পহেলা বৈশাখ আজ

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ওই বুঝি কালবৈশাখী/ সন্ধ্যা-আকাশ দেয় ঢাকি…। হ্যাঁ, এবার বৈশাখেই কালবৈশাখীর ভয়। জরাগ্রস্ত পৃথিবী। বাংলাদেশও শঙ্কায়। এ অবস্থায় যেন নতুন স্বপ্ন নিয়ে এসেছে বাংলা নববর্ষ। আজ মঙ্গলবার ১৪২৭ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। বাঙালির পহেলা বৈশাখ। বাঙালির প্রধান অসাম্প্রদায়িক উৎসব। বাজেনি নাকাড়া, নহবৎ ধ্বনি, সানাই অথবা শাঁখ/ তবু এসে গেছে নব পল্লবে, নব উৎসবে,/নব জীবনের নব অনুভবে, এপ্রিলে বৈশাখ…। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার বৈশাখ কিছুটা বিবর্ণ। উৎসবহীন। হাসিরাশি আনন্দ বলা চলে উধাও। তবুও সময় বয়ে যায়। পুরনোকে পেছনে ফেলে আসে নতুন। সেই নতুনকে লোক আচার, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জ্বল আলোয় বরণ করে নেবে বাঙালি।
আজ পুরনো দিনের শোক-তাপ-বেদনা-অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ ভুলে অপার সম্ভাবনার দিকে, স্বপ্নের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার দিন। সকল ভয়কে জয় করার মানসে নতুন করে জেগে ওঠার উপযুক্ত সময়। কবিগুরুর ভাষায় : নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে/শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে…। একই আনন্দের বহি:প্রকাশ ঘটিয়ে নজরুল লিখেছেন: তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর…।
অবশ্য জয়ধ্বনি করার কথা কবি বললেও, এবার ভিন্ন বাস্তবতা। প্রকৃতি বড় রুষ্ঠ। করোনার প্রাদুর্ভাবে পর্যুদস্ত পৃথিবী। সদা দাপিয়ে বেড়ানো মানুষ ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ নেই। একে অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে শুধু। এ অবস্থায় আজ বর্ষ শুরুর দিনে সামাজিক দূরত্ব মেনে নিয়েও, মানসিকভাবে পরস্পরের কাছে থাকার শপথ নেবে বাঙালি।
রমনার বটমূলে যাওয়া হবে না। ছায়ানটের শিল্পীদের সঙ্গে গান গাওয়া হবে না। আয়োজন করা হবে না মঙ্গল শোভাযাত্রার। তবে বাঙালি তার মনের রংটুকু ধরে রাখবে। হতাশায় না ডুবে সবাই মিলে একসঙ্গে বাঁচার স্বপ্ন দেখবে। ভবিষ্যতে আরও সুন্দর আরও বর্ণাঢ্য নববর্ষ উদ্যাপনের স্বার্থেই এবার ঘরে বসে নিজেদের মতো করে উদ্যাপন করবে বাঙালি।
বর্ষ শুরুর দিনে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ নববর্ষ উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ দেশবাসীকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বৈশাখ শুধু ঋতুচক্রমনের ধারাবাহিকতা নয় বরং আমাদের ঐতিহ্য চেতনারই নাম। শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বাংলা নববর্ষ উৎসবের কোন তুলনা হয় না। অতীতের সব গ্লানি ও বিভেদ ভুলে বাংলা নববর্ষ জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ঐক্য ও সংহতি আরও সুদৃঢ় করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পহেলা বৈশাখে বাঙালি সংস্কৃতির যে চর্চা হয় তা আমাদের জাতিসত্তাকে আরও বিকশিত করে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি জোগায়। করোনাভাইরাসের ভয়কে জয় করে বাঙালী আবারও জীবনের জয়গান করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
ইতিহাসটি সবার জানা, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সাল প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। তাঁর আমলেই প্রবর্তন হয় বাংলা সাল। এখন তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত। বঙ্গাব্দের মাস হিসেবে বৈশাখের প্রথম স্থান অধিকার করার ইতিহাসটি বেশি দিনের না হলেও, আদি সাহিত্যে বৈশাখের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। দক্ষের ২৭ কন্যার মধ্যে অনন্য সুন্দরী অথচ খরতাপময় মেজাজসম্পন্ন একজনের নাম বিশাখা। এই বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখের নামকরণ। বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেখানেও সন্ধান মেলে বৈশাখের।
আবহমান কাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। এক সময় গ্রামবাংলায় চৈত্রসংক্রান্তি ছিল প্রধান উৎসব। বছরের শেষ দিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করতেন কৃষাণ-কৃষাণীরা। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশ করার জন্য। এখনও বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় আল্পনা আঁকেন মাটির মেঝেতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবেন সবাই। স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন। নববর্ষ উপলক্ষে হাটে-মাঠে-ঘাটে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। নানা রকম কুটির শিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে সাজানো হয় স্টল। থাকে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজনও।
নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ধর্ম বর্ণ ভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতে বাংলা। ষাটের দশকে বাঙালী চেতনাবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে রাজধানী শহর ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় বৈশাখ উদযাপন। এর মাধ্যমে বাঙালী আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়। পরবর্তী সময়ে বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে পহেলা বৈশাখের। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিবসটি বর্তমানে বাঙালির জাতিসত্তায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের বলাটি চমৎকার। তিনি বলেছেন, আমাদের অধুনাতম নববর্ষ এদেশের গ্রীষ্মকালীন উৎসব ও কৃষি উৎসব উদযাপনের একটি বিবর্তিত নবসংস্করণ। এর অতিহ্য প্রাচীন কিন্তু রূপ নতুন, নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা অবারিত স্রোতে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করেছে এমন এক নতুন আবহ যাকে একটা দার্শনিক পরিমন্ডল বলে উল্লেখ করতে হয়। এ পরিমন্ডলে পুরাতন বিলীন জীর্ণ স্তূপ নিশ্চিহ্ন, মিথ্যা বিলুপ্ত ও অসত্য অদৃশ্য। আর নতুন আবির্ভূত নবজীবন জাগরিত সুন্দর সম্মিত ও মঙ্গল সম্ভাবিত কালবৈশাখীই এর প্রতীক। সে নববর্ষের অমোঘ সহচর। নবসৃষ্টির অগ্রদূত সুন্দরের অগ্রপথিক ও বিজয়কেতন।
বিকল্প আয়োজন নিয়ে থাকছে ছায়ানট ॥ পহেলা বৈশাখে আজ বিকল্প আয়োজন নিয়ে থাকছে ছায়ানট। বিগত বছরগুলোতে এ প্রতিষ্ঠান রমনা বটমূলে যেসব প্রভাতী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে সেগুলো থেকে নির্বাচিত অংশ নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে বিটিভি। রমনা বটমূলে না গেলেও, সকাল ৭টায় এ অনুষ্ঠানের সঙ্গে দিন শুরু করতে পারবেন দর্শক। প্রতি বছর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বিশেষ ভাষণ প্রদান করেন ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন। এ বছরও বাঙালির উদ্দেশ্যে বিশেষ বক্তৃতা করবেন তিনি। বর্তমান সময়ে আলোকে তৈরি বিশেষ বক্তৃতা আজকের অনুষ্ঠানটিকে আরও বেশি সমকালীন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পোস্টারে মঙ্গল বারতা চারুকলার ॥ বর্ষবরণের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতি বছর ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের করা হয়। শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় এটি চারুকলায় এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় বহন করা হয় বাঁশ ও কাঠে গড়া বিশালাকৃতির ভাস্কর্য। পাখি, হাতি মাছ, গাভীসহ থাকে গ্রামীণ জীবনের নানা অনুষঙ্গ। কিন্তু এবার সবই স্থগিত করা হয়েছে। তবে একটি পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে।
চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হচ্ছে না। তবে এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে তারা যে কথা বলতে চান, সেটি পোস্টারে সীমিত পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। পোস্টারে আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে- ‘মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’
হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণের পরিবর্তে ॥ গত কয়েক বছর ধরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করা হচ্ছে হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। এবার সীমিত পরিসরে টেলিভিশনের স্টুডিও থেকে অনুষ্ঠানটি প্রচার করা হবে বলে জানিয়েছে চ্যানেল আই।
এর বাইরে ঘরে বসে যে যার মতো করে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবেন। অনেকে গান করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। নতুন জামা কাপরও সংগ্রহ করেছেন কেউ কেউ। বাকিরা গত বছরের শাড়ি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েই ঘরোয়া আয়োজনে যোগ দেবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজ দৃশ্যমান হবে নতুন এক উদযাপন।