ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেন যাত্রা, মূর্তিমান আতঙ্ক পাথর নিক্ষেপ

17

কাজিরবাজার ডেস্ক :
চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ছাত্রী তামান্না তন্নী। আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ওই শিক্ষার্থী এখন গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় ট্রেনটি বোয়ালমারী স্টেশন অতিক্রম করার কিছুক্ষণ পর দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথর আঘাত করে শিক্ষার্থীর মাথায়। রাজশাহী থেকে গোপালগঞ্জে আসছিলেন আহত শিক্ষার্থী তামান্না তন্নী। বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি (বিএমবি) বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মনিরুল ইসলাম উজ্জ্বল বলেন, ফরিদপুরের বোয়ালমারী রেলওয়ে স্টেশন পার হওয়ার পর হঠাৎ মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে ওঠে তামান্না। চিৎকার শুনে তার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে দেখি প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে ট্রেনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাম্বুলেন্সে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয় তামান্নাকে।
গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ শাহারিয়ার খান বলেন, রোগীর মাথার ডান পাশে আঘাত পেয়েছেন এবং ফুলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও আইন অনুষদের ডিন ড. মোঃ রাজিউর রহমান বলেছেন, আহত শিক্ষার্থীর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে তামান্না তন্নীর গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় দুর্বৃত্তদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
চলন্ত ট্রেনের যাত্রীদের জন্য এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ‘পাথর নিক্ষেপ’। কিন্তু এই পাথর নিক্ষেপ ঠেকানোর পথ খুঁজে পাচ্ছে না রেলওয়ে। সেপ্টেম্বর মাসেই চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় একজন ছাত্রী, একজন শিক্ষক, একজন সহকারী ট্রেন চালক গুরুতর আহত হয়েছেন। দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় ট্রেন যাত্রীদের হতাহত হওয়ার ঘটনায় ট্রেন ভ্রমণ ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভয়ভীতিতে ট্রেন ভ্রমণের তিক্ত অভিজ্ঞতার উদাহরণ অসংখ্য।
প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাবে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের নির্মমতায় যাত্রীদের জীবন বিপন্ন। সারাদেশের ২০ জেলার ৭০টি স্পটকে পাথর নিক্ষেপের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। গত ৫ বছরে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজারের বেশি। এর মধ্যে গত এক বছরে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ৭৪টি। ট্রেন যাত্রীরা তো হতাহত হচ্ছেনই, এমনকি ট্রেনের চালক, সহকারী চালকসহ স্টাফরাও আহত হচ্ছেন। পাথর নিক্ষেপে জানালা ভাঙচুরসহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ট্রেনের কোটি কোটি টাকার সম্পদও। করোনার মধ্যে লকডাউনের কারণে ট্রেন বন্ধ ছিল, তা না হলে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় হামলার সংখ্যা আরও বেশি হতো। এখন ট্রেন চলাচল শুরু করায় যাত্রীদের জীবনের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পাথর নিক্ষেপ।
চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এমনকি অনেক যাত্রীর অঙ্গহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। পাথর নিক্ষেপে প্রতি বছর রেলওয়ের ক্ষতি হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। পাথরের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দরজা-জানালাসহ অন্যান্য সামগ্রী মেরামত করতে রেলওয়ের বছরে পৌনে ২ কোটি টাকা খরচ হয়। পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় বিগত বছরগুলোতে আহতের তালিকায় রয়েছেন রেলওয়ের ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।
সারাদেশের ২০টি জেলায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলা রয়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ স্পট হিসাবে ৭০টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এসব স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ছাড়াও যত্রতত্রই চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বিধানের অভাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রীতিমতো বিপাকে আছেন। নিরাপদ আরামদায়ক ট্রেন ভ্রমণ রীতিমতো ভীতিকর আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে।
