প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে – প্রধানমন্ত্রী

10
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শাহবাগস্থ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রান্তে যুক্ত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে নির্মিত চিত্রকর্ম (স্ক্রল পেইটিং)-‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: মহাজীবনের পট’ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে তাদের সঠিক ইতিহাস জানানোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেশের সঠিক ইতিহাস জানলে তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত হবে। সেই সঙ্গে স্বার্থপরের মতো নিজেকে ব্যস্ত না রেখে দেশের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কিছু করার একটা আগ্রহের সৃষ্টি হবে, একটা চেতনা আসবে। যেটা আমাদের খুবই দরকার। এতে করে তাদের মেধা, জ্ঞান, শৈল্পিক মন ও মনন বিকশিত হবে। তারা কে কোন ব্রান্ড পরবে বা ধনসম্পত্তির পেছনে কেবল ছুটে বেড়াবে না।
রবিবার জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব মিলনায়তনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ওপর ভিত্তি করে আঁকা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্ক্রল পেইন্টিং ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : মহাজীবনের মহাপট’ শীর্ষক পক্ষকালব্যাপী প্রদর্শনী উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠানে সংযুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।
আক্ষেপ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসলে আমরা অনেক দিবস পালন করি, আবার দেখা যায় সেই দিবসের মাহাত্ম্যটা কি, ইতিহাসটা কি, সেই সঠিক চিত্রটা সব সময় আমাদের নতুন প্রজন্ম জানতে পারে না। এর কারণটা যেটা আমার অনুভূতি, সেটা হলো এই যে, ’৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পর থেকে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে এবং মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কাজেই দেশের সঠিক ইতিহাস প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে আরও নজর দেয়া দরকার।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ’৭৫ এর পর ২১ বছর তরুণ প্রজন্মকে দেশের সঠিক ইতিহাস জানতে দেয়া হয়নি বরং ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। একুশ বছর সেই সময়ে যারা তরুণ ছিল, যুবক ছিল বা শিশু-কিশোর ছিল তারা তো ইতিহাস জানতে পারেনি। তারা যখন বড় হয়েছে, তাদের সংসার হয়েছে বা ছেলে-মেয়ে হয়েছে- তাদের কাছে সেই অনুভূতিগুলো নেই। তারা তাদের বাবা-মা হয়ত সন্তানদের এ বিষয়ে একেবারেই জ্ঞান দেয়নি। আর স্কুল-কলেজের ওপর নির্ভর করে, বন্ধু-বান্ধবের ওপর নির্ভর করে তারা যতটুকু শিখেছে অনেক সময় তারা সঠিকটা বলতেই পারেনি। অনেকেই আশপাশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়পরিজন থেকে পরিপূর্ণ বা সঠিক ইতিহাস জানতে পারেনি। এই বিষয়টাও মনে রেখে সকলের একটু নজর দেয়া দরকার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মহান ২১ ফেব্রুয়ারি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কেন আমরা উদযাপন করি, জাতির পিতার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম, নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড বা ’৭১ এ যেভাবে এদেশে গণহত্যা হয়েছে বা আমাদের সংগ্রাম- সে সময়ে যে সাহস নিয়ে আমাদের নিরস্ত্র বাঙালী অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে- সেই বিজয়ের সঠিক ইতিহাস- এ রকম বহু ঘটনা আমাদের জীবনে রয়েছে, যার সম্বন্ধে আমাদের শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রজন্মের পর প্রজন্মের জানা উচিত।
সরকারপ্রধান বলেন, প্রকৃতি আমাদের এত সুন্দর একটা দেশ দিয়েছে, সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের সকলের মাঝে এই শৈল্পিক চেতনাটা রয়েছে এবং যার বিকাশটা দরকার। এ সময় দেশের শিল্প-সাহিত্যেও পৃষ্ঠপোষকতা তাঁর সরকার যেমন অব্যাহত রাখছে, তেমনি জাতির পিতার কন্যা হিসেবে তিনিও করে যাবেন বলেও উল্লেখ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : মহাজীবনের মহাপট’ শীর্ষক বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই স্ক্রল পেইন্টিংয়ের প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব মিলনায়তনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর বৈচিত্র্যময় ও বহুমাত্রিক জীবন তুলে ধরে এ স্ক্রল পেইন্টিং এঁকেছেন দেশের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশ। ১৫০ ফুট দীর্ঘ স্ক্রল পেইন্টিংটি বাংলাদেশে সম্পাদিত সর্ববৃহৎ পটভূমিতে জাতির পিতার জীবনভিত্তিক চিত্রকর্ম। চিত্রশিল্পীর ভাষায় মাটি