ফিক্হশাস্ত্র গবেষণায় পাশ্চাত্যবিদদের দৃষ্টিকোণ

256

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
বি শ্লেষকদের মতে ‘ইসলামী ফিকহ বা আইন দীনের গন্ডির বাইরের একটি বিষয়’- শাখতের এমন মতবাদটাই হচ্ছে দৃশ্যত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ। যদিও তারা তা প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের মতে হচ্ছে, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে ধর্ম থেকে দূরে থেকে। আর এভাবেই আধুনিক শিক্ষিত মুসলিম যুবসমাজের মাঝে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ শিকড় গেড়ে বসে। বিশেষ করে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যবিদ শাখ্ত ও তার অনুসারী অন্যান্য প্রাচ্যবিদের বই-পুস্তক পড়ানো হয় সেসব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মুসলিম সন্তানদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে ড. আব্দুল কাহহার দাউদের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শাখতের মতবাদই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ। যদিও তা খুলে বলা হয় না। সেই মতবাদের মূল কথা হচ্ছে, ধর্ম থেকে দূরে থেকেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক তথা সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী আলী আব্দুর রাজ্জাককে এই (মতবাদের) পতাকা বহন করতে দেখেছি। পরবর্তীতে লক্ষ্য করেছি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের দোসরদের অনেকেই তার সেই মত ও রায়কে নির্ভরযোগ্যতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। “প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫২”।
মুসলিম দেশসমূহে পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের যাত্রা শুরু হবার পর থেকেই ধর্মনিরপেক্ষ আইনের প্রভাব ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই রূঢ় বাস্তবতার দিকেই ইঙ্গিত করে প্রফেসর মুহাম্মদ হামীদুল্লাহ বলেছেন, ডরঃয ঃযব ধফাবহঃ ড়ভ ডবংঃবৎহ পড়ষড়হরধষরংস রহ গঁংষরসং ষধহফং, ওংষধসরপ ষধি ধিং ড়াবৎংযধফড়বিফ নু ংবপঁষধৎ ষধ.ি “ঋধরুধষ অযসধফ গধহলড়ড়, অহ ঙৎরবহঃধষরংঃ চবৎংঢ়বপঃরাব ড়ভ ওংষধসরপ খধ:ি ঋৎড়স ঋড়ংংরষরুধঃরড়হ ঃড় খবমধষ ঞৎধহংঢ়ষধহঃ, ঞযব গঁংষরস ডড়ৎষফ ইড়ড়শ জবারব,ি টক: ঞযব ওংষধসরপ ঋড়ঁহফধঃরড়হ, ৩১:৪, ২০১১, ঢ়.৬”
এভাবেই আধুনিক মুসলিম প্রজন্মকে দীন থেকে দূরে রাখতে এবং ইসলামী আইন ও শরীয়া সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে তুলতে পরিকল্পিতভাবে চালানো হয় এক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। ক্রুসেড যুদ্ধের পর থেকে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে পরিচালিত ইউরোপিয়ানদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকে। বিগত দুই শতাব্দী ধরে তাদের এ আন্দোলন আরো বেগবান হয়। আন্দোলনের ফসল ঐসব প্রাচ্যবিদদের পিছনে ব্যয় করা হয় অঢেল সম্পদ। ফলে তাদের লেখালেখি ও গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত এই দেড়’শ বছরে প্রাচ্যবিদগণ তাদের এ অশুভ লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রাচ্য তথা ইসলাম, ইসলামী শরীয়ত, মুসলমান ও মুসলিম দেশ সম্পর্কে ষাট হাজার বই-পুস্তক রচনা করেছেন। “প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৬; ড. আকরাম জিয়া আল-ওমারী, মাওকিফুল মুস্তাশরিক্বীন মিনাস সীরাতি ওয়াস সুন্নাহ, দারুল ইশবিলিয়্যাহ, পৃ. ৬-৭”। এর মধ্যে কিছু কিছু বই মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত সমাদৃত। ওসব গ্রন্থে উল্লেখিত প্রাচ্যবিদদের বিভিন্ন মতামতকে আধুনিক শিক্ষিত সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে থাকেন। যা অনেক সময় মুসলমানদের নতুন প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর ও ক্ষতিকর বিষয়ে পরিণত হয়। বিশেষ করে মুসলিম জীবনপ্রণালী, আইন ও বিচার, ফিক্হ, শরীয়তসহ ইসলামের সরাসরি বিষয়ে লিখিত কতিপয় প্রাচ্যবিদদের বই। প্রাঞ্জল আরবী বা ইংরেজি ভাষায় রচিত তাদের কোনো কোনো বইয়ের দোষ-ত্র“টিগুলো মুসলিম বিশেষজ্ঞ স্কলার্স ছাড়া সাধারণ পাঠক বা ছাত্র সমাজ কখনোই ধরতে পারবে না। অথচ ঐসব আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমান যুবসমাজ এক সময় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন, অনেক সময় ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয় পদে আরোহণ করেন। তখন মুসলমানের সন্তান হয়েও সেসব ক্ষমতাবানদের কার্যক্রমে দেখা যায়, ইসলামের প্রতি তাদের কোনো দরদ নেই, ঈমান ও শরীয়া বিরোধী এবং মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ নিতে তাদের বুক কাঁপে না। মুসলিম হয়েও ইসলামী আইন মানেন না। ইসলামী আইন সেকেলে, এসব আইন ও বিচার বর্তমানে অচল, শরীয়া আইন মধ্যযুগীয় বর্বর আইন.. (নাউজুবিল্লাহ) ইত্যাদি যেসব উক্তি বর্তমান মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে বিভিন্ন নেতা ও কর্তাব্যক্তিদের মুখে শোনা যায়, তা সেই প্রাচ্যবিদদেরই ভয়াবহ প্রভাব এবং বিদ্বিষ্ট প্রাচ্যবিদদের লেখা বিভ্রান্তিকর বই-পুস্তকের আলোয় গড়ে উঠার ভয়ানক পরিণতি।
রচনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাচ্যবিদদের কৌশল সম্পর্কে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, অনেক প্রাচ্যবিদ তাদের লেখায় নির্দিষ্ট পরিমাণে বিষ মিশিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা খুব সতর্কতা অলম্বন করেন। নির্ধারিত পরিমাণের চাইতে বেশি (তথ্য) বিষ প্রয়োগ করেন না, যাতে পাঠক নি:সঙ্গতা অনুভব না করে, সতর্ক হয়ে না যায় এবং লেখকের স্বচ্ছতার প্রতি তার যে আস্থা তা যেন দুর্বল হয়ে না যায়। এমন প্রাচ্যবিদদের লেখা পাঠকের জন্যে ঐসব লেখকের চাইতে বেশি ভয়ংকর ও বিপদজনক যারা প্রকাশ্যে শত্র“তা করেন এবং নিজেদের লেখা বই-পুস্তকসমূহকে মিথ্যা ও বানোয়াট দিয়ে বোঝাই করে তোলেন। ফলে মাধ্যম মানের বিবেকসম্পন্ন পাঠকের পক্ষে এসব লেখকের বিষাক্ত ও মিথ্যা তথ্যের সামনে হার না মেনে তাদের বই-পুস্তক থেকে বেরিয়ে আসা অথবা পড়া সমাপ্ত করা কঠিন হয়ে যায়। “সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭”।  তবে আধুনিক যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের দরুন পশ্চিমাদের মাঝে ইসলাম, পবিত্র কুরআন ও হাদীস নিয়ে গবেষণার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষিতে ইসলামী আইনের যথার্থতা অনেকের নিরপেক্ষ গবেষণায় ইতিবাচক হিসেবে ধরা পড়ে। ফলে পূর্ববর্তী প্রাচ্যবিদদের ইসলামী আইন ও ফিকহশাস্ত্র বিষয়ক কোনো কোনো দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রাচ্যবিদগণ ভিন্নমতও পোষণ করেন। বিশেষ করে পূর্ববর্তীদের মানহানিকর ও উপনিবেশবাদী সুরের স্থলে নতুনদের রচনায় স্থান করে নিয়েছে বিষয়ভিত্তিক ও একাডেমিক গবেষণা। এই প্রসঙ্গে বিশ্লেষক ফয়যাল ম্যানজু’র বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ঝরহপব ঃযব নবমরহহরহম ড়ভ ঙৎবরহঃধষরংস ধং ধ ফরংপরঢ়ষরহব রহ ঃযব ১৭ঃয পবহঃঁৎু ঁহঃরষ ঃড়ফধু, ৎবংবধৎপয সবঃযড়ফড়ষড়মু রহ ওংষধসরপ ষধি যধং রিঃহবংংবফ ধ ঢ়ধৎধফরমসধঃরপ ংযরভঃ. ঞযব ফবৎড়মধঃড়ৎু ধহফ পড়ষড়হরধষরংঃ ঃড়হব ড়ভ ঢ়রড়হববৎং ংঁপয ধং এড়ষফুরযধৎ, ঝপযধপযঃ ধহফ ডধঃঃ যধং নববহ ৎবঢ়ষধপবফ নু ধপধফবসরপ ড়নলবপঃরারঃু নু ংপযড়ষধৎং ংঁপয ধং ঘধফরধ অননড়ঃঃ ধহফ ডধবষ ঐধষষধয়. “ঋধরুধষ গধহলড় ঔনরফ, ঢ়.৬”
ফিক্হ সম্পর্কে প্রাচ্যবিদদের মতামত-পর্যালোচনা : ইসলামী আইন, শরীয়ত ও ফিক্হশাস্ত্র নিয়ে বিদ্বিষ্ট প্রাচ্যবিদদের কয়েকটি মতামত বা অপবাদ প্রসিদ্ধ, যা ইসলামী চিন্তাধারার সাথে অত্যন্ত সাংঘর্ষিক। যথা: এক. ইসলামী আইন ও শরীয়ত প্রাচীন রোমান আইন দ্বারা প্রভাবিত ও মদদপুষ্ট। দুই. আধুনিক যুগে ইসলামী শরীয়ত বা আইন অচল। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার যোগ্যতা নেই ইসলামী আইন ও ফিক্হশাস্ত্রের। তিন. ফিক্হ বা ইসলামী আইন ধর্মের গন্ডিবহির্ভূত একটি বিষয়। ইসলামী আইন, শরীয়াহ ও ফিক্হশাস্ত্র বিষয়ে প্রাচ্যবিদদের উপযুক্ত মতামত এবং তাদের আরোপিত অপবাদসমূহ নিতান্ত প্রলাপ এবং সত্যকে আড়াল করতে অন্ত:সারশূন্য অপপ্রয়াস বৈ কিছু নয়। ইসলামী আইনের বিদগ্ধ গবেষকগণ এসব অপবাদের যথাযথ জবাব দিয়েছেন তাদের বিভিন্ন গবেষণাকর্মে। এক্ষেত্রে প্রচুর বই বের হয়েছে আরব বিশ্বে। যার বিস্তারিত আলোচনা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের কতিপয় মূল্যায়ন দিয়েই সংক্ষিপ্তাকারে এ বিষয়ে পর্যালোচনা করতে চাই।
শরীয়াহ আইন রোমান আইনের প্রভাব : ইসলামী আইন ও শরীয়ত প্রাচীন রোমান আইন দ্বারা প্রভাবিত ও মদদপুষ্ট-এর মতামত ও অপবাদের প্রবক্তা প্রাচ্যবিদ ‘গোল্ডযিহার’, ‘ভন ক্রেমার’, ‘শেলডন অ্যামস’সহ আরো অনেকে। এ প্রসঙ্গে প্রাচ্যবিদ শেলডন অ্যামস (ঝযবষফড়হ অসড়ং)-কয়েকটি প্রসিদ্ধ উক্তি প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক ড. মামুদ হামদী জকজুক তাঁর একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি শেলডনের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, প্রাচ্যবিদ শেলডন স্পষ্টভাষায় বলেন, মুহাম্মাদী (তথা ইসলামী) আইন হচ্ছে পূর্বাঞ্চলীয় সাম্রাজ্যের রোমান আইনের সংস্কৃত রূপ। ওটাকেই আরব রাজ্যসমূহে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মুহাম্মাদী আইন জাস্টিনিয়ান (ঔঁংঃরহরধহ) আইন ছাড়া আর কিছু নয়। ওটাকেই কেবল আরবী পোশাক পরানো হয়েছে। “ড. মাহমুদ হামদী জকজুক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৩-১১৪। গরধহ জধংযরফ অযসধফ কযধহ, ওংষধসরপ ঔঁৎরংঢ়ৎঁফবহপব, ঝয.গঁযধসসধফ অংযৎধভ, খধযড়ৎব, ১৯৭৮, ঢ়ঢ়. ১৫৩-১৫৫”
ইসলামী শরীয়াহ আইনে রোমান আইনের প্রভাব-এই বিষয়ের অনুকূলে প্রাচ্যবিদদের দাবি হচ্ছে, মুসলমানরা যেসব এলাকা ও অঞ্চল জয় করেছিল সেখানকার বিজিত জাতির আইন-কানুন থেকে সাহায্য নেয়াটাই স্বাভাবিক। আর এসব এলাকায় তখন প্রচলিত ছিল রোমান আইন। মুসলমানদের পদানত হবার পূর্বে এসব এলাকা রোমান সাম্রাজ্যের আতওতাধীন ছিল। এভাবে ইসলামী ফিক্হ ও শরীয়াহ আইন রোমান আইন দ্বারা প্রভাবিত হয়। এমনকি প্রাচ্যবিদ গোল্ড যিহারের ভাষায় ‘ফিক্হ’ ও ‘ফুকাহা’ পরিভাষাদ্বয় রোমান আইনি পরিভাষা যথাক্রমে (ঔঁৎরং) চৎঁফবহঃরং ও (ঔঁৎরং) চৎঁফবহঃবং দ্বারা প্রভাবিত। “ড. ইবরাহীম আওয়াদ, দায়েরাতুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়াহ আল-ইস্তিশরাকিয়া : আদালীল ওয়া আবা আবা’তীল, মিসর : মাকতাবাতুল বালাদিল আমীন, ১৯৯৮ইং, পৃ. ৯৯”।
রোমান আইনের ক্ষেত্রে প্রথম কথা হচ্ছে, সব প্রাচ্যবিদ কিন্তু এমন দাবি করেননি। যে, ইসলামী আইন ও ফিক্হ রোমান আইন দ্বারা প্রভাবিত। যারা করেছেন তাদের অন্যতম হচ্ছেন : গোল্ড যিহার তার (ওহঃৎড়ফঁপঃরড়হ ঃড় ওংষধসরপ ঞযবড়ষড়মু ধহফ খধি গ্রন্থে, ভন ক্রেমার গ্রন্থে, ডি পোর তার গ্রন্থে এবং শেলডন অ্যামস তার (জড়সধহ ঈরারষ খধ)ি শীর্ষক গ্রন্থে। তাদের বাইরে আরো অনেক প্রাচ্যবিদ রয়েছেন যারা এ দাবির বিপক্ষে। তাদের মধ্যে মিয়্যূ, ন্যালিনিও, ওলফ, নোলডে, অ্যারমেনজুল, যায়েস প্রমুখ। উদাহরণস্বরূপ প্রাচ্যবিদ যায়েস নিশ্চিত করে বলেন, ইসলামের শরীয়াহ আইন ও রোমান আইনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ এখানে একটা মানব রচিত এবং আরেকটার উৎস হচ্ছে ঐশী প্রত্যাদেশ। “ড. ইবরাহীম আওয়াদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪”।
