তিন হাজার অনুপ্রবেশকারীকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে

22

কাজিরবাজার ডেস্ক :
গত এক দশকে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দলের আদর্শবিরোধী হাজার হাজার লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দলকে সুসংগঠিত, আগাছা ও হাইব্রিডমুক্ত করতে সারাদেশে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা প্রস্তুত করেছে দলটি। গোপন অনুসন্ধানে সারাদেশে এমন প্রায় ৩ হাজার ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই এসব অনুপ্রবেশকারীকে দল থেকে বহিষ্কার এবং আগামীতে দলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত নির্বাচনের পর টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই দলে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নিজের ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে গত দশ বছরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিতর্কিত কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা শুরু করে দলটি। এটি শুধুমাত্র রাজধানীতেই নয় সারাদেশেই এই শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে দলকে পূর্বের ন্যায় পরগাছামুক্ত সুসংগঠিত দল হিসেবে গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়ে একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন তিনি। অনুসন্ধান অব্যাহত থাকায়, আগামীতে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সূত্রগুলো আভাস দিয়েছেন। দীর্ঘসময়ে ক্ষমতায় থাকার কারণে সারাদেশেই দলে যে ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তা বারবার বলা হলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। বিগত সময়ে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বারবার তাগাদা দিয়েও কাজ হয়নি। জানা গেছে, পরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং নিজস্ব একাধিক টিমের তত্ত্বাবধানে দলে অনুপ্রবেশকারীদের নাম-ঠিকানা, আগের কোন রাজনৈতিক দল করতেন সবকিছুর তথ্য সম্বলিত একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। ৫শ’ করে এক হাজার পৃষ্ঠার দুটি তালিকার মধ্যে একটি অনুপ্রবেশকারী এবং অপরটি বিতর্কিতদের নামের তালিকা দেয়া হয়েছে। তালিকায় অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতদের মোবাইল নম্বর পর্যন্ত দেয়া হয়েছে।
তবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুক্রবার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলে অনুপ্রবেশকারীদের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। তাতে দেড় হাজার জনের নাম রয়েছে। আগামী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এসব অনুপ্রবেশকারী তথা বিতর্কিত ও অপকর্মকারী লোকজন যাতে আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের নেতৃত্বে না আসতে পারে সেজন্য তালিকাটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অনুপ্রবেশকারীদের পরিচয় তুলে ধরে তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তি থেকে যারা আসে, যারা চিহ্নিত চাঁদাবাজ, চিহ্নিত মাদককারবারি, চিহ্নিত ভুমি দস্যু, যাদের খারাপ ইমেজ, যাদের রাজনীতি জনগণের কাছে খারাপ- এরাই অনুপ্রবেশকারী।
দলের সাধারণ সম্পাদক দেড় হাজার অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বললেও অন্য একটি সূত্রের মতে, অনুসন্ধানে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তিকে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার দুটি বইয়ে এসব বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা উঠে এসেছে। শুক্রবার রাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের আট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের হাতে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকার কপি হস্তান্তর করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী সারাদেশে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে এসব অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে বহিষ্কার এবং পুনরায় যাতে মূল দল ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোন পদে আসতে না পারে সেজন্য সারাদেশের জেলা-মহানগর ও উপজেলা নেতাদের সতর্ক করে দেবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
দলের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এর আগে বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের কাছে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকাটি দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দলে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের এই তালিকা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালানোর নির্দেশ দেন।
সূত্রগুলো জানায়, টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতয় এসে দলকে সুসংগঠিত ও হাইব্রিডমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন স্বয়ং দলের প্রধান শেখ হাসিনা। সে লক্ষ্য নিয়েই তিনি দলের ভেতরে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। সম্প্রতি গণভবনে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছয় নেতাকে ডেকে এ নিয়ে গণভবনে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দেন, এসব অনুপ্রবেশকারীদের এখনই দলের সকল পদ-পদবি থেকে বাদ দিতে। একইসঙ্গে আগামীতে যেন আর কোন অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকারও নির্দেশ দেন তিনি।
দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় ৭-৮ মাস ধরে গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব টিম সারাদেশে অনুসন্ধান চালিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের এই তালিকা তৈরি করে। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর বৈঠকেও এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিভাগীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের হাতে প্রস্তুতকৃত তালিকা হস্তান্তর করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা জেলায় জেলায় তালিকা পাঠাচ্ছি। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের একটি তালিকা নেত্রী (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে তৈরি করেছেন। সে তালিকা প্রধানমন্ত্রী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। বিতর্কিত কেউ যাতে বিভিন্ন পর্যায়ের সম্মেলনে কমিটিতে স্থান করে নিতে না পারে, সেজন্য আমরা সতর্ক রয়েছি। কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতাদের সেভাবেই দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালের পর ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু হয় আওয়াম লীগে অনুপ্রবেশ। এর ধারবাহিকতায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের যেন রীতিমতো হিড়িক পরে। এসব অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির লোকজন। ভোলপাল্টিয়ে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে নানা অপকর্ম করে ক্ষমতাসীন দলটিকে নানা সময়েই জনগণের সামনে হেয় করার চেষ্টা করে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বেশিরভাগ জায়গাতেই আওয়ামী লীগের কিছু কেন্দ্রীয় নেতা এবং দেশের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপি এবং বড় নেতাদের হাত ধরেই এই অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
সারাদেশে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রস্তুতকৃত তালিকা অনুযায়ী, গত দশ বছরে মূল আওয়ামী লীগ ছাড়াও সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটেছে আওয়ামী লীগ যুবলীগে। এর পরেই রয়েছে ছাত্রলীগ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ছাত্রদল-যুবলীগের ক্যাডার হিসেবে নানা বিতর্কিত ও আওয়ামী লীগকে নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতরাও রাতারাতি ভোলপাল্টিয়ে যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগে ঢুকে আগের মতোই বিতর্কিত কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে প্রস্তুতকৃত তালিকায় অনুপ্রবেশকারীদের নাম, ঠিকানা, বর্তমান পদবি ও আওয়ামী লীগে যোগদান করার আগে কে কি করতেন সেটাও উল্লেখ রয়েছে। পাশাপাশি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারাই দলের বিভিন্ন পদ-পদবিতে রয়েছেন তাদেরকে অব্যাহতির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা তৃতীয় মেয়াদে অর্থাৎ গত ১০ বছরে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা অনুযায়ী, রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় এ সময়ে ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশ করেছে ৩৮৯ জন। এসব অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী রয়েছে। এর মধ্যে রংপুর জেলায় অনুপ্রবেশকারী রয়েছে ২২ জন, দিনাজপুরে ১১৫ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৩০ জন, নীলফামারীতে ১৩ এবং লালমনিরহাটে ১০৯ জন।