নতুন ইসিতে আস্থা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই বড় চ্যালেঞ্জ

5

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বহুল আলোচনা ও সমালোচনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তাবকৃত ৩২২ জনের মধ্য থেকে বাছাই করে ৫ জনকে নিয়ে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের ইসি গঠনের বিষয়টিকে সবাই ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। এখন পর্যন্ত নতুন ইসির কারও বিরুদ্ধে কোন অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি। এমনকি সরকারের কঠোর সমালোচনাকারী রাজনৈতিক দল বিএনপিও তাদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে পারেনি। তাই নতুন ইসি দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই ইসির প্রতি আস্থা প্রকাশ করে দেশের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই হবে এই কমিশনের বড় চ্যালেঞ্জ। আজ সোমবার দায়িত্ব গ্রহণ করবে এই ইসি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন নির্বাচন কমিশনে কারা আসেন এ নিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। তাই ৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি করার পর থেকেই এ নিয়ে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। সার্চ কমিটি অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে ১০ জনের তালিকা করবে কি না এবং রাষ্ট্রপতি সে তালিকা থেকে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ৫ জনকে নিয়ে ইসি নিয়োগ করবেন কি না এ নিয়ে ছিল ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ৫ ব্যক্তিকে নিয়ে নতুন ইসি গঠন করায় জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির বাছাইকৃত তালিকা থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও ৪ জনকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছেন। শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ইসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নিয়োগ করা হয় সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে। আর ৪ কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আহসান হাবীব খান, সাবেক সিনিয়র সচিব মোঃ আলমগীর ও সাবেক সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমানকে। তারা রবিবার প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ করেছেন। আজ সোমবার আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে গিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এরপর সংবিধান অনুসারে পুরো ৫ বছর সময়কালে তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচন পরিচালনা করবেন।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর রাজনীতিতে বিএনপির অত্যন্ত কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। নতুন ইসির প্রতি বিএনপিকে আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন সিইসি অত্যন্ত দক্ষ, মেধাবী সাহসী ও নিরপেক্ষ। কাজী হাবিবুল আউয়ালের মতো খাঁটি মানুষ পেয়েছে ইসি। তাই বিএনপি তার নেতৃত্বাধীন ইসির প্রতি আস্থা রাখতে পারে। তিনি বলেন, সার্চ কমিটির সঙ্গে মতবিনিময়কালে আমি ইসির জন্য ৮ জনের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। আমার প্রস্তাবে থাকা নাম থেকে সিইসি নিয়োগ করা হয়েছে। এই ইসির সবাইকেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই হবে এই কমিশনের বড় চ্যালেঞ্জ। আমার দেয়া তালিকা থেকে সিইসি নেয়া হয়েছে, এ জন্য আমি খুশি। সরকার একটা ভাল কাজ করল। এই ইসিকে সবার সহযোগিতা করা উচিত। সরকার নতুন সিইসির ওপর খুব বেশি প্রভাব খাটাতে পারবে না, কারণ তার মধ্যে সততা আছে। তিনি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে আমার বিশ্বস। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করলে এই ইসির পক্ষে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট উপহার দেয়া সম্ভব। তাই বিএনপির উচিত এই ইসি মেনে নেয়া।
দেশের বিশিষ্টজন ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ নতুন ইসি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, সার্চ কমিটি অনেক সময় নিয়ে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১০ জনকে বাছাই করেছে। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে ৫ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। সেই হিসেবে তারা নিশ্চয়ই উপযুক্ত। তবে ইসি কেমন হলো কাজের মাধ্যমেই জানা যাবে। আমরা আশা করব ভাল নির্বাচন আয়োজনের জন্য জাতির যে প্রত্যাশা, সেই লক্ষ্যে তারা কাজ করবেন। গুরুত্বপূর্ণ সরকারী দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তাদের আছে। এখন তাদের সাংবিধানিক যে দায়িত্ব পালন করতে হবে, তা আগের দায়িত্বের চেয়ে অনেকটা আলাদা। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, সাহস ও সদিচ্ছার প্রয়োজন হবে। জাতি এই ইসির কাছে অনেক কিছু আশা করে। আমরা আশা করব, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার মাধ্যমে তারা জাতির আশা পূরণ করতে পারবেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেছেন, নতুন ইসি দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে বলে আমরা আশাবাদী । তিনি বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন উপহার দিতে এই ইসিকে সার্বিক সহযোগিতা করবে আওয়ামী লীগ। আমরা আশা করব তারা তাদের দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবেন। মানুষ যাতে তাদের ভোট প্রদানের নিশ্চয়তা পায় সেটি তারা নিশ্চিত করবেন। তাহলেই দেশের মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারবেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আমি মনে করি, যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা আগামী দিনে নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে আরও ভাল কাজ করবেন। আর তাহলেই জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তারা অতীতে যে যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখিয়েছেন সেভাবেই দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করবেন। এই ইসির মূল দায়িত্ব হচ্ছে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা।
নতুন নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির কোন আগ্রহ নেই। কারণ, আওয়ামী লীগ সবকিছু নিজেদের লোক দিয়ে করছে। তাই বিএনপির সামনে এখন প্রধান লক্ষ্য নিরপেক্ষ সরকার। কারণ, নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির কোন ধরনের মাথাব্যথা নেই।
নতুন ইসি সম্পর্কে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, নতুন সিইসিকে ভাল বলেই জানি। তবে সবকিছু তার কাজের ওপর নির্ভর করবে। কারণ, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলে পরিচয়।’
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই ইসির কাছে প্রত্যাশা থাকবে, আইন মেনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন যেন করে। তাহলেই আগের ইসি নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছে তার অবসান হবে।
নতুন নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের জানান, সব দলের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করতে কাজ করব। তবে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব দায় শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোরও সহযোগিতা প্রয়োজন। তারা যদি মনে করেন, নির্বাচন কমিশন সুন্দর নির্বাচন করিয়ে দেবে, তাহলে ভুল ধারণা হবে। তাই আমি তাদের সহযোগিতা চাই। তবে আমার সবার প্রতি সমান দৃষ্টি থাকবে। সবার সঙ্গে সমান আচরণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করব। তবে সব দোষ নির্বাচন কমিশনকে দিলে গ্রহণ করব না। রাজনৈতিক দল, পুলিশ, আনসার, র‌্যাবকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি বলেন, অতীতের মতো ইমেজ সঙ্কট আমাকে নিয়েও হতে পারে। আমি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা না পেলে এবং নির্বাচনী পরিবেশ অনুকূল না হলে সবাই আমাকেও দায়ী করবেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী নতুন নির্বাচন কমিশনে সিইসি পদে নিয়োগ পাওয়া সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল একজন সৎ, মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে ২০১৭ সালে অবসর নিয়েছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আগে তিনি আইন, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও সংসদ সচিবালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। সরকারী চাকরি থেকে বিদায় নেয়ার পর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন।
১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও ১৯৭৮ সালে এলএলএম ডিগ্রী অর্জনের পর হাবিবুল আউয়াল আইনজীবী হিসেবে ১৯৮০ সালে বার কাউন্সিলের সনদ পান। ১৯৮১ সালে তিনি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী জজ পদে নিয়োগ পান। ১৯৯৭ সালে তিনি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। বাংলাদেশ ল’ কমিশনের সেক্রেটারি, শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রেষণে সহকারী সচিব ও উপসচিব হিসেবে আইন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব নিযুক্ত হয়ে ২০০৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হন। ২০০৭ সালের ২৮ জুন তিনি একই মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে পদোন্নতি পান। ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের পর ২০১০ সালের ২৪ এপ্রিল তাকে রাষ্ট্রপতির ১০ শতাংশ কোটায় প্রথমে ধর্ম সচিব এবং পরে প্রতিরক্ষা সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা ছিল হাবিবুল আউয়ালের। কিন্তু ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি পিআরএল বাতিল করে তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে এক বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেয় সরকার। পরে সেই চুক্তির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়।
৪ নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে বেগম রাশিদা সুলতানা অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম ডিগ্রী নিয়ে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারী চাকরিতে যোগ দেন। আহসান হাবীব খান, সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে থাকা অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। এক সময় তিনি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
নির্বাচন কমিশনার মোঃ আলমগীর বিসিএস ১৯৮৪ (পঞ্চম) ব্যাচের কর্মকর্তা। সর্বশেষ তিনি নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব হিসেবে গত বছর জানুয়ারিতে পিআরএলএ যান। এর আগে ২০১৯ সালের ১০ জুন নির্বাচন কমিশনের সচিব পদে নিয়োগ পান। সেখানে যোগদানের তিন মাসের মাথায় তিনি সিনিয়র সচিব হন। এর আগে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ছিলেন। তার আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। এ ছাড়া তিনি দীর্ঘদিন সৌদি আরবের হজ মিশনের কাউন্সিলর পদেও দায়িত্ব পালন করেন।
নতুন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বিসিএস ১৯৮৫ (সপ্তম) ব্যাচের কর্মকর্তা। সর্বশেষ তিনি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ছিলেন। এর আগে তিনি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
প্রস্তাবিত ৩২২ জনের তালিকা থেকে ১০ নামের তালিকা চূড়ান্ত করে ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে এ তালিকা জমা দেয় সার্চ কমিটি। এর আগে ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সার্চ কমিটি নিজেদের মধ্যে ৭টি ও দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে ৪টি বৈঠক করে। সার্চ কমিটির কাছ থেকে নতুন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য সুপারিশকৃত ১০ জনের নামের তালিকা পাওয়ার পর থেকেই যাচাই-বাছাই শুরু করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। ব্যাপক পর্যালোচনা করে সেখান থেকে অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ১ জনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও ৪ জনকে কমিশনার নিয়োগ করেন। এই ইসি পরবর্তী ৫ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সকল নির্বাচন পরিচালনা করবে।
স্বাধীনতার পর দেশে এবারই প্রথম সংবিধান অনুসারে আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। আইনের আলোকেই সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি এবং এ কমিটি ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নামের তালিকা জমা দেয়। এর আগে ইসি নিয়োগের আইন না থাকলেও সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে দুইবার নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। ২০১২ সালে জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে সার্চ কমিটির মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর ২০১৭ সালে নিয়োগ দেয়া নির্বাচন কমিশনও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। ওই সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুসারে ২০১৭ সালে ৫ বছরের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশন ওই বছর ১৫ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং মেয়াদ শেষে বিগত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেয়।
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য ১০ নাম সুপারিশ করতে ৫ ফেব্রুয়ারি সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ অনুসারে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আপীল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে সভাপতি করে ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে গেজেট প্রকাশ করে।
নতুন নির্বাচন কমিশন রবিবার প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ করেছেন। আজ সোমবার এ কমিশন আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে গিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। কমিশনে গিয়ে প্রথম চেয়ারে বসার দিন থেকে তাদের দায়িত্বকাল পরবর্তী ৫ বছর । তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বিদায় নিলেও কমিশনের কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। ইসি সচিবের নেতৃত্বে কমিশন কর্মকর্তারা রুটিন কাজ সম্পাদিত করেছেন। তবে তারা কোন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। নতুন ইসি দায়িত্ব নিয়ে নীতিনির্ধারণী কাজ শুরু করবেন।
সংবিধানের আলোকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগে আইন করতে ১৭ জানুয়ারি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ এর খসড়া মন্ত্রিসভায় উত্থাপন ও অনুমোদন করা হয়। এ আইন পাসের উদ্দেশে ২৩ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ উত্থাপন করেন। ওইদিনই বিলটি যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট পেশ করার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রেরণ করেন স্পীকার। এর পর ওই কমিটি বিলটি রিপোর্ট আকারে সংসদে উপস্থাপনের পর এর ওপর ১২ জন বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য ছাঁটাই ও সংশোধী প্রস্তাব দেন। এর পর কিছু সংশোধনীসহ ২৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। বিলের শিরোনামেও সামান্য সংশোধন হয়। সংশোধনীসহ বিলটি পাস হয় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ শিরোনামে। ২৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি এ বিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে এটি আইনে পরিণত হয়। ওইদিনই জাতীয় সংসদ থেকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ এর গেজেট প্রকাশ করা হয়।
এদিকে নতুন ইসি নিয়োগের পর দেশে এ পর্যন্ত কারা এ দায়িত্ব পালন করেছেন এ নিয়ে উৎসুক জনতা খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। তথ্যানুসন্ধ্যান করে জানা যায়, কাজী হাবিবুল আউয়াল দেশের ১৩তম সিইসি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই বিচারপতি মোঃ ইদ্রিস ছিলেন দেশের প্রথম সিইসি। কাজী হাবিবুল আউয়ালের আগে কে এম নুরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিইসির দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, ড. এটিএম শামসুল হুদা ২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, বিচারপতি এমএ আজিজ ২০০৫ সালের ২৩ মে থেকে ২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি, এম এ সাইদ ২০০০ সালের ২৩ মে থেকে ২০০৫ সালের ২২ মে, মোহাম্মদ আবু হেনা ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ২০০০ সালের ৮ মে, বিচারপতি একেএম সাদেক ১৯৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল, বিচারপতি মোঃ আব্দুর রউফ ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল, বিচারপতি সুলতান হোসেন খান ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯০ সালের ২৪ ডিসেম্বর, বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মাসুদ ১৯৮৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম ১৯৭৭ সালের ৮ জুলাই থেকে ১৯৮৫ সালেল ১৭ ফেব্রুয়ারি এবং বিচারপতি মোঃ ইদ্রিস ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই থেকে ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই ১৩ জন সিইসির মধ্যে ৭ জন ছিলেন বিচারপতি। আর বর্তমান সিইসিসহ ৬ জন আমলা।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে নির্বাচন কমিশনার হন ৩১ জন। এর মধ্যে এবার ৪ জন এবং আগে বিভিন্ন মেয়াদে ছিলেন ২৭ জন। এবারের ৪ নির্বাচন কমিশনার হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, সাবেক সিনিয়র সচিব মোঃ আলমগীর ও সাবেক সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান। এর আগে মাহবুব তালুকদার, মোঃ রফিকুল ইসলাম, বেগম কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়া মোঃ শাহ নেওয়াজ-১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। এর আগে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোঃ জাবেদ আলী ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মোহাম্মদ আবু হাফিজ ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মোহাম্মদ আবদুল মোবারাক ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম, সাখাওয়াত হোসেন ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২, মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২। তার আগে মোঃ সাইফুল আলম, মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী ২০০৬ সালের ২৭ নবেম্বর থেকে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি, মুহাম্মদ হাসান মনসুর ২০০৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি, এসএম জাকারিয়া, বিচারপতি মাহফুজুর রহমান ২০০৬ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি, এমএম মুনসেফ আলী, একে মোহাম্মদ আলী ২০০১ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে ২০০৬ সালের ১৯ এপ্রিল, শফিউর রহমান ২০০০ সালের ২৫ জুন থেকে ২০০৫ সালের ২৫ জুন, মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী ১৯৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল, আবিদুর রহমান ১৯৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল, বিচারপতি মোঃ আব্দুল জলিল ১৯৯৪ সালের ৭ মে থেকে ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল, বিচারপতি সাইদ মিসবাহ উদ্দিন হোসেন ১৯৯০ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, বিচারপতি আমিন-উর-রহমান খান ১৯৯০সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর, বিচারপতি নাইম উদ্দিন আহমেদ ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ৪ এপ্রিল, বিচারপতি সুলতান হোসেন খান ১৯৮৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ১৯৮৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, আব্দুল মুমিত চৌধুরী ১৯৭৮ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ১৯৮৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং নুর মোহাম্মদ খান ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই থেকে ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।