আসছে বাজেটে বিলাসী পণ্যের দাম বাড়লেও কমবে নিত্যপণ্যের

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহামারী করোনাভাইরাসে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় আগামী অর্থবছরের জন্য কর ও ভ্যাট ছাড়ের বিশাল বাজেট দেয়া হবে। বাজেটে করের বোঝা না বাড়ায় স্বস্তি পাবেন ব্যবসায়ী ও সাধারণ আয়ের মানুষ। কর দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা যেসব সমস্যায় পড়তেন, সেক্ষেত্রেও ব্যবসাবান্ধব কিছু পদক্ষেপ আসছে। ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি হয়রানিমুক্ত থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ভাষায় ‘করোনাকালে ব্যবসাবান্ধব বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার।’ তবে যে ব্যক্তির যতবেশি সম্পদ তিনি ততবেশি কর প্রদান করবেন। এজন্য আসন্ন বাজেটে সম্পদশালীদের সারচার্জ (সম্পদ কর) আরও বাড়ানো হবে। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি সুরক্ষায় সরকারী অর্থ সাশ্রয়ে আগামী বাজেটে বিলাসী ব্যয় পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করা হবে। দাম বাড়বে বিলাসী পণ্যের, তবে কমবে ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের।
জানা গেছে, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের কবল থেকে জীবন বাঁচাতে জীবন ও জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে টাকার অঙ্কে রেকর্ড বিশাল এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। যা আগামী ৩ জুন বৃহস্পতিবার মহান সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বড় ব্যয়ের এই বাজেটে অর্থ সংস্থানে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং বিদেশী ঋণ ও অনুদানের ওপর। এবারই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার বিদেশী ঋণ নেয়া হবে বাজেট বাস্তবায়নে। এছাড়া কর আদায় বাড়াতে সক্ষম ব্যক্তিদের করনেটের আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গত এক বছর ধরে চাপের মুখে পড়েছে এনবিআরের রাজস্ব আদায়। এরপরও অর্থনীতি সচল রাখতে এবারও কর ছাড় দিয়ে ব্যবসাবান্ধব বাজেট ঘোষণা করা হবে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠান সচল রেখে উৎপাদন ও রফতানি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বিনিয়োগকারীদের নীতিগত সহায়তা দেয়া হবে। নতুন করে কোনখাতে ভ্যাট ও কর আরোপ করা হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বাজেট সংক্রান্ত বৈঠক শেষে জানান, আগামী বাজেট হচ্ছে ব্যবসাবান্ধব বাজেট। করোনায় সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে বড় চাপ তৈরি হলেও বাংলাদেশ দ্রুত প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ও তা বাস্তবায়ন করায় সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। করোনার দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় ধাক্কা যাতে সামলানো যায় সেভাবেই আগামী বাজেট দেয়া হবে। মহামারী করোনার ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
কর ও ভ্যাট ছাড়ের বাজেট ॥ ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করতে কর ও ভ্যাট ছাড় দিয়ে আগামী বাজেট ঘোষণা করা হবে। অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য বিশেষ করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হার কমলেও বাড়বে গাড়ির মতো বিলাসী পণ্যের। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সব ধরনের সিগারেট, বিড়ি ও জর্দার মতো পণ্যের দাম বাড়বে। দামী কসমেটিক্স পণ্য আমদানিতে শুল্কহার বাড়লেও কমবে সব ধরনের ভোগ্যপণ্য বিশেষ করে চাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেলের মতো পণ্যের। এছাড়া ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ও ভ্যাট ছাড় পাবেন। আমদানি পর্যায়ে আগাম আয়কর (এআইটি) হার কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বর্তমানে ২ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত আগাম আয়কর দিতে হয়, যা কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এ হার কমিয়ে ১ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারে এনবিআর। আমদানি পর্যায়ে আগাম কর (এটি) ও ভ্যাট কমতে পারে। কাঁচামাল আমদানিতে বর্তমানে ৪ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এ হার ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। এতে ব্যবসায়ীদের কাছে নগদ অর্থের পরিমাণ বাড়বে।
অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, সরবরাহ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হতে পারে। এ সুবিধা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয়, উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেয়া হতে পারে। বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের পক্ষ থেকেও করপোরেট কর কমানোর দাবি রয়েছে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির কর ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ২৫ শতাংশ। তবে ব্যাংক, বীমা, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ও তামাকজাত পণ্যেও কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট কর হার অপরিবর্তিত রাখা হতে পারে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির করমুক্ত লভ্যাংশের সীমাও বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির লাভের ৫০ হাজার টাকা করমুক্ত। সারাবিশ্বই করোনার সময়ে করপোরেট করে কিছু ছাড় দিয়েছে। ব্যক্তি শ্রেণীর আয়কর অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা। নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের বেলায় এ সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা। প্রতিবন্ধী করদাতাদের ৪ লাখ ৫০ হাজার এবং মুক্তিযোদ্ধা করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। সবার ক্ষেত্রে এ সীমা অপরিবর্তিত থাকছে। তবে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাড়ানোর উদ্যোগ থাকবে। সব টিআইএনধারীর রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে চায় এনবিআর।
এছাড়া আগামী অর্থবছরেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। শেয়ার বাজার চাঙ্গা করার পরিকল্পনা রয়েছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে এ খাতে। ভ্যাট, উৎসে কর ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের চলতি পুঁজির ঘাটতি কমাতে বিভিন্ন পর্যায়ে উৎসে কর কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ভ্যাটমুক্ত সীমা ৫০ লাখ টাকা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তবে কর সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য সরকার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় জোর দেবে। আগামী অর্থবছর থেকে ভ্যাট রিটার্ন অনলাইনে দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা হবে। যারা অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন না, তাদের জরিমানা গুনতে হবে। ই- পেমেন্ট ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে। ভ্যাটের আওতা বাড়াতে ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসের (ইএফডি) ব্যবহার বাড়ানো হবে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান জনকণ্ঠকে বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হার আরও কমানো দরকার। এতে অনেকেই তালিকাভুক্ত হওয়ায় আগ্রহী হবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানির স্বচ্ছতা বাড়ে। আর আমদানির ক্ষেত্রে আগাম আয়কর কমানো যেতে পারে। এতে ব্যবসায়ীদের হাতে নগদ টাকা বেশি থাকবে। তবে মনে রাখতে হবে, আগাম আয়কর নেয়া হয় কর ফাঁকি বন্ধের জন্য। এ ধরনের সুবিধা দেয়া হলে কর ফাঁকি বন্ধেরও উদ্যোগ থাকতে হবে।
সম্পদশালীরা বেশি কর দিবেন ॥ যার যত বেশি সম্পদ তিনি তত বেশি কর প্রদান করবেন। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এই নীতি অবলম্বন করা হবে। এজন্য সম্পদশালীদের সম্পদ কর বা সারচার্জ বাড়ছে আগামী বাজেটে। ন্যূনতম সারচার্জ বাতিল করে স্ল্যাব পুনর্গঠন করা হবে। এছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের বার্ষিক লেনদেনে ব্যাপক কর ছাড় আসছে। বর্তমানে সারচার্জের সাতটি স্তর আছে। নিট সম্পদের মূল্যমান ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে সারচার্জ দিতে হয় না। তবে সম্পদের মূল্যমান ৩ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা হলে বা একাধিক মোটরগাড়ি থাকলে বা যে কোন সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮ হাজার বর্গফুটের বেশি গৃহসম্পত্তি থাকলে ১০ শতাংশ কর বা ৩ হাজার টাকা ন্যূনতম সারচার্জ দিতে হয়। চলতি বাজেটে সম্পদশালীদের ওপর যেসব খাতে উচ্চ অঙ্কের রাজস্ব ধার্য আছে তার বেশিরভাগই আগামীবারেও বহাল রাখা হবে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে উচ্চহারের কর কমানো বা মওকুফের জোরালো দাবি করা হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে বাড়ানো হচ্ছে। হিসাবমতো রাজস্ব আদায়েও কঠোরতা আনা হচ্ছে। বছরে ১০০ কোটি টাকা বা এর বেশি ব্যবসায়িক লেনদেন হয়েছে-এমন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং লেনদেনের সঙ্গে আমদানি-রফতানি, ভ্যাট পরিশোধের তথ্য মিলিয়ে দেখতে আসছে বাজেটে নতুন সফটওয়্যার বিআইএস (বিজনেস ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার) ব্যবহারের নির্দেশ থাকবে। অডিটের তথ্য খতিয়ে দেখতেও প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হবে।
আগামী অর্থবছওে কোন ব্যক্তির তিন কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত নিট সম্পদ থাকলে বা নিজ নামে সমান মূল্যের একাধিক মোটরগাড়ি থাকলে বা কোন সিটি করপোরেশন এলাকায় আট হাজার বর্গফুটের অধিক আয়তনের গৃহসম্পদ থাকলে নিয়মিত করের বাইরে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ হারে বা ন্যূনতম সারচার্জ তিন কোটি টাকা প্রদান করতে হবে। একইভাবে ধনী ব্যক্তির নিট সম্পদ পাঁচ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে থাকলে নিয়মিত করের বাইরে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ হারে, ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকার মধ্যে নিট সম্পদ থাকলে ২০ শতাংশ হারে বা নগদ পাঁচ কোটি টাকা, ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকার মধ্যে হলে ২৫ শতাংশ এবং ২০ কোটি টাকা থেকে বেশি হলে ৩০ শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হবে বলে জানা গেছে। চলতি বাজেটেও সারচার্জের একই হার ধার্য রয়েছে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, করোনার কারণে অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যেন বাস্তবসম্মত হয়। স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত যেসব সরঞ্জাম রয়েছে, সেসব আমদানিতে কর পরিহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।