থেকে তৈরি বার্নট এ্যাম্বার রং এর মাধ্যমে মাটি থেকে উঠে আসা ইতিহাসের এই মহানায়ককে চিত্রিত করেছেন তিনি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন- জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। স্ক্রল পেইন্টিংটির শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশ অনুষ্ঠানে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন। শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, প্রদর্শনীর আয়োজন সহযোগী বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘মাত্রা’র পক্ষ থেকে ম্যানেজিং পার্টনার শিল্পী আফজাল হোসেন, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের সভাপতি শিল্পী জামাল আহমেদও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে মুজিববর্ষের থিম সংগ এবং স্ক্রল পেইন্টিংয়ের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি পরিবেশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আমাদের বাংলাদেশের সংগ্রাম থেকে অর্জনের যে ইতিহাস তা ফুটে উঠেছে। শুধু বর্ণমালা পড়েই নয় শিল্পীর তুলিতেও মানুষ সেটা দেখতে এবং উপলব্ধি করতে পারবে, জানতে ও শিখতে পারবে। তিনি বলেন, আমাদের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক যে যেখানে আছেন তারা আপনাদের কাজ করে যাচ্ছেন, আপনারা তা করে যাবেন।
তিনি বলেন, অন্তত আমি এটুকু বলতে পারি যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, জাতির পিতার কন্যা হিসেবে দেশের মানুষের কল্যাণে যা যা কাজ করার সেটা যেমন করে যাব। আবার বাঙালী হিসেবে আমাদের যে শিল্প,সাহিত্য বা সংস্কৃতির চর্চাটা যেন অব্যাহত থাকে সেজন্য যতটুকু সহযোগিতার দরকার, অবশ্যই আমি করব। প্রধানমন্ত্রী থাকলে সহযোগিতার সুবিধাটা বেশি, তবে সবসময় আমার কাছ থেকে এই সহযোগিতাটা তাঁরা পাবেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখনীর মধ্যদিয়ে তাঁদের তুলির আঁচড়ে, কবিতার মাধ্যমে,গানের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটিকে চিরভাস্বর করে রেখেছেন। সেজন্য ষড়যন্ত্রকারীরা চাইলেও এই নামটি মুছতে পারেনি। এজন্য সকলকে তিনি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
ইতিহাসকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা হিসেবে তাঁর সরকারের আসার আগে ২১টি বছর কোথাও জাতির পিতার ছবি থাকলে তা তখনকার একমাত্র সরকারী সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিতে প্রচারের সময় কাগজ বা অভিনব কৌশলে আড়াল করেও প্রচারের অপচেষ্টা হয় বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সত্যকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না বলেই আজ সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : মহাজীবনের মহাপট’ এই স্ক্রল পেইন্টিংয়ের জন্য শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। এই শিল্পকর্মটি জাতির পিতার জন্মস্থল টুঙ্গিপাড়া, জাতির পিতার স্মৃতি জাদুঘরে অনলাইন প্রদর্শনী এবং সমগ্র বাংলাদেশে ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য প্রদর্শনের উদ্যোগ তাঁর সরকার নেবে বলেও জানান।
তিনি বলেন, এটা করা খুব কঠিন কাজ নয়। কারণ ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ থেকে ‘সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা’ এই কর্মসূচিটি বাংলাদেশব্যাপী আমরা করতাম। করোনার জন্য সেটি অনেক জায়গায় বন্ধ হয়ে গেলেও সেরকম একটি আয়োজনের চিন্তা তাঁর সরকারের রয়েছে। সরকারে না থাকলে ট্রাস্টের পক্ষ থেকেও এটি করা সম্ভব বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকায় দেশের অনেক উন্নতি তাঁর সরকার করেছে উল্লেখ করে টানা তিনবারের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশের অনেক উন্নতি করেছি। জীবনটা অনেক পাল্টে গেছে মানুষের। মানুষের সেই হতদারিদ্র্যতা অনেক কমে গেছে, দারিদ্র্যের হার কমাতে পেরেছি। এই সময়ে মানুষের জীবনমান পাল্টেছে, হতদারিদ্র্যতা কমেছে, শিক্ষাদীক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে, উন্নতির ছোঁয়া গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ শিক্ষাদীক্ষা পাচ্ছে বা ভাল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে, চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে। গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত উন্নতি হচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমি মনে করি আমাদের এই যে অর্জনগুলো, এই অর্জনের পেছনে যে ত্যাগ-তিতীক্ষা, এই অর্জনের পেছনে অবদান যাদের, তাও সকলের জানা দরকার। আজকে নিজের ভাষায় কথা বলতে পারা, নিজের একটা রাষ্ট্র, একটা আলাদা জাতিসত্তা আমাদের রয়েছে। এই জিনিসগুলো কিন্তু এই দেশের মানুষকে জানান উচিত।