মিনিটে একজন আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুতে

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ঝড়ের গতিতে বাড়ছে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারী হিসাব বলছে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৪৭৭ জন নতুন করে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। গড়ে দেখা গেছে, প্রতি মিনিটে একজনের বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে দেশের ৬৪ জেলাতেই এখন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। যদিও সরকারী হিসাবে বলা হয়েছে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এখন ১৭ হাজার ১৮১ জন হলেও মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ১৪ জন। যদিও বেসরকারী হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেকে বেশি বলে জানা গেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়ালেও ১২ হাজারের বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন।
এদিকে ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে এলাকায় ফিরে গেছে। এলাকার স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় যে হারে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সঙ্কুলান হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই অনেক রোগী নিজ এলাকায় চলে গেছেন। এবং জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। তবে স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছে এমন রোগীর সংখ্যা নেহায়েতই কম। প্রায় প্রত্যেকে ঢাকা থেকে জ্বর নিয়ে এলাকায় ফিরে গেছেন। তারা ঢাকাতেই কর্মরত অথবা অধ্যয়নরত ছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার ভয়াবহতা এমন সময় বাড়ছে, যেখানে আর ক’দিন পর দেশে পালিত হবে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ-উল-আযহা। এ উপলক্ষে আগামী সপ্তাহ থেকেই লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করবেন। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে কোরবানির পশু নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী রাজধানী আসবেন। এর আগেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি বা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়তে পারে ডেঙ্গু। তাই সময় থাকতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া গ্রামগঞ্জে খালে বিলে এডিস মশার লার্ভা ছড়িয়ে পড়লে পরবর্তীতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তারা বলছেন, প্রাণঘাতী ডেঙ্গু কবলে সারাদেশ। মশা নিধনে এখন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ওয়ার্ড, উপজেলা ও অঞ্চলভিত্তিক অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের দাবিও তাদের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ডেঙ্গু আক্রান্ত বাহক অন্য জায়গায় ভ্রমণ করার মাধ্যমে পড়ে। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি যখন অনত্র ভ্রমণ করে তখন সেখানে তাকে কোন মশা কামড়ালে সেই মশার ভেতরও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। সেই মশা পরে যাদের কামড়ায় তাদের শরীরের ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবার ঈদে যারা ঘরে ফিরবেন তাদের অনেকেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। এ কারণেই এটির সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পরিবেশ সংগঠন বাপার সভাপতি ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন বলেন, বর্তমানে দেশে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করেছে। যা জাতীর জন্য মোটেও স্বস্তির বিষয় না। ঢাকার দুই মেয়র আগে থেকে সতর্ক হলে আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। তাদের অবহেলার কারণে আজ দেশে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করেছে। ওষুধ নিয়েও অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে পারে না।
ষ্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহম্মেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তাদের দায়িত্ব পালন না করে বরং উল্টো বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ছড়াচ্ছে। দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে বিতর্কিত বক্তব্য না দিয়ে বরং সরকারকে দেশের স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ এলাকার ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করার আহ্বান জানান।
ঈদ উপলক্ষে আগামী সপ্তাহ থেকে লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করবেন। এবার ঈদে দীর্ঘ ছুটি থাকায় ঘরে ফেরার লোকের সংখ্যা আগে চেয়ে বেশি হতে পারে। প্রতি ঈদে প্রায় ৬০ লাখ লোক ঢাকা ছেড়ে চলে যান। এ কারণেই এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে উদ্বেগ আরও বেড়ে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় যেসব এলাকায় কোরবানির পশুর হাট বসবে সেসব এলাকা এখন থেকেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা না হলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আতঙ্ক মাথায় নিয়েই ঈদ উদ্যাপন করতে হবে।
এদিকে প্রতিদিন সরকারীভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের যে হিসাব দেয়া হচ্ছে তাতেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ছে। সরকারী-বেসরকারী প্রতিটি হাসপাতালে এখন ডেঙ্গু রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসার কথা বিবেচনা করে প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার খোলা হয়েছে। যারা নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্ণারে গিয়ে চিকিৎসা বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
এদিকে রাজধানীতে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করায় এবং তা দ্রুত বিস্তারে স্কুল পড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা সবচেয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। প্রায় প্রতিদিন অভিভাবকরা বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে। ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিভাবকদের সেখানে অবস্থান করতে হচ্ছে। এতে করে নিজের সন্তানের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অপরদিকে নিজেরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন কখন কি হয় এই ভেবে। তারা এই অবস্থায় স্কুলের আগাম ছুটির আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল রূপ ধারণ করছে। প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার কোন লক্ষণই নেই। বরং তা সারাদেশের ৬৪ জেলাতেই বিস্তার লাভ করেছে। তাদের দেয়া হিসাব অনুযায়ী ঢাকার প্রায় সব হাসপাতালে আশঙ্কাজনকভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার হাসপাতালগুলোতেই ভর্তি হয়েছেন ৯২৬ রোগী। বেসরকারী হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা ৩৬০ এবং ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫৪৯ জন। তারা বলছেন, দেশে গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে মোট ১৭ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে ১৪৫ জন মারা গেছেন। ৪ হাজার ৯০৩ জন বর্তমানে ভর্তি আছেন। এর বাইরে ১২ হাজার ২৬৬ জন সুস্থ হয়ে ছাড়িপত্র নিয়েছেন।