কিসের ভিত্তিতে প্রাচ্যবিদগণ বলেন, ইসলামী শরীয়ত রোমান আইন ও রোমান বিচার ব্যবস্থা থেকে নেয়া। এক্ষেত্রে তাদের দলিলসমূহ হচ্ছে মোটামুটি নিম্নরূপ: ক. ইসলামের পূর্বে আরব ও রোমানদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। এই যোগাযোগের কারণে প্রথমপক্ষ দ্বিতীয় পক্ষের আইন দ্বারা প্রভাবিত হয়। খ. মুসলমানরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে রোমানদের আইন দ্বারা প্রভাবিত হয়। গ. ইসলামী শরীয়াহ আইন আরবদের প্রচলিত কতিপয় উরফ তথা প্রথা-রেওয়াজ দ্বারা প্রভাবিত, যেসব প্রথা-রেওয়াজ পূর্ব থেকেই রোমান আইন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ঘ. এক্ষেত্রে তারা কতিপয় রোমান আইনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ইঙ্গিত করেন, যা তখনকার যুগে শাম, মিসর, আলেকজান্দ্রিয়া, বৈরূত ও কায়সারিয়ায় ছিল। ঙ. এ প্রসঙ্গে তারা রোমান আইন বিষয়ক কিছু বই-পুস্তকের কথাও উল্লেখ করেন। চ. রোমান বিচারপদ্ধতির প্রভাব, যা তৎকালীন সময়ে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনস্ত রাজ্যসমূহে প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে তারা রোমান প্রেইটর পদ্ধতি এবং ইসলামের বিচারক পদ্ধতির মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে বলে দাবি করেন।
এছাড়া প্রাচ্যবিদদের মতে, ইসলামী ফিক্হ ও রোমান আইনের মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন অর্থাৎ বাদীকে দলিল পেশ করতে হবে, প্রাপ্ত বয়স্কের বয়স নির্ধারণ, (ক্রয়-বিক্রয়) ও (পণ্য বিনিময়)-এর মধ্যে সাদৃশ্য প্রভৃতি। তাদের দৃষ্টিতে এসব সাদৃশ্যই প্রমাণ করে, ইসলামী আইন রোমান আইন দ্বারা প্রভাবিত। “ড. মুহাম্মদ যুহদী য়াকুন, আল-কুনূনুর রূমানি ওয়াশ-শরীআতুল ইসলামিয়াহ, বৈরূত : দারু য়াকুন, পৃ. ৪৫-৮০; ড. ইবরাহীম আওয়াদ, প্রাগুক্ত, ১৯৭৫ইং, পৃ. ১০৫”। রোমান আইন বিষয়ে প্রাচ্যবিদদের উপর্যুক্ত মতামত ও দাবি নিতান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত ইসলামী ফিক্হ ও আইনের প্রকৃত ইতিহাস এবং রোমান আইনের ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা করলেই এসব মতামতের অসারতা প্রতীয়মান হয়।
প্রথমত, ইসলামী ফিক্হ রোমান আইনের মদদপুষ্ট- এই দাবিটাই হচ্ছে নতুন; যার সূচনা উনবিংশ শতাব্দীতে। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এ দাবিটা উত্থাপন করেন তিনি হচ্ছেন আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসী ‘ডোমিনিলো জেতসকি’ নামক জনৈক ইতালিয়ান আইনজীবী। আলেজান্দ্রিয়া থেকে ১৮৬৫ ইং, সালে ইতালি ভাষায় প্রকাশিত তার একটি বইয়ে তিনি এমন দাবি করেন। এখানে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, এ দাবি যদি সঠিক হত, তাহলে ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে দীর্ঘ শতশত বছরে পশ্চিমা লেখক ও গবেষকগণ নিশ্চুপ বসে থাকতেন না। বাইজান্টাইন লেখকরা ইসলাম, ইসলামের নবী, ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নিয়ে কত লিখেছেন! কিন্তু তাদের একজনও এমন দাবি করেননি। এ দাবির স্বপক্ষে লেশমাত্র সত্য থাকলেও আহলে কিতাব ও পশ্চিমারা ইসলামের শত্র“তায় বইয়ের পাহাড় রচনা করে দিতেন।
ফিকহ ও ফুকাহা পরিভাষাদ্বয় রোমান আইনি পরিভাষা থেকে নেয়া-প্রাচ্যবিদ গোল্ডযিহারের এমন দাবি নিতান্তই সত্যবিবর্জিত। ইসলামী আইনের মৌলিক উৎস পবিত্র কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে তার অজ্ঞতাই প্রমাণ করে। মিস্টার গোল্ডযিহার হয়ত জানেন না, ইসলামী আইন প্রণয়নে রোমান আইনের প্রভাবের অনেক পূর্বেই পবিত্র কুরআনে ফিকহ শব্দের মূলধাতু থেকে উৎসারিত বিভিন্ন আঙ্গিকে শব্দ অন্তত বিশ জায়গায় এসেছে। আর হাদীস শরীফে যা এসেছে তা তো অসংখ্য।
শরীয়া আইনে রোমান আইনের প্রভাব বিষয়ে প্রাচ্যবিদদের উত্থাপিত অবশিষ্ট দাবিও মতামতের জবাবে ইতিহাসের সত্য উচ্চারণ হচ্ছে, জাহিলি যুগে আরবরা বেদুঈন জীবন-যাপন করত। প্রতিবেশী বিভিন্ন জাতি যাদের মধ্যে বাইজান্টাইনও ছিল- তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কোনোই সুযোগ ছিল না। উভয়ের মধ্যে ব্যবসায়িক যে সম্পর্ক ছিল তা কাফেলাসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যেসব কাফেলা বছরে একবার সিরিয়া যেত তাতে আরবদের সংখ্যাও থাকত নিতান্ত অল্প। সীমিত সময়ের জন্য কাফেলা থামত সেখানে এবং বাইজান্টাইনদের সঙ্গে পণ্য বিনিময় করে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করত। ঐসব এলাকায় বসবাসরত গাসসান জাতি বাইজান্টাইন সভ্যতা বাহ্যিক কিছু আচার-আচরণ দ্বারা প্রভাবিত ছিল বটে। কিন্তু তারাও রোমান আইন গ্রহণ করেনি। অনুরূপভাবে মিসর ও সিরিয়াবাসী বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনস্ত হওয়া সত্ত্বেও আঁকড়ে ছিল তাদের স্থানীয় আইন-কানুন।
ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মাধ্যমে ইসলামের পূর্বেই আরবদের মধ্যে রোমান আইন স্থানান্তরিত হওয়া বিষয়ে গবেষকদের বক্তব্য হচ্ছে, বরং ইহুদি আইনই রোমান আইনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ৭০ খ্রিস্টাব্দে ইহুদি আর রোমান সরকারের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষসমূহের কারণে ইহুদিরা তাদের ধর্মীয় প্রথাসমূহ ধরে রেখেছিল। এমনিতেই তারা রোমান সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। এদিকে ইহুদিরা ইসলামের পূর্বে আরব উপদ্বীপে এতই সংখ্যালঘু ছিল যে, আরবদের উপর তাদের কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাই নেই। একইভাবে আরবদের মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যাও ছিল খুবই অল্প। নাজরানে যেসব খ্রিস্টান ছিল তাদের সম্পর্ক ছিল আবিসিনীয়দের সাথে। কারণ উভয়ের ধর্ম ইয়াকুবী হওয়ায় আবিসিনীয়দের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্কে ভিন্ন ধর্মালম্বী রোমানদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী ছিল। অন্যান্য খ্রিস্টান গোত্র যারা রোমান সাম্রাজ্যের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বসবাস করত তারাও তাদের গ্রামীণ ও বেদুঈন জীবনপদ্ধতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। রোমান আইনের কোনো কিছু তাদের মধ্যে প্রবেশের ঘটনা ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে ড. বদরান আরো যোগ করে বলেন, ইসলামী ফিকহের কোনো ইমামই ইহুদি বংশোদ্ভুত ছিলেন না অথবা কেউই ইহুদি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। এছাড়া ইহুদি শরীয়া আইন লিপিবদ্ধ ছিল হিব্র“ ভাষায়, যা সাধারণত আরবরা জানত না। ফলে ইসলামের পূর্বে ইহুদি কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে আরবদের মধ্যে রোমান আইন প্রভাব বিস্তার করেছিল- কথাটা সঠিক নয়। রোমান আইনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবের দাবিটাও অসত্য। গবেষক ড. যুহদি ও ড. বদরান উভয়ই তাদের দীর্ঘ গবেষণাকর্মের পর এই ফলাফলে পৌছেন যে, সিরিয়া ও মিসরে যখন ইসলামের বিজয় সূচিত হয় তার অনেক পূর্বেই ঐসব কথিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তারপরও মুসলিম ফিক্হবিদদের মধ্যে ঐসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবের দাবি তোলাটা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও কল্পনাপ্রসূত।
এবার আসুন রোমান আইনের বই-পুস্তকের প্রভাব বিষয়ে। এ দাবি খন্ডনের জন্য আমাদের এতটুকু জানাই যথেষ্ট যে, আরবরা চিকিৎসা, দর্শন, সৌরবিদ্যা, অংকশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে অনেক প্রাচীন বই-পুস্তক অনুবাদ করলেও তারা কিন্তু আইনের কোনো বই অনুবাদ করেনি। এ রকম কিছু ঘটলে অন্যান্য অনূদিত বিষয়ের মধ্যে তার উল্লেখও থাকত নিঃসন্দেহে। উদাহরণস্বরূপ পিথাগোরাস, প্ল্যাটো, এরিস্টটল, গালিনিউস প্রমুখদের নামের সাথে সাথে তাদের বই-পুস্তকের বাইজান্টাইন আইনজ্ঞদের নামও আমরা দেখতে পেতাম। এছাড়া রোমান আইনের বই-পুস্তক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে- ধর্মীয় আক্বীদা-বিশ্বাস মুসলিম ফিক্হবিদদেরকে সেই অনুমতি দিত না। তবে হ্যাঁ, রোমান আইনের একটি গ্রন্থ পাওয়া যায় যা আরবীতে অনূদিত হয়েছিল। তা হচ্ছে- কিন্তু এর অনুবাদ সম্পন্ন হয় ১১০০ ইং, সালে অর্থাৎ ইসলামী ফিক্হ প্রণয়নের বেশ কয়েক শতাব্দী পর। এ একটি মাত্র উদাহরণ রয়েছে যার কোনো আলোচনাই আসেনি পরবর্তীতে প্রণীত ইসলামী ফিক্হ ও আইনের গ্রন্থসমূহে।
ইসলাম ও রোমান আইনের বিচারব্যবস্থার মধ্যে সাদৃশ্যের যে দাবি উত্থাপিত হয় তার জবাবে বলা যায়, আরবরা যখন প্রথম সিরিয়া জয় করে তখন ‘প্রেইটর’ পদ্ধতি বলবৎ ছিল। কিন্তু ইসলামের সূর্য উদিত হবার অন্তত চার শতাব্দী পূর্বেই রোমান সাম্রাজ্য থেকে এই পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এছাড়া উভয় পদ্ধতিতে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, তা তো আছেই। যেমন, রোমান আইনে বাদী-বিবাদী নিজেরাই বিচারক নির্বাচন করত এবং উভয়ের দাবি বিচারকের সামনে উত্থাপন করত। বিচারক তাদের দাবিগুলো শুনে নির্দিষ্ট বিশেষ কিছু ফরমে তা লেখার নির্দেশ দিত, যেখানে বিচারক মামলার রায় কিভাবে দিবে তার চিত্র তুলে ধরা হত। অথচ ইসলামী আইনে রাষ্ট্রই বিচারক নিযুক্ত করে। উভয় পক্ষে উপস্থাপিত মামলায় ইসলামের প্রচলিত আইনে সূরাহা না হলে বিচারক শরীয়তের আলোকে গবেষণা করে সিদ্ধান্ত বের করে রায় দিয়ে থাকেন।
ইসলামী ফিক্হ ও রোমান আইনের মধ্যে আরো যেসব সাদৃশ্যের কথা বলা হয়েছে যেমন, অর্থাৎ বাদীকে দলিল পেশ করতে হবে, প্রাপ্ত বয়স্কের বয়স নির্ধারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাদৃশ্য তাও সঠিক নয়। কারণ, বাদী তার দাবির সপক্ষে দলিল উপস্থাপন করবে-মর্মে ইসলামী আইনে যে ধারাটি রয়েছে তা এমন একটি আরবী প্রবাদ থেকে উৎসারিত যা হাদীস শরীফে বর্ণিত। পুরো হাদীসটা হচ্ছে- “আহমদ ইবন হুসাইন আল-বায়হাকী, সুনান আল-বায়হাকী আল-কুবরা, মক্কা: মাকতাবাতু দারিল বা’য, ১৯৯৪ইং, খ. ৮, পৃ. ১২৩”।
সুতরাং এখানে তা রোমান কিংবা অন্য কোনো আইন থেকে নকল করার দরকার পড়ে না। এটাই সাধারণ জ্ঞানের কথা। প্রাপ্তবয়স্কের বয়স নির্ধারণের বিষয়টাও তেমন নয় যেমনটা প্রাচ্যবিদগণ বলে থাকেন। কারণ রোমান আইনে মেয়েদের জন্য বয়সসীমা হচ্ছে ১২ বছর আর ছেলের ক্ষেত্রে ১৪ বছর। অথচ ইসলামী শরীয়তে ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্য ১৫ বছর। “ইসলামের পঞ্চম খলীফা উমার ইবনু আবদিল আযীয রাহ. শিশুর বয়সসীমা পনেরো বছর নির্ধারণ করেন। উল্লেখ্য তাঁর এ বয়সসীমা নির্ধারণেরও ভিত্তি হলো একটি হাদীস। নাফি’(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রাসূল (সা.) এর কাছে অনুমতি চাইলে রাসূল (সা.) তাঁকে অনুমতি দেননি। তখন তাঁর বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। পরের বছর খন্দকের যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য অনুমতি চাইলে তাঁকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল পনেরো বছর। রাবী নাফি (রা.) বলেন, এ ঘটনা শুনে খালীফা উমার ইবনু আবদিল আযীয রা. বললেন, এটাই হলো শিশু ও বয়স্কদের বয়সসীমা। (ইমাম, আস-সাহীহ, অধ্যায়- আল-ইমারাহ্, অনুচ্ছেদ : বায়ানু সিন্নিল বুলুগ, হা. নং : ৪৯৪৪)”। এর বিষয়েও আমরা দেখি, রোমান আইন উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করেছে এই বলে যে, তা হচ্ছে – অর্থাৎ মুদ্রা (ঈঁৎৎবহপু) দিয়ে বিনিময়। অর্থাৎ সম্পদের বিনিময়ে সম্পদ। এভাবে রোমান আইন উভয়কে যথাক্রমে সন্তুষ্টি ভিত্তিক চুক্তি এবং বেনামে অনির্ধারিত চুক্তি দুইভাগে বিভক্ত করে। কিন্তু ইসলামী শরীয়াহ ও উভয়কে সন্তুষ্টি ভিত্তিক বিক্রয় এর আওতাভুক্ত করে। “ড. ইবরাহীম আওয়াদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৬-১০৮”। সুতরাং শরীয়াহ আইনে রোমান আইনের প্রভাব রয়েছে- প্রাচ্যবিদদের এমন দাবি যথার্থ নয়। তাই ইসলামী ফিক্হশাস্ত্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রাচ্যবিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক ষড়যন্ত্রসমূহ বিশেষ করে উপরোল্লেখিত তাদের প্রথম অপবাদ ও তার জবাব প্রসঙ্গে প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক ড. মুস্তাফা সিবায়ি লিখেন,
ইসলামী ফিকহের আত্মমর্যাদা ও মূল্যের ক্ষেত্রে সংশয় সৃষ্টি করা তাদের অন্যতম লক্ষ্য। তারা যখন দেখলেন, এমন বিশাল আইনের ভান্ডার যা একত্রে ইতঃপূর্বে কোনো যুগের কোনো জাতির জন্য ছিল না, এত সমৃদ্ধ ইসলামের আইন কিভাবে হতে পারে। এ আইনের মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান তারা। যেহেতু তারা রাসূলের নুবুওয়াতে ঈমান পোষণ করেন না, তাই এমন ধারণা করা ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পেল না যে, এই মহান ও বিশাল ফিক্হশাস্ত্র অবশ্যই রোমান ফিক্হশাস্ত্র দ্বারা সাহায্যপুষ্ট। অর্থাৎ এটি তাদের- পশ্চিমাদের কাছ থেকে নেয়া। লাহাইয়ে অনুষ্ঠিত তুলনামূলক আইন সম্মেলনে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তার মধ্যে এটাও ছিল যে, ইসলামী ফিক্হ নিঃসন্দেহে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্র ফিক্হ বা আইন। এটা অন্য কোনো ফিক্হ বা আইন দ্বারা সাহায্যপুষ্ট নয়। এমন সিদ্ধান্তে প্রাচ্যবিদদের মধ্যে যারা মতলববাজ তাদের মুখ যেমন বন্ধ হয়ে গেছে, একইভাবে তা ন্যায়পরায়ণ সত্যের অনুসন্ধানী গবেষকদের আশ্বস্ত করেছে। “ড. মুস্তাফা আস সিবায়ী, আল-ইস্তিশরাক্ব ওয়াল-মুস্তাশরিকুন : মা লাহুম ওয়ামা আলাইহিম বৈরূত : আল মাকতাবুল ইসলামী, পৃ. ২৯”।
বর্তমানে কি ইসলামী আইন অচল? আধুনিক যুগে ইসলামী শরীয়ত বা আইন অচল। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার যোগ্যতা নেই ইসলামি আইন ও ফিক্হশাস্ত্রের কতিপয় প্রাচ্যবিদের এমন অপবাদ বা দাবির বিষয়ে যারা উত্তর দিয়েছেন তাদের একজন হচ্ছেন ড. আব্দুল হামীদ মুতাওয়াল্লী। তিনি তার আশ শরীআতুল ইসলামিয়া ওয়া মাউক্বিফু উলামাইল মুস্তাশরিক্বীন’ (অর্থাৎ ইসলামী শরীয়াহ এবং প্রাচ্যবিদদের অবস্থান) শীর্ষক গবেষণাকর্মে প্রাচ্যবিদদের সেই অপবাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন দালিলিকভাবে। তাঁর মতে ইসলামী শরীয়াহ ও আইন একেবারেই বন্ধ্যাত্বমুক্ত, সকল যুগের উপযোগী ও সচল। তিনি জোর দিয়ে বলেন, দুনিয়ায় যত আইন রয়েছে তার মধ্যে ইসলামী শরীয়া আইনই সবচেয়ে বেশি গতিশীল সর্বাধিক উপযোগী এবং (সকল যুগে চলার) যোগ্য। (যুগ-যুগান্তরে) উপযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো ত্র“টি বা অচলাবস্থা যদি থেকে থাকে তা কোনো মুসলিম আলিম কর্তৃক ব্যাখ্যার কারণে হলে হতে পারে। তিনি বলেন, শরীয়া আইনের কিছু লোকের ভুলের কারণে পুরো শরীয়াহকেই দোষারোপ করা এবং ধর্মীয় কোনো দলের ভুল-ত্র“টির কারণে গোটা ধর্মকেই দোষারোপ করা প্রাচ্যবিদদের চিরাচরিত পন্থা। তাদের এ পন্থা বেশ কয়েক বছর ধরে পরিচিত। “দ্রষ্টব্য: মদিনা সেন্টার ফর স্টাডিজ এন্ড রিসার্চ অব অরিয়েন্টালিজম”।
সুতরাং বর্তমান যুগে ইসলামী আইন কখনো অচল হতে পারে না। ড. আব্দুল হামীদ আরো বলেন, তা কিভাবে হতে পারে যেখানে পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন আহকাম তথা বিধানসম্বলিত আয়াতসমূহ এসেছে সাধারণভাবে অথবা সামগ্রিক রূপে। সাধারণ বিধানগুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যার দিকে যায়নি। “প্রাগুক্ত”। অর্থাৎ মামলার মৌলিক ধারাটা উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে করে যে, কোনো যুগের সংশ্লিষ্ট মামলা সেই আলোকে সমাধান করা যায়। কারণ, যুগ পরিবর্তনশীল, যুগের মানুষ ও অবস্থা পরিবর্তনশীল। ওসব মৌলিক ধারাতে যে কোনো যুগ ও পরিস্থিতির মামলার বিচারের সুযোগ রয়েছে। আর বিচারের সেই গুরু কাজটা আঞ্জাম দিতে পারবেন কেবলমাত্র বিদগ্ধ মুসলিম আইনবিদগণ। অতএব, কুরআনিক ধারায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। যেসব আয়াতে সাধারণ বিধান ও নির্দেশনা রয়েছে তার মধ্যে কয়েকটা যেমন: আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন। আর আমি আপনাকে তো বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি। “আল-কুরআন, ২১ : ১০৭”। তিনি দ্বীনের মধ্যে তোমাদের জন্য কোনো কঠোরতা আরোপ করেন নি। “আল-কুরআন, ২২ : ৭৮”।  আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তাই চান এবং যা তোমাদের জন্য কঠিন ও কষ্টকর তা চান না। “আল-কুরআন, ২ : ১৮৫”।
ইসলামী আইনের ইতিহাসে আইনগত এই গতিময়তা ও ফ্লাক্সিবিলিটির বাস্তবতা স্পষ্টত পরিলক্ষিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এখানে এমন কিছু স্থির ও স্থায়ী বিষয় রয়েছে, যা অটল ও অমোঘ। কোনো ফকীহ কিংবা মুসলমান সেসব স্থির অকাট্য বিষয়ের বাইরে যেতে পারবে না। তবে পরিবর্তনযোগ্য বিষয় প্রচুর রয়েছে। “এক্ষেত্রে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন”। কারণ, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। সেই হিসেবে ইসলামী আইনও পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ। ইসলাম দাবি করে, জীবন-জগতের সব জিজ্ঞাসা ও সব সমস্যার সমাধান ইসলামে রয়েছে। পবিত্র কুরআন নিজেই ঘোষণা করেছে, সকল কিছুর বিবরণ তাতে রয়েছে। আর মহানবী (সা.) এর আদর্শ এমন সর্বব্যাপী কালজয়ী ও শাশ্বত যে, মহাপ্রলয় দিবসের পূর্ব পর্যন্ত কখনো এর আবেদন ফুরাবে না। বিশ্ব যতই আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক যুগে প্রবেশ করছে ততই নতুন নতুন জিজ্ঞাসা ও আইনি সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। বাহ্যত পবিত্র কুরআন ও মহানবী (সা.) এর সুন্নাহে আধুনিক এসব বিষয়ের কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য না থাকলেও এমন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য ও ইঙ্গিত রয়েছে যার দ্বারা বিশ্বমানব পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে চিন্তা-গবেষণা করে নতুন সৃষ্ট আইনি জিজ্ঞাসা ও সমস্যার সমাধান আবিষ্কার করতে উদ্দীপ্ত হয়। এ প্রক্রিয়ার নামই ইজতিহাদ। “ড.মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ, ইসলামে ইজতিহাদ: একটি পর্যালোচনা, ইসলামী আইন ও বিচার, বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এ- লিগ্যাল এইড সেন্টার, বর্ষ: ৬, সংখ্যা, ২৩, জুলাই- সেপ্টেম্বর: ২০১০, পৃ. ৯”।
ইসলামের আবির্ভাব থেকে আজ পর্যন্ত চৌদ্দশ বছরেরও অধিককাল ধরে ইজতিহাদের কার্যকারিতা ইসলামকে কালজয়ী আদর্শ ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে এবং ইসলামী আইন ও বিচারকে কালজয়ী আইন ও বিচারব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে।  ইসলামী আইনের সময়োচিত ও বৈজ্ঞানিক এই বাস্তবতা আধুনিক যুগের অনেক প্রাচ্যবিদও স্বীকার করেন। যেমনটি বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকের আলোচনায় ফুটে ওঠেছে। গবেষক ও বিশ্লেষক জনাব ফয়যাল প্রাচ্যবিদ ঘড়ৎসধহ ঈধষফবৎ, ঝঁংধহ অ. ঝঢ়বপঃড়ৎংশু, চধংপধষব ঋড়ঁৎহরবৎ এর ন্যায় প্রসিদ্ধ কয়েকজন প্রাচ্যবিদের ইসলামী শরীয়া ও আইনবিষয়ক গ্রন্থ পর্যালোচনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেন: ঞযব ঢ়ৎরহপরঢ়ব রং ঃযধঃ রভ ঃযব ঃবীঃ রং য়ধঃ র ধষ-ঃযঁনঁঃ ধহফ য়ধঃ র ধষ ফধষধষধয ঃযবৎব রং যধৎফষু ধহু ংপড়ঢ়ব ভড়ৎ রলঃরযধফ ধং ঃযব ষধি ঃযবহ রং পষবধৎ-পঁঃ ধহফ পযধহমরহম ঃযব ষধি রং হড়ঃ ঢ়ড়ংংরনষব ধং ংঁপয ইঁঃ ঃযবৎব ধৎব পধংবং যিবৎব ঃযব ঃবীঃ রং য়ধঃ র ধষ-ঃযঁনঁঃ যিরষব নবরহম ুধহহর ধষ-ফধষধষধয ধহফ ঃযরং ড়ঢ়বহং ঁঢ় ধ ংসধষষ ংঢ়ধপব ভড়ৎ রলঃরযধফ. অ ষবমধষ ঃবীঃ পধহ ধষংড় নব ুধহহর ধষ-ঃযঁনঁঃ ধহফ ুধহহর ধষ-ফধষধষধয ধং রহ ঃযব পধংব ড়ভ শযধনধৎ ধষ-ধিযরফ ড়ৎ ুধহহর ধষ-ঃযঁনঁঃ ধহফ য়ধঃ ঃ ধষ-ফধষধষধয ধং রহ পধংবং ড়ভ বিষষ বংঃধনষরংযবফ ঢ়ৎধপঃরপবং. অষষ ঃযবংব ফরভভবৎবহঃ পষধংংরভরপধঃরড়হং ধৎব ঢ়ড়ংংরনষব যিবহ রহঃবঢ়ৎবঃরহম ধ ঃবীঃ ধহফ ঃযরং বীনষধরহং ঃযব বসবৎবমবহপব ড়ভ ঃযব ংপযড়ড়ষং ড়ভ ষধ.ি
(সংক্ষেপে) যেখানে (অকাট্যভাবে প্রমাণসিদ্ধ) ও (সুস্পষ্ট ও দ্বার্থহীন বক্তব্য) সম্বলিত শরীয়তের অকাট্য দলিল রয়েছে, সেখানে ইজতিহাদ, করার কোনো সুযোগ নেই আর যেখানে শরীয়তের মূল বক্তব্যে ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে অর্থাৎ যেখানে (অকাট্যভাবে প্রমাণসিদ্ধ) (অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্য) সম্বলিত দলিল রয়েছে সেখানে বিদগ্ধ ফিকহবিদদের গবেষণা বা ইজতিহাদ করার সুযোগ রয়েছে। একটি আইনবিষয়ক দলিল (অকাট্যভাবে প্রমাণসিদ্ধ নয়) (অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্য) অথবা (অকাট্যভাবে প্রমাণসিদ্ধ নয়) (সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য) ও হতে পারে। এরকম অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত মামলার ক্ষেত্রে ঘটেছে। কোনো আইনী ধারাকে ব্যাখ্যা করার সময় এসব পার্থক্যকে বিবেচনায় আনা সম্ভব এবং স্কুলস অব ল তথা আইনের প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রয়োজনীয়তাকে পরিষ্কার করে। “ঋধরুধষ গধহলড়ড়, রনরফ, ঢ়.৮”
ইসলামী আইন ও ফিক্হশাস্ত্রে ধর্মের প্রভাব : ইসলামী আইন ও শরীয়া দ্বীনের বহিরাগত একটি বিষয়-প্রাচ্যবিদ শাখতের এমন মন্তব্যটি এতই অযৌক্তিক যে, তাতে পবিত্র কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে শাখতের সীমাহীন অজ্ঞতাই ফুটে ওঠে। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি, ফিক্হ ও ইসলামী আইন কতই দীনভিত্তিক তা দীনের প্রধান উৎস পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য আইনি বিধান থেকে সহজে অনুমেয়। বিদগ্ধ পাঠকমহলের সুবিধার্থে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ইসলামী আইন-কানুন সংক্রান্ত আয়াতসমূহের একটি চার্ট উল্লেখ করা হচ্ছে:
বিষয়    বিধানের সংখ্যা    বিষয়    বিধানের সংখ্যা
ইবাদাত (ধনীদের উপর আরোপিত যাকাতও রয়েছে)    ৮৯    জিহাদ ও আন্তর্জাতিক আইন    ৭৪
সামাজিক ব্যবস্থা  (ব্যক্তি ও পারিবারিক বিধান)    ১২১    পানাহার বিষয়ক বিধান    ৪০