রেলমন্ত্রী মোঃ নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ১১০টি। এতে ট্রেনের জানালা ভেঙ্গেছে ১০৩টি। আহত হয়েছেন ২৯ জন। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপপ্রবণ এলাকা হিসেবে পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার ১৫টি স্থান ও পূর্বাঞ্চলের ৪ জেলার ৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনার অপরাধে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, এমনকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, উপরন্তু পাথর মারার দায়ে কারও মৃত্যু হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু এ পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় মামলা হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই শিশু, টোকাই, ভবঘুরে অথবা মানসিক বিকারগ্রস্ত। ফলে কাউকে সাজা দেয়া হয়নি। পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় সচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগের কথা জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী।
সেপ্টেম্বর মাসেই চলন্ত ট্রেনে ভয়াবহ অন্তত তিনটি পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন ট্রেন যাত্রীরা। ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ছাত্রী তামান্না তন্নী চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ছাড়াও একই দিনে গফরগাঁওয়ে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে গুরুতর আহত হয়েছেন আরেক জন। তার নাম আনোয়ার হোসেন (৫৬)। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে গফরগাঁও স্টেশনের আউটার সিগন্যাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত আনোয়ার জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলার সাতপোয়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি সরিষাবাড়ি আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের হিসাবরক্ষক পদে কর্মরত।
গফরগাঁও জিআরপির ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহাদাত হোসেন বলেছেন, ‘ঢাকা থেকে জামালপুরগামী যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন স্টেশনের আউটার সিগনাল এলাকায় ধীরগতিতে যাচ্ছিল। এ সময় বস্তি এলাকা থেকে কেউ পাথর নিক্ষেপ করে। পাথরটি ট্রেনের যাত্রী আনোয়ার হোসেন নামে একজনের কপালে লেগে সামান্য কেটে যায়। খবর পেয়ে দ্রুত ওই এলাকায় অভিযান চালানো হয়। তবে এখনও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, কোন শিশু হয়তো পাথর নিক্ষেপ করতে পারে। তবে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে। সেজন্য আমরা স্টেশন এলাকায় নিয়মিত অভিযান চালাব।
সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখ বিকাল প্রায় ৫টা ৪০ মিনিটে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকা অভিমুখী আন্তঃনগর কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের পাথর নিক্ষেপে আহত হয়েছেন সহকারী ট্রেন চালক কাওসার আহমেদ (৩০)। এ ঘটনায় ইঞ্জিনের একটি গ্যাস চেম্বার ভেঙ্গে যায়। ট্রেনটি ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনে আসার পর খবর পেয়ে কর্তৃপক্ষ তাকে ইঞ্জিন থেকে নামিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করে। ভৈরব স্টেশনের আউটার সিগন্যাল লক্ষ্মীপুর লেভেল ক্রসিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
আহত কাউসার আহমেদ বলেন, ‘ট্রেনটি লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় কে বা কারা ইঞ্জিন লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারলে ইঞ্জিনের গ্যাস চেম্বার ভেদ করে’ তা আমার কপালে লাগে। এতে আমার চোখে মারাত্মক আঘাত লাগে। আমি কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিলাম না।
ভৈরব রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌউস আহমেদ জানিয়েছেন, ঢাকাগামী আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি গত ৩ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টার দিকে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশ ছেড়ে আসে। সন্ধ্যা ৫টা ৪০ মিনিটে ট্রেনটি ভৈরব আউটার সিগন্যাল এলাকায় পৌঁছালে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা ট্রেনের ইঞ্জিন লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারে।
পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় হতাহতের উদাহরণ অনেক : গত ১৫ আগস্ট নীলফামারীর সৈয়দপুরে ট্রেনে ছোড়া পাথরের আঘাতে আজমির ইসলাম নামে পাঁচ বছরের এক শিশু চোখ হারাতে বসেছে। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে সৈয়দপুর রেলস্টেশনের মাস্টার ময়নুল হোসেন বাদী হয়ে রেলওয়ে থানায় মামলা করেছেন। কিন্তু অন্য ঘটনাগুলোতে মামলা করার নজির কম। যদিও এ ধরনের হামলার ঘটনায় কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। পাথর নিক্ষেপের ফলে এভাবে যাত্রীদের পাশাপাশি ট্রেনের চালকসহ দায়িত্বরত অন্যদের জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০১৯ সালের ৫ মে রাতে সিরাজগঞ্জের জামতৈল ও মনসুর আলী স্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে পদ্মা আন্তঃনগর ট্রেনে পাথর হামলায় জিসান নামে চার বছরের এক শিশু গুরুতর আহত হয়। তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। জিসান যখন এই হাসপাতালে ভর্তি হয়, তখন জুঁথি (১২) নামে আরেক শিশু পাথর হামলায় আহত হয়ে ভর্তি ছিল। ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল খুলনা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন রেলওয়ের পরিদর্শক বায়েজিদ হোসেন। পাথর নিক্ষেপের পর তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ৪১ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তার মৃত্যু হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনে কর্তব্যরত গার্ড নাজমুল ইসলাম সোলেমান গুরুতর আহত হন। গত ৩০ এপ্রিল খুলনা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিদর্শক বায়োজিদ শিকদার। বেনাপোল থেকে খুলনা যাওয়ার পথে দৌলতপুর স্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তরা ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে। এতে আহত হন বায়োজিদ শিকদার। পরে তাকে এয়ার এ্যাম্বুল্যান্সে ঢাকায় এনে একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুদিন পর তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪১ দিন পর ১২ জুন বায়োজিদ মারা যান। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে চার জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ২০১৭ সালের ১ অক্টোবর রাজশাহী থেকে খুলনাগামী সাগরদাঁড়ি ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও অজ্ঞাত আরেক যুুবক।
২০১৬ সালের ২৭ মার্চ ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য ছেড়ে যাওয়া সুবর্ণ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তরা পাথর ছুড়ে মারে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ট্রেনটি যখন ফেনী স্টেশন অতিক্রম করে যায় তখনই এ ঘটনা ঘটে। এতে সরওয়ার জামান শাওন (২৭) নামের এক যাত্রী রক্তাক্ত হন। ওই সময় ট্রেনে ফাস্ট এইডের ব্যবস্থা ছিল না। তাই রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি। শাওন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরমা ইউনিয়নের কশুয়া গ্রামের মৃত মোহাম্মদ সৈয়দের ছেলে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরের আঘাতে গুরুতর আহত হন ট্রেনের গার্ড আবদুল কাইয়ুম। ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট চলন্ত ট্রেনে পাথরের আঘাতে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ প্রাণ হারান। চলতি বছরের ২ এপ্রিল কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি ট্রেনে পাথরের আঘাত লেগে আহত হন বোয়ালখালী পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী। পাথরের আঘাতে তার চোখের উপরের অংশ ফেটে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে ট্রেনটি চট্টগ্রাম পৌঁছালে তার চিকিৎসা করানো হয়।
পথ খুঁজে পাচ্ছে না রেলওয়ে : দেশে চলন্ত ট্রেনে প্রায়শই পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটছে, ফলে আহত হচ্ছেন যাত্রীরা। এমনকি জানালা বন্ধ রেখেও রেহাই পান না যাত্রীরা- এসব ক্ষেত্রে ছুড়ে দেয়া পাথরের কারণে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে আহত হন যাত্রীরা। এ রকম পাথর ছোড়ার ঘটনায় যাত্রীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। ২০১৩ সালে চলন্ত ট্রেনে ছোড়া ঢিলে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ নিহত হওয়ার পর রেলওয়ের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সদস্য রেলওয়ে কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, দুষ্কৃতকারীরা ইচ্ছা করে ট্রেনে ঢিল ছুড়ে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে। ওই ঘটনায় দুই কিশোরকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
কারা ট্রেনে ঢিল ছোড়ে : এটা যে শুধু অপরিণত শিশুরাই করে তা নয়, বরং অনেকে ডাকাতি ও ট্রেনের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে এই কাজ করে। বর্তমানে রেলওয়েতে অনেক কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন রুটে নতুন নতুন ট্রেন চালু করা হচ্ছে। কাজেই ঢিল ছোড়ার বিষয়টি স্বার্থান্বেষী মহলের কোন ষড়যন্ত্র কি-না, তা চিহ্নিত করার পাশাপাশি কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা দরকার। তবে সমস্যা হলো কারা এই ঢিল ছুড়ছে, তাদের শনাক্ত করা। কারণ বেশিরভাগ ঘটনা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বা রাতের অন্ধকারে ঘটছে। ফলে যেসব স্থান দিয়ে ট্রেন চলাচল করে, সেখানকার জনপ্রতিনিধি এবং বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে এর বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির চেষ্টার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন রেল কর্মকর্তারা।
রেলওয়ে আইনে কী আছে : রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারা অনুযায়ী ট্রেনে পাথর ছোড়া হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। তবে পাথর নিক্ষেপে কারো মৃত্যু হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যদিও এসব আইনে কারো শাস্তির কোন নজির নেই বলেই জানাচ্ছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ : জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ট্রেনে যখন ভ্রমণ করছিলেন, তখন তাতে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা ঢিল ছুড়েছিল, ফলে ট্রেনটি জানালার কাঁচ ভেঙ্গে যায়। স্পীকার অবশ্য ওই ঘটনায় নিরাপদেই ছিলেন। ফলে ওই পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পর্যন্ত দিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী। রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেছেন, দুষ্কৃতকারীরা চলন্ত ট্রেনে ঢিল মেরে নিরাপদ বাহনকে অনিরাপদ করে তুলছে। এতে ট্রেনের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি মানুষের জীবনও বিপন্ন হচ্ছে। জীবন বিপন্নকারী এ ধরনের দৃষ্কৃতকারীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের জন্য আহ্বান জানান রেলপথমন্ত্রী।
দেশের যেসব জেলায় বেশি ঘটনা ঘটছে : সারাদেশে দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। দেশের ২০ জেলার ৭০টি স্থানকে পাথর নিক্ষেপের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ২০ জেলার ওপর দিয়ে চলার সময়ই ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলায়। পাথর ছোড়ার বেশি ঘটনা ঘটছে গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর, কুমিল্লার ময়নামতি ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলি থেকে সীতাকুন্ড অংশে। এছাড়া নরসিংদী, পুবাইল, গফরগাঁও, গৌরিপুর, মোহনগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, তেজগাঁও, কাওরানবাজার, ফতুল্লা, লালমনিরহাট, পীরগঞ্জ, গাইবান্ধা, বুনারপাতা, সোনাতলা, আজিমনগর, খুলনা, পার্বতীপুর, জামতৈল কোট চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, দৌলতপুর, রংপুর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ষোলশহর, ফৌজদারহাট, সীতাকুন্ড, চৌমুহনী, কুমিল্লার শশীদল, ইমামবাড়ি, কসবা, পাঘাচং, ভাতশালা, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কাউনিয়া, বামনডাঙ্গা এলাকায়।
রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরও রেহাই পাচ্ছেন না : রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, পাথর নিক্ষেপ একটি বড় ধরনের অপরাধ। এর কারণে মানুষ মারাও যাচ্ছে। তাই এই অপরাধ বন্ধে আমরা কাজ করছি। ঘটনাপ্রবণ এলাকায় মানুষকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। পাথর নিক্ষেপের কারণে যে শুধু যাত্রীরা আহত-নিহত হচ্ছেন এমন নয়, সরকারী মালামালের ক্ষয়ক্ষতিসহ কর্মচারীরাও হতাহত হচ্ছেন। গত এক বছরে ৭৪টি পাথর হামলার ঘটনায় ৬৩টি ট্রেনের দরজা-জানালার কাচ ভেঙ্গেছে। আহত হয়েছেন ২০ জন। এর মধ্যে দুজন চালক ও একজন সহকারী চালকও ছিলেন। এছাড়া দুজন গার্ড, একজন সহকারীও আহত হয়েছেন। অন্যরা শিশুসহ নানা বয়সের যাত্রী। পাথর নিক্ষেপের কারণে ট্রেনে এখন যাত্রীরা জানালার পাশে বসতেই ভয় পান।
সচেতনতা তৈরি : অনেক সময় ভবঘুরে ও রেললাইনের আশপাশে মাদকাসক্তরা ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে। স্টপেজ ছাড়া গাড়ি থামানোর জন্যও দুর্বৃত্তরা এই কাজ করে থাকে। এর বাইরে সরকারী মালামাল নষ্ট করার মনমানসিকতা ও মাদক বা চোরাচালান পণ্য কিছু চিহ্নিত স্থানে নামাতে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটতে পারে। শিশু-কিশোরেরা ট্রেন যাওয়ার আগে লাইনে কান পেতে শোনে। এতে তারা বুঝতে পারে ট্রেন আসছে। তখন রেললাইন থেকে পাথর নিয়ে তারা প্রস্তুত থাকে। কে কোন বগিতে মারবে, কে কাঁচ ভাঙবে, কে ইঞ্জিনে মারবে এসব প্রতিযোগিতা করে। এটা তারা খেলা মনে করে। এজন্য যাত্রী ও রেলের চালক-সহকারীদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। যেহেতু শিশু-কিশোরেরা কাজটি করে, তাই আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার চেয়ে সচেতনতায় জোর দেয়া হচ্ছে। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ না করার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরিতে লিফলেট তৈরি করে বিতরণ, রেললাইনের পাশের মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়ে কাজ করা, আরএনবি ও জিআরপি পুলিশকে আরও সতর্ক করা, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সভা করা, পাশাপাশি ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে এর কুফল সম্পর্কে শিশুদের অবগত করার ব্যবস্থা করতে হবে।