সীমান্ত বন্ধ থাকলেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সংক্রমণ

14

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত বন্ধের মেয়াদ আরও আট দিন বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। ফলে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত সীমান্ত বন্ধ থাকবে। সীমান্ত বন্ধের পরও ভারত সীমানার কাছাকাছি জেলাগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ইতোমধ্যে করোনার হটস্পট হয়ে উঠেছে। এছাড়া বেনাপোল বন্দরসংলগ্ন যশোরসহ খুলনা বিভাগের বেশকিছু জেলায় এই ধাপে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়েছে। আশঙ্কার কথা হলো বেশকিছু স্থানে ভারতীয় ধরন শনাক্তের ঘটনা ঘটেছে। সীমান্তঘেঁষা এই জেলাগুলোই এখন করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে নতুন হটস্পট হয়ে উঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ঈদে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়া ও তাদের ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
গত ২৬ এপ্রিল থেকে করোনার ভারতীয় ধরন প্রতিরোধে দেশটির সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে ভারতে অবস্থান করা যেসব বাংলাদেশীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে তাদের করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ সনদ দেখিয়ে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। তাদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার দরুন কোয়ারেন্টাইনের স্থান সংকুলান না হওয়ায় দেশের অন্যান্য সীমান্তের বন্দরও খুলে দেয়া হয়। এর মধ্যে অনেকেরই কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালীন আবার কারও বাড়ি ফেরার পর করোনা আক্রান্তের ঘটনা ঘটে। এভাবেই দেশে ভারতীয় ধরন শনাক্তের ঘটনা ঘটে। তবে এখন পর্যন্ত ঠিক কতটা ছড়িয়েছে সেটি খতিয়ে দেখতে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
গত ৫ এপ্রিল থেকে সরকার লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিলেও এক শ্রেণীর মানুষ শুরু থেকেই উদাসীনতা দেখিয়ে আসছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঈদকে কেন্দ্র করে সংক্রমণ বাড়তে পারে এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করার পরও জনমনে সচেতনতার অভাব দেখা গেছে। ভারতীয় ধরনের কারণে করোনা পরিস্থিতির বিস্ফোরণ ঘটারও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তাই তিনি ঈদে গ্রামমুখী মানুষকে রাজধানী না ছাড়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপের পক্ষেও মত দেন। সেই সঙ্গে ভারত বাংলাদেশ যাতায়াতকারী ট্রাকের চালক ও হেলপারদের নিয়মিত করোনা পরীক্ষার তাগিদ দিয়েছিলেন।
এদিকে সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, ভারতের পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ ৩১ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যেই আবার পর্যালোচনা বৈঠকে বসব। এখন পর্যন্ত ছয়টি বন্দর দিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশী প্রবেশ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ জনের মতো দেশে ফিরছেন।
করোনার নতুন হটস্পট চাঁপাইনবাবগঞ্জ : ভারত সীমান্তঘেঁষা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা করোনার হটস্পট হয়ে উঠেছে। দেশের পশ্চিমের এই ছোট জেলার তিন দিক ঘিরে ভারতীয় সীমান্ত। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েকদিনে এই জেলায় করোনা আক্রান্তের গড় হার ৬০ থেকে ৭৮ ভাগের মধ্যে ওঠানামা করছে। দেশের অন্য জেলাগুলোর তুলনায় এই হার এখন সর্বোচ্চ। ঈদের দুদিন পর থেকেই সংক্রমণের হার এক লাফে বেড়ে গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, চলাচল নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক অবহেলা ও সীমান্ত পথে অবৈধভাবে চলাচল বন্ধ না হওয়ায় ভারতীয় ধরন এই জেলায় ঢুকেছে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবা? পর্যন্ত রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মোট ১৩৮ জন করোনা রোগীর মধ্যে ৮৮ জনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের। অন্যদিকে এই হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা ১৪ জনের মধ্যে ৯ জনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এদের মধ্যে আটজনের দেহে করোনার ভারতীয় ধরনের উপস্থিতি প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া এই জেলার ১৮৮ জন হাসপাতালে ও অন্যান্য স্থানে কোয়ারেন্টাইনে আছেন। তিনি বলেন, এটা খুবই শঙ্কার বিষয় যে ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়লে পুরো রাজশাহী অঞ্চলে করোনা প্রতিরোধ করা কঠিন হবে।
এদিকে ভারতীয় ধরনে আক্রান্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আট করোনা রোগীর নমুনা বিশ্লেষণ হচ্ছে আইসিডিডিআরবিতে। শীঘ্রই ফল পাওয়া যাবে। তখন বোঝা যাবে ভারতীয় এ ধরন কতটা বিধ্বংসী। এই আটজনই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের শারীরিক পরিস্থিতির ওপর বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। শুক্রবার পর্যন্ত তাদের শারীরিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য মতে, গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী মেডিক্যাল ল্যাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১১৮টি নমুনা পরীক্ষার পর ৫৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এছাড়া ঢাকায় পাঠানো ১৭টি নমুনার মধ্যে এই জেলার আরও আটজনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মোট ২১৬ জন করোনা রোগী রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা সদরের আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
অন্যদিকে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় জেলা প্রশাসন জরুরী সভা করেছে। সংক্রমণ রোধে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো হলো : স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে অধিক সংখ্যায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ও নমুনা পরীক্ষার হার বাড়ানো। এজন্য একাধিক জরুরী মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় করোনার প্রকোপ ছড়িয়েছে সেসব এলাকার অধিকাংশ মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাঃ জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, ঈদের সময় যারা ঢাকা থেকে এসেছেন তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। এদের অধিকাংশই শিবগঞ্জের জালমাছমারী, নয়ালাভাঙ্গাসহ আশপাশের এলাকার। কোন কোন পরিবারের সবাই আক্রান্ত হয়েছেন। এটাই স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। তিনি স্বীকার করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখন দেশের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরও এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে কিছু মানুষের নমুনায় ভারতীয় ধরন পাওয়ায়। এখন আমরা খুঁজছি কীভাবে তারা ভারতীয় ধরনে সংক্রমিত হলেন।
এদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে খুলনা বিভাগে বৃহস্পতিবারে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনায় সংক্রমিত ১২৮ জন শনাক্ত হয়েছেন। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানা গেছে, মারা যাওয়া ৯ জনের মধ্যে আছেন খুলনায় ৪, বাগেরহাটে ২ এবং যশোর, নড়াইল ও চুয়াডাঙ্গায় ১ জন করে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা সংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, গত দেড় মাসে বিভাগে ১২৪ জন করোনায় মারা গেছেন।
বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসাধীন আছেন ১ হাজার ৫৯৪ জন। আর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬০ জন। এর মধ্যে খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪৬ জন, যাদের ৭ জন আছেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)।