ক্রয়-বিক্রয়    ১৩    বিভিন্ন ধরনের অপরাধ    ৯
বিচার    ১৬    সাক্ষ্য    ৭
দৈহিক ও আর্থিক শাস্তি    ২৪

পবিত্র কুরআনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাসূল (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনেও ইসলামী আইন ও বিচারের অসংখ্য নজির রয়েছে। কথা ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রে। রাসূল (সা.) এর সীরাতে আমরা দেখি, তিনি বিভিন্ন এলাকার শাসকদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন আল্লাহর আইন অনুযায়ী মানুষের মাঝে বিচার করেন। আমর ইবন হাযম (রা.) এর বরাবরে লিখিত একপত্রে তিনি (সা.) তাঁকে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর ভয় ও তাকওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকওয়াবান এবং সৎকর্মপরায়ণদের সাথে রয়েছেন। এ ছাড়া যা কিছু গ্রহণ করবে তা আল্লাহর নির্দেশনা মতে হকের সাথে গ্রহণ করতে তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। “মুহাম্মদ হামীদুল্লাহ, মাজমূআতু আল-ওয়াসাইকিস লিল আহদিন নববী ওয়াল খিলাফাতির রাশিদাহ, দলিল নং ১০৫, বৈরূত : দারুন নাফায়েস, ১৯৮৭ইং, পৃ. ২০৭”।
সাহাবীদের মধ্যে উমর (রা.) কে দেখা যায়, তিনি আবু উবায়দা ও মু’আয (রা.) কে পত্র লিখেছেন এ মর্মে যে, ভালো ও সৎ লোক দেখে তাদেরকে বিচার কার্যে নিয়োগ দাও এবং তাদের রিযক তথা ভাতার ব্যবস্থাও করো। “ইমাম শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, বৈরূত : ম,ুআসসাতুর রিসালাহ, ১৯৮৫ইং, খ. ১, পৃ. ৪৫৫”। রাসূল (সা.) নিজেও মানুষের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বিচার-ফায়সালা করেছেন।
আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন-কোনো বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল রায় বা সিদ্ধান্ত দিলে সেক্ষেত্রে কোনো মু’মিন পুরুষ বা নারীর ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। আর যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করবে সে স্পষ্ট পথভ্রষ্ট হবে। “আল-কুরআন, ৩৩ : ৩৬”। বিপুল সংখ্যক সাহাবীও রাসূল (সা.) এর যুগের বিচারক হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, আবু মুসা আল আশ’আরী (রা.), উবাই ইবন কা’ব (রা.) হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা.), দাহইয়া আল কালবী (রা.), যায়িদ ইবন সাবিত (রা.), আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.), আত্তাব ইবন উসাইদ (রা.), আলী ইন আবী তালিব (রা.), উক্ববাহ ইবন আমির (রা.), উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.), আমর ইবন হাযম (রা.), আমর ইবনুল আস (রা.), মু’আয ইবন জাবাল (রা.), মা’ক্বিল ইবন ইয়াসার (রা.), প্রমুখ। “ড. মুস্তাফা আল আজমী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০”।
অতএব, ইসলামে পূর্ণাঙ্গ আইন ও বিচারব্যবস্থা যেমন রয়েছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর সেই আইন প্রয়োগের নির্দেশনাও রয়েছে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে। রাসূল (সা.) এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা.) সেই দীনভিত্তিক আইনের সফল বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন কথা ও কাজে। প্রয়োজন মত ইসলামী আইন লিপিবদ্ধও করা হয়েছে। ফলে প্রথম শতাব্দীর মধ্যে বনী উমাইয়্যার আমলেই ফিক্হশাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থসমূহ প্রস্তুত হয়ে গেছে। তাই ফিক্হশাস্ত্রের ভিত্তি নিয়ে প্রাচ্যবিদ শাখত এবং তার অনুসারীদের মন্তব্য সর্বৈব মিথ্যা। রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম তথা ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে ফিক্হ বা ইসলামী আইনের অস্তিত্ব ছিল না- কথাটাও সম্পূর্ণ অসত্য।
আমাদের করণীয় : ইসলামী আইন ও ফিকহশাস্ত্রে প্রাচ্যবিদদের এসব ষড়যন্ত্রমূলক রচনা ও উক্তি মূলত ইসলামের বিরুদ্ধে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের শামিল। এ যুদ্ধে জয়ী হতে হলে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই আগাতে হবে। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালীর ভাষায়-বুদ্ধি ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে কাউকে হারাতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐ ব্যক্তির চাইতে বেশি জানতে হবে; বরং সর্বোচ্চ জ্ঞানী হতে হবে। তখন তার বুদ্ধিবৃত্তিক ভুলগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে খন্ডন করতে পারবেন আপনি। তাই ইসলাম সম্পর্কে প্রাচ্যবিদদের যেসব রচনা ও গবেষণাকর্ম রয়েছে সবগুলোকে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে। অতঃপর তাদের লেখা ও রচনায় ইচ্ছা ও অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলোকে প্রমাণ করে তা শুধরে দিতে হবে। এই বাস্তবতাকে অনেক প্রাচ্যবিদও স্বীকার করেছেন। যেমনটি করেছেন ফরাসি প্রাচ্যবিদ ম্যাকসিন রডিনসন (গধীরস জড়ফরহংড়হ)। “ড. মাহমুদ হামদী জকজুক, আল-ইসলাম ওয়াল ইস্তিশরাক, কায়রো : মাকতাবাতু ওয়াহবা, ১৯৮৪ইং, পৃ. ২৭”।
মোটকথা, ইসলামী আইন ও ফিক্হশাস্ত্র সহ ইসলাম ও মুসলমানদের বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রাচ্যবিদদের রচনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ হতে হবে। এক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা একান্ত জরুরী। প্রাচ্যবিদদের লেখা ও গবেষণাকে চোখ বন্ধ করে গ্রহণ না করে; বরং ইসলামী জ্ঞানের প্রধান উৎস পবিত্র কুরআন ও হাদীস এবং অন্যান্য মৌলিক গ্রন্থসমূহের সাথে তা মিলিয়ে দেখতে হবে। ইদানীং ইসলামী আইন ও ফিক্হশাস্ত্রের প্রচুর মৌলিক বই বাংলা, ইংরেজিসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম দেশ ইসলামী ফিক্হ বিষয়ক বিশ্বকোষও প্রকাশ করেছে। ‘‘এ ক্ষেত্রে কুয়েতের ওয়াক্ফ ও ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ৪৫ খন্ডের আল মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ অর্থাৎ ফিক্হ বিশ্বকোষ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য’’।
ইসলামী বিষয়ে পশ্চিমা অমুসলিম লেখকদের তুলনায় মুসলিম স্কলার ও বিশেষজ্ঞ লেখকদের বই-পুস্তক ও গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এক্ষেত্রে মুসলিম গবেষকদের করণীয় সম্পর্কে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সায়্যিদ আবুল হাসান আলী (রাহ.) এর একটি উক্তি দিয়ে এই প্রবন্ধের ইতি টানতে চাই তিনি বলেন- প্রাচ্যবিদদের নেতিবাচক প্রভাব রোধ করার জন্যে এবং এই অনিষ্টের সংশোধনের জন্যে ইসলামের আলিমসমাজ, গবেষক ও চিন্তাবিদদেরকে জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অবশ্যই কলম ধরতে হবে। মুসলিম বিশ্বের সামনে নিশ্চিত ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সঠিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি তোলে ধরতে হবে। সাথে সাথে সেই প্রশংসিত দিকগুলোর প্রতিও যথাযথ যতœবান থাকতে হবে, যা প্রাচ্যবিদদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য; বরং তাদের থেকে একটু বেশি থাকতে হবে এ ক্ষেত্রে। একইভাবে মৌলিক গবেষণা, বিস্তর অধ্যয়ন, গভীর দৃষ্টিভঙ্গি, নিশ্চিত ও সঠিক সোর্স এবং শক্তিশালী প্রমাণের দিক দিয়ে তাদের লেখা ও রচনাগুলো প্রাচ্যবিদদের লেখা ও রচনার তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে। এছাড়া তাদের লেখা ও গবেষণাসমূহ সব ধরনের বিশুদ্ধতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর বহনকারী হতে হবে, হতে হবে নির্ভুল যার মধ্যে জ্ঞানগত কোন ত্র“টি থাকবে না। ‘‘সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী, প্রাগুক্তা, পৃ. ২০’’।
উপসংহার : প্রাচ্যবিদদের ইসলামবিষয়ক রচনা ও গবেষণা মূলত একটি সুদূরপ্রসারী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। ইসলামের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শরীয়া আইন ও ফিক্হশাস্ত্রে তাদের রচনা ও গবেষণাকর্মসমূহ আলোচ্য আন্দোলনে নতুনমাত্রা যোগ করেছে। এই আন্দোলনে দুয়েকজন প্রাচ্যবিদ নিরপেক্ষ থাকলেও বিপুল সংখ্যক প্রাচ্যবিদদের রচনা ও গবেষণা পক্ষপাতদুষ্ট ও ষড়যন্ত্রমূলক। বিশেষ করে কতিপয় প্রাচ্যবিদ যেমন ইগ্নায গোল্ডযিহার (ওমহধু এড়ষফরুযবৎ), (জোসেফ শাখ্ত (ঔ.ঝপযধপযঃ), (নোয়েল জি. কোলসন (ঘ.ঔ.ঈড়ঁষংড়হ), (শেল্ডন অ্যামস) (ঝযবষফড়হ অসড়ং) প্রমুখের মতামত ও মন্তব্য অত্যন্ত আপত্তিকর ও ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামী আইন ও ফিক্হ ধর্মবহির্ভূত একটি বিষয়, এই আইনটি প্রকৃতপক্ষে রোমান আইন থেকে নেয়া এবং বর্তমান যুগে ইসলামী আইন অচল ইত্যাদি মতামতকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ওসব বিদ্বিষ্ট প্রাচ্যবিদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মুসলমানদের অন্তরে বিদ্যমান ইসলাম ধর্ম ও ধর্মীয় আইনের প্রভাবকে ক্ষীণ করে তোলা, দীন সম্পর্কে আধুনিক প্রজন্মকে সংশয়যুক্ত করা, সর্বোপরি ইসলামী আইনকে অন্য দশটি মানবরচিত আইনের মত করে উপস্থাপন করে আইন ও বিচার বিভাগকে ধর্মহীন বা ধর্মনিরপেক্ষ বানানোর অপচেষ্টা করা। যার অশুভ ফলাফল আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি অনেক মুসলিম দেশে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষায় রচিত প্রাচ্যবিদদের এমনতর আপত্তিকর মতামত সম্বলিত বই-পুস্তক ইউরোপ-আমেরিকাসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যভুক্ত অথবা রেফারেন্স বুক হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
ইসলামী আইন ও বিচারের প্রতি মুসলিম যুবসমাজের আস্থা ও বিশ্বাসে দুর্বলতা আছে। অথচ প্রাচ্যবিদদের এসব মতামত নিঃসন্দেহে পবিত্র কুরআন, হাদীস ও বাস্তবতার নিরিখে সর্বৈব মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত, যা বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এতে ইসলামী আইন ও ফিক্হশাস্ত্রের মৌলিক উৎস পবিত্র কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে তাদের সীমাহীন অজ্ঞতা যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তাদের অশুভ পরিকল্পনাও স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই এ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে মুসলিম স্কলার ও গবেষকদের সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে প্রাচ্যবিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য, ইসলামী আইনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে সুচিন্তিত গবেষণার মাধ্যমে। ইসলামী আইন ও ফিক্হশাস্ত্র নিয়ে প্রাচ্যবিদদের অপবাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি নতুন প্রজন্মের হৃত আস্থা ও শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে হবে। এতে করে মানবরচিত বিচার ব্যবস্থার যাঁতাকল থেকে মুক্ত হয়ে মানবতা যেমন সুবিচার পাবে, সমাজ থেকে দূরীভূত হবে যাবতীয় যুলুম, অন্যায় ও অবিচার।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট। (সমাপ্ত)