চলে গেলেন ত্যাগী রাজনীতিবিদ

7

চলে গেলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। কুঁড়েঘরের মোজাফফর নামেই সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন তাঁর। বয়সের বিবেচনায় ৯৭ বছরে মৃত্যুবরণ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য তাঁর এই চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি। মেধাবী এই মানুষটিকে আরো কিছুদিন প্রয়োজন ছিল।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আজীবন সাম্যবাদী আদর্শের পতাকা বহন করেছেন। আদর্শ থেকে কোনো দিন বিচ্যুত হননি তিনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোজাফফর আহমদ এই আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে চাকরি ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। ওই বছর সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে জয়ী হন। তিনিই প্রথম ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব তোলেন। এরপর ছয় দফাসহ প্রতিটি আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে ১৯৫৮ সালের দিকে। তাঁকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কারপ্রাপ্তির ঘোষণা পর্যন্ত করা হয়। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংগঠিত করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কারাবরণও করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান ভারতের আগরতলায়। তাজউদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করা হলে তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকেও সদস্য করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ওই সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধা গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি ন্যাপ, সিপিবি ও প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে ত্রিদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে অধ্যাপক আহমদ কারারুদ্ধ হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকার করা মোজাফফর আহমদ ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারও নেননি। কোনো মোহই তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি।
প্রবীণ এই রাজনীতিকের মৃত্যুতে দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা কোনো দিন পূরণ হওয়ার নয়। আমরা তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানাই সমবেদনা।