ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমি বণ্টন নীতি

267

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
উল্লেখ্য যে, সরকারিভাবে যে ভূমি জনগণের মধ্যে বণ্টন করা হবে এর দ্বারা কোনরূপ সামন্তবাদী বা জায়গীরদারী প্রথা চালু করা যাবে না। যার পক্ষে যে পরিমাণ ভূমি চাষাবাদ, উৎপাদন করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব তাকে ঐ পরিমাণ ভূমিই দেয়া হবে। সরকারি মালিকানা ছাড়া ক্রয়কৃত ভূমির মালিকগণ যদি বেশিরভাগ আবাদী ভূমি হস্তগত করে বসে এবং গরীব কৃষকের যদি ভূমির প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে দেখা দেয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান দু’পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারবে : ১. মালিকানাবিহীন, পতিত ও অনাবাদি কৃষি ভূমি কৃষকদের মধ্যে বিনা পয়সায় বণ্টন করে দেবেন। ২. ভূমির মালিকদের নিকট কৃষিকার্যের প্রয়োজনীয় ভূমি থাকলে এসব ভূমি তাদের দখলমুক্ত করে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন।
মহানবী (স.) এর ইন্তেকালের পর প্রথম পর্যায়ে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের সংঘর্ষ এবং যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয়ে এই দু’রাষ্ট্রের বিশাল অংশ দখল করে নেয়। ইসলামী রাষ্ট্রের দখলকৃত এই বিশাল ভূমির কেউ মালিক ছিল না। হয় ঐ জমির মালিক যুদ্ধে নিহত হয়েছে, না হয় তা আসলেই কারো মালিকানাভূক্ত ছিল না বরং পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সরকার প্রদত্ত জতি জায়গা ছিল এবং তা-ই ইসলামী রাষ্ট্রের হাতে এসেছিল। ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফাগণ এই সব জায়গা আবাদ ও ভোগ দখল করার জন্য এমন লোকদের মধ্যে বণ্টন করলেন যারা সেগুলো আবাদ ও ফসল ফলাতে সক্ষম বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। এ সকল ভূমি বণ্টনে শরীয়তের বিধান পুরোপুরি অনুসৃত হয়েছিল। হযরত উমর (রা.) গভর্ণর হযরত আবু মুসা আশআরী (রা.) কে লিখে পাঠিয়েছিলেন : ‘যদি তা জিযয়ার জমি না হয় এবং এমন জমিও না হয় যেখানে জিযয়ার জমির জন্য পানি প্রবাহিত হয়, তবে কেবল সেই জমিই সরকারি পর্যায়ে জনগণের মধ্যে বণ্টন করতে পারো।’ এতে প্রমাণিত হয় যে, কেবলমাত্র মালিকানা বিহীন জমিই সরকারি পর্যায়ে বণ্টন করা যেতে পারে। আর এইরূপ জমির পূর্ণ বণ্টন সরকারি পর্যায়েই হতে পারে।
সরকারি পর্যায়ে জমি বণ্টনকার্য কেবলমাত্র সেসব জমির মধ্যেই সীমাবদ্ধ যা সরকারের আয়ত্তাধীন রয়েছে এবং যাতে সরাসরি সরকারি নির্দেশ কার্যকর হতে পারে। কিন্তু যেসব জমির নির্দিষ্ট মালিক রয়েছে সেসব জমি সম্পর্কে সরকার বিনা কারণে কোন নতুন নীতি গ্রহণ করতে পারে না। সরকারি পর্যায়ে জমি বণ্টনের এটাই মৌলিক বিধান। অতএব সাধারণভাবে ও কোন সামষ্টিক কল্যাণের উদ্দেশ্য ব্যতীতই খামখেয়ালীভাবে ভূমির মালিকদের উৎখাত করে দিয়ে তা নিজেদের লোকদের মধ্যে অথবা অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যের বিনিময়ে পুনর্বণ্টন করা ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট জুলুম।
সরকারিভাবে যে জমি জনগণের মধ্যে বণ্টন করা হবে, তার দ্বারা কোনরূপ সামন্তবাদ বা জায়গীরদারী প্রথা রচনা করা চলবে না। যার পক্ষে যত পরিমাণ জমি ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনার মধ্যে সামলানো, চাষাবাদ ও ফসল ফলানো সম্ভব হবে বলে বিবেচিত হবে, তাকে ততখানি জমিই দেয়া হবে। অধিক পরিমাণ জমি কাউকেই দেয়া যাবে না। হযরত বেলাল ইবনুল হারিস (রা.) কে মহানবী (স.) প্রচুর জমি নিজে আবাদ করার জন্য দিয়েছিলেন। হযরত উমর ফারুক (রা.) খলীফা নিযুক্ত হবার পর তাঁকে ডেকে বললেন : মহানবী (স.) আপনাকে অনেক জমি দিয়েছেন। তার পরিমাণ এত বেশি যে, আপনি তা পুরোমাত্রায় চাষাবাদ করতে পারছেন না। অতঃপর বললেন : ‘আপনি বিবেচনা করে দেখুন। যে পরিমাণ জমি আপনি নিজে চাষাবাদ করতে সক্ষম হবেন সে পরিমাণই আপনি নিজের নিকট রাখুন। আর যা সামলাতে পারবেন না কিংবা যে পরিমাণ জমির ব্যবস্থাপনা করা আপনার সাধ্যাতীত, তা আমাদের (রাষ্ট্রের) নিকট ফেরত দিন, আমরা তা অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেব। হযরত বেলাল (রা.) জমি ফেরত দিতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সাধ্যাতীত পরিমাণ জমি হযরত উমর (রা.) ফেরত নিলেন এবং মুসলমানদের মধ্যে পুনর্বণ্টন করলেন।
ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) লিখেছেন, ‘যে সকল জমি আবাদী নয়, যার কোন মালিক নেই-তা বণ্টন না করে অব্যবহৃত ফেলে রাখা রাষ্ট্রের পক্ষে কিছুতেই উচিত হতে পারে না। কেননা আবাদ করার ফলে যেমন প্রয়োজনীয় খাদ্য ফসল লাভ করা যেতে পারে, তেমনি সরকারের আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে পারে। এ পর্যায়ে হযরত উমর ইবন আবদুল আযীয (রা.) এর একটি আদেশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর গভর্ণরদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘তোমাদের হাতে যে সব সরকারি জমি জায়গা রয়েছে তা অর্ধেক ফসলের বিনিময়ে পারস্পরিক চাষের নিয়ম অনুযায়ী জনগণকে চাষ করতে দাও। এতেও যদি তার চাষাবাদ না হয়, তাহলে এক-তৃতীয়াংশের বিনিময়ে (তিন ভাগের এক ভাগ পাবে সরকার এবং দু’ভাগ পাবে চাষী) তা চাষ করতে দাও। আর এই শর্তে যদি কেউ জমি চাষ করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে দশ ভাগের এক ভাগ ফসল পাওয়ার বিনিময়ে চাষ করতে দিতে পার। এতেও যদি জমি চাষ না হয় তাহলে কোনরূপ বিনিময় না নিয়ে এমনিই চাষ করতে দাও। এভাবেও কেউ চাষ করতে না চাইলে তার চাষাবাদ করার জন্য বাইতুলমাল ৬৭ হতে অর্থ ব্যয় কর এবং কোন জমিই তোমরা অব্যবহৃত থাকতে দিবে না।
ইসলামে ভূমির প্রকারভেদ : ইসলামের ভূমি নীতি একটি বিশ্বজনীন ব্যবস্থা। ইসলামের ভূমি ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকারের ভূমির অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। যেমন : ক. ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি : ইসলাম বৈধ পন্থায় ক্রয়কৃত কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিকে ব্যক্তিমালিনাধীন জমি বলে স্বীকার করে। খ. সরকারি মালিকানাধীন ভূমি : দেশের সকল ভূমি ব্যক্তি মালিকানায় সমর্পণ না করে রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে রাখার অনুমতি রয়েছে। যাতে প্রয়োজনের সময় দেশের সার্বিক কল্যাণ ও ভূমিহীন লোকদের মধ্যে তা বণ্টন করা সম্ভব হয়। সরকারি মালিকানাধীন ভূমির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো।
মালিকানাবিহীন যে সকল ভূমি গ্রাম ও শহরবাসীদের সাধারণ ও যৌথ প্রয়োজনের খাতিরে ব্যবহৃত হয়। যথা- খাল, বিল, নদী, ঝরণা, গোচারণ ভূমি, সড়ক, পথঘাট, খেলার মাঠ, কবরস্থান ইত্যাদি। এছাড়া বন, খনি প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ ভূমিও সরকারি মালিকানায় থাকবে। ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে পরাজিত বিধর্মীদের নিকট থেকে প্রাপ্ত ভূ-সম্পত্তি সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করতে পারেন, আবার ইচ্ছা করলে এ প্রকার ভূসম্পত্তি বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যেও বণ্টন করতে পারেন। মহানবী (স.) খায়বরের বিজিত ভূমির অর্ধেক বণ্টন করে বাকি অর্ধেক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় গ্রহণ করেন। অবশ্য সরকার ইচ্ছে করলে উক্ত ভূমি খাজনা লাভের বিনিময়ে তা পূর্বতন মালিকদেরও দিতে পারেন।
শক্রদের ছেড়ে যাওয়া পরিত্যক্ত ভূ-সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় মালিকানাভূক্ত হবে। ইহুদী বনু নযীর গোত্রের ভূমি সরকারি মালিকানাধীন হয়েছিল। মালিকানাবিহীন যে সকল ভূমি পতিত অবস্থায় থাকে এবং শহর বা গ্রামের মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় না। যেমন বন-জঙ্গল, মরুভূমি, অনাবাদী পাহাড়ী জমি ইত্যাদি। এসব জমি কার্যত যেমন আবাদ ও ফসলযোগ্য নয়, তেমনি এর দ্বারা কোন উপকারও হয় না। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় এ শ্রেণীর ভূমিকে ‘আরদে মাওয়াত’ বলা হয়। এ শ্রেণীর ভূমির মালিক হয় সরকার। যে ভূমির মালকের মৃত্যু হয়েছে এবং তার কোনও উত্তরাধিকারও নেই এমন ভূমিকে ‘আদিউল আরদ’ বলা হয়। এরূপ ভূমির মালিক হবে স্বয়ং সরকার।
বিজিত অঞ্চলের ভূমি ‘খালিসা’ বা খাস জমি হিসাবে পরিগণিত হয় এবং এর মালিকানার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করে। যেমন হযরত উমর (রা.) কর্তৃক পারস্য বিজিত হলে তিনি সেখানকার সম্রাটেরও তার পরিবারের অধিকারভূক্ত ভূমিকে ‘খালিসা’ হিসেবে গ্রহণ করেন। কোন ভূমির মালিক স্বেচ্ছায় মালিকানা স্বত্ব ত্যাগ করে রাষ্ট্রের অধীনে ছেড়ে দিলে তা রাষ্ট্রের হয়ে যায়। যেমন, মদীনা রাষ্ট্র গঠিত হলে চাষাবাদে অতীব কষ্টকর এমন সব শুষ্ক অনুর্বর জমি আনসারগণ মহানবী স. এর হাতে তুলে দেন। তাঁকে ইচ্ছেমত এগুলো ব্যবহারের অধিকার দেয়া হয়।
সাধারণত আবাদী ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানাই চূড়ান্তভাবে বিদ্যমান থাকে। মালিক তার ইচ্ছেমত এগুলোতে চাষাবাদ ও অন্যান্য উৎপাদনমূলক কাজ করতে পারে। মালিকের বৈধ অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ এ ধরনের ভূমিতে হাত দিতে পারে না। ব্যক্তির মালিকানায় এরূপ উৎপাদনশীল ভূমি কী পরিমাণ থাকতে পারবে তার সীমারেখা ইসলাম বেঁধে দেয়নি। কিন্তু কোন ব্যক্তির হাতে সাধ্যাতীত পরিমাণ ভূমি থাকলে অর্থাৎ তার মালিকানাধীন ভূমিতে চাষাবাদ করার ক্ষমতা না থাকলে এবং এর ফলে তার ঐ ভূমি একটানা তিন বছর অনাবাদী পড়ে থাকলে রাষ্ট্র ঐ ভূমির মালিকানার দায়িত্ব স্বয়ং গ্রহণ করে ভূমিহীন চাষীদের মধ্যে বিতরণ করতে পারবে এবং অনেক ক্ষেত্রে বর্গাচাষেও দিয়ে দিতে পারবে। যদিও বর্গাচাষের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত রয়েছে। (অসমাপ্ত)