দাবি করে ঐশীর আইনজীবীরা জানান, তারা  এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, হত্যাকাণ্ডের সময় ঐশীর বয়স যে ১৭ বছর ছিল তা প্রমাণ করতে পারেনি আসামিপক্ষ। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ ও মেডিকেল প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে হত্যাকাণ্ডের সময় ঐশী সাবালিকা ছিলেন। তা ছাড়া হত্যাকাণ্ডের সময় ঐশী হুইস্কি খেয়েছিল বলে আসামিপক্ষ যে দাবি করেছিল, তারা তা প্রমাণ করতে পারেনি।
রায়ের পর্যালোচনায় বিচারক ঐশীকে সর্বোচ্চ শাস্তি ও দ্বৈত মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যাখ্যায় জানান, পরিকল্পনা করেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তবে একটি হত্যাকাণ্ডের পর নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে পরে আরো একটি হত্যাকাণ্ড ঘটায় ঐশী।
বিচারক জানান, বাবাকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল না ঐশীর। তার উদ্দেশ্য ছিল মাকে হত্যা করার। সে হিসাবে সে তার মাকে হত্যা করে। মাকে হত্যার পর সে ভাবে, ‘বাবাকে হত্যা না করলে আমি বাঁচতে পারব না’। সেজন্য সে বাবাকেও হত্যা করে।
বিচারক বলেন, যেহেতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত, সে জন্য তার সর্বোচ্চ শাস্তিই পাওয়া উচিত।
বিচারক আরও বলেন, “একজন শিশুর বিরুদ্ধে এমন রায় দেওয়ায় আপনারা হয়তো বা সমালোচনা করবেন। আমি ভেবে দেখেছি বয়স যা-ই হোক তার সর্বোচ্চ শাস্তিই পাওয়া উচিত।”
এই মামলায় চার আসামির মধ্যে ঐশীর দুই বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং আসাদুজ্জামান জনিকে খালাস দেন আদালত। এদের মধ্যে জনি শুরু থেকেই কারাগারে আছেন। আর রনি আছেন জামিনে।
অন্য আসামি ঐশীদের বাসার শিশু গৃহকর্মী খাদিজা আক্তার সুমি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার বিচার চলছে শিশু আদালতে। গত বছরের ২০ মে সুমির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তাকে জামিন দেন শিশু আদালতের বিচারক জাকিয়া পারভিন। গত বছরের ১ জুন গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্র থেকে মা সালমা বেগমের জিম্মায় জামিনে মুক্তি পেয়েছে সে।
২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর চামেলীবাগে নিজেদের বাসা থেকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন ঐশী। তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে পরে গ্রেপ্তার করা হয় ঐশীর বন্ধু রনি ও জনিকে।
পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী বলেছিল, রাতে বাবা-মায়ের কফিতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিল সে। পরে তারা অচেতন হয়ে পড়লে রনি ও জনিকে নিয়ে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন তাদের। এরপর লাশ দুটি টেনে বাথরুমে নিয়ে রাখা হয়। এ সময় সুমির সহযোগিতা নেয় তারা। সকালে ছোট ভাই ওহী রহমান ও সুমিকে নিয়ে বাসা থেকে পালান ঐশী। পরদিন সকালে পত্রিকায় বাবা-মার লাশ উদ্ধারের খবর পড়ে রমনা থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
হত্যাকাণ্ডের পরদিন মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল থানায় হত্যা মামলা  করেন, যদিও তিনি মনে করেন ঐশী তার বাবা-মাকে খুনে করেনি।
২০১৪ সালের ৯ মার্চ গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আবুল খায়ের মাতুব্বর আদালতে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তাতে বলা হয়, ঐশীই তার বাবা-মাকে হত্যা করেন; আর বন্ধু রনি ও জনি আর গৃহকর্মী সুমি সহযোগিতা করে তাকে।
ঐশী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও পরে তা অস্বীকার করে বলেন, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল।
অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী ঐশীসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গত বছরের ৬ মে এ মামলায় অভিযোগ গঠন করেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। পরে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলে গত বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকার তিন নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ বি এম সাজেদুর রহমান আবার অভিযোগ গঠন করেন এবং ঐশীদের বিচার শুরু করেন। বাদীপক্ষে ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ঐশীর চাচাসহ ৩৯ জনের জবানবন্দি নেন আদালত।
রাষ্ট্রপক্ষে  বিশেষ প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান এবং আসামিপক্ষে  ফারুক আহমেদ ও মাহবুবুর রহমান রানা গত ২০ অক্টোবর ও ৪ নভেম্বর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
১৩ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি ঐশীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেন আদালত। সে সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন ঐশী। অপর দুই আসামি জনি ও রনিও নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান।