বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা

150

কাজিরবাজার ডেস্ক :
উৎসাহী মানুষের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। মহাকাশে উড়তে গিয়েও উড়েনি বাংলাদেশের গৌরব ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। ‘কাউন্টডাউনে’ ৪২ সেকেন্ডে এসে থেমে যায় বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের যাত্রা। তখন টেলিভিশনের সামনে থাকা কোটি কোটি দর্শকের কম্পনও অনেকটাই থেমে যায়। টেলিভিশনের আলোচকদের মধ্যেও নেমে আসে হতাশার সুর। বৃহস্পতিবার রাত দুটা ১২ মিনিট থেকে চারটা ৪৭ মিনিটের মধ্যে এমন একটি দৃশ্যের অবতারণা হয়। শেষ বেলায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়েছে বলে ঘোষণা আসে। তবে ওই ঘোষণায় বলা হয় শুক্রবার একই সময়ে আবার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে। স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার মহাকাশের যাত্রাপথ সুগম করার জন্য সব ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দূর করতে ব্যস্ত। শুক্রবার আবার চেষ্টা হবে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের। সফল উৎক্ষেপণের অপেক্ষায় দেশের কোটি কোটি মানুষ। মহাকাশ জয় হলেই বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর ৫৭তম দেশ, যাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকছে।
বিটিআরসি জানিয়েছে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বলা হয়েছে, যে কোন রকেট উৎক্ষেপণের এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। সামান্য ত্রুটি দেখা দিলেই উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়। খোদ আমেরিকার বহু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দিন তারিখ অনেকবার পরিবর্তন করে উৎক্ষেপণের ইতিহাস রয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আশাহত হওয়ার কিছু নেই শুক্রবার ‘ব্যাকাপ টাইম’ রাখা হয়েছে। এই ব্যাকআপ টাইমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত দুটা ১২ মিনিট থেকে চারটা ২২ মিনিটের মধ্যে যে কোন সময় স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হতে পারে। ফ্যালকন-৯ রকেটে ভূমি ছেড়ে টানা ৮ দিন মহাকাশে উড়ে ৩৬ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিজস্ব কক্ষপথে নিজের অবস্থানে স্থাপন হবে স্যাটেলাইটটি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের মালিক দেশ হিসেবে সদস্য পদ লাভ করেছে। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অনেক উঁচুতে।
স্পেসএক্স’র আমন্ত্রিত অতিথি রাশেদ রহমান জানিয়েছেন, স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের সবকিছুই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হয়। আবহাওয়াজনিত কিংবা রকেটে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়লে উৎক্ষেপণটিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। খুব বড় কোন ঘটনা না ঘটলেও সামান্য ত্রুটি ধরা পড়লেও উৎক্ষেপন হবে না। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে এমন কিছুই ঘটেছে। আশা করা যাচ্ছে শুক্রবার মহাকাশ জয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ভূমি ছেড়ে যাবে। প্রায় ২২ হাজার মাইল দূরে গিয়ে নিজ অবস্থানে স্থাপন হবে। তবে হ্যাঁ প্রথম দিন স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ হলে দেশের মানুষের মনে যে আনন্দের বন্যা বইছিল-তা আরও প্রবল হতো। এই আনন্দে কিছুটা ছন্দ পতন হলো। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ে যে উচ্ছ্বাস মানুষের মনে সেই উচ্ছ্বাসের প্রতিফলন শুক্রবার রাতে ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি-বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ স্থগিত নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি ওই পোস্টে বলেছেন, ‘উৎক্ষেপণের শেষ মুহূর্তগুলো কম্পিউটার দ্বারা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। হিসেবে যদি একটুও এদিক সেদিক পাওয়া যায়, তাহলে কম্পিউটার উৎক্ষেপণ থেকে বিরত থাকে। আজ যেমন নির্ধারিত সময়ের ঠিক ৪২ সেকেন্ড আগে নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার উৎক্ষেপণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। স্পেসএক্স সবকিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আগামীকাল একই সময়ে আবারও আমাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বহনকারী রকেটটি উৎক্ষেপণের চেষ্টা চালাবে। যেহেতু এই ধরনের বিষয়ে কোন ঝুঁকি নেয়া যায় না, সেহেতু উৎক্ষেপণের মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করা খুবই সাধারণ বিষয়, চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।’ একই বিষয়ে জয় ইংরেজিতেও পোস্ট দিয়েছেন।
অন্যদিকে, স্পেসএক্স এক টুইট বার্তায় জানিয়েছে শেষ মিনিটে কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ স্থগিত রাখা হয়েছে। রকেট ও স্যাটেলাইট ভাল অবস্থায় আছে। আজ নির্ধারিত সময়ে উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি চলছে। সব ধরনের ত্রুটি নিয়ে শুক্রবার দিনভর পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে নির্ধারিত সময়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে রওনা হবে। ফ্যালকন-৯ রকেটে ভর করে স্যাটেলাইটটি ভূমি ছাড়বে।
কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, উৎক্ষেপণের ঠিক দুই মিনিট আগে এটি কম্পিউটারের কন্ট্রোলে চলে যায়। স্বয়ংক্রিয় কমপিউটার হয়তো কিছু সমস্যা ধরে উৎক্ষেপণ বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘোষণা দেয়া হয় শুক্রবার একই সময় পুনরায় উৎক্ষেপণের সময় নির্ধারণ করা হয়। সব প্রস্তুতি সেরে আবার উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
তথ্যপ্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, শুক্রবার স্পেসএক্স কেনেডি সেন্টারে উৎক্ষেপণের জন্য আবার প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে শুক্রবার একই সময়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ২৪ ঘণ্টার মতো পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে কি সমস্যা হয়েছিল তা জানা যায়নি।
কেনেডি স্পেস সেন্টারে থাকা বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে এ রকম বহু ঘটনা আছে। খোদ আমেরিকার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে বহুবার সময় পরিবর্তন করা হয়েছে। যেখানে কাউন্টডাউনের একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়েও উৎক্ষেপণ স্থগিত হতে পারে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এটা কোন বিষয় না। আবার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি শেষ করেছে স্পেসএক্স। শুক্রবার স্যাটেলাইটটি মহাকাশের পথে রওনা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। স্যাটেলাইট বহনকারী রকেটটি ৭ থেকে ৮ মিনিট দৃষ্টিসীমায় থাকবে। এরপর এটি ৩৬ হাজার কিলোমিটার বেগে মহাকাশে কক্ষপথের দিকে এগিয়ে যাবে। মহাকাশে ৮ দিন সময় ঘুরে নির্ধারিত স্থানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিজ স্থানে স্থাপন হবে। স্পেসএক্স তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত দুটা ১৪ থেকে চারটা ২১ মিনিটের মধ্যে উৎক্ষেপণের নতুন সময় ঠিক করা হয়েছে। কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড ৩৯ এ থেকে এটি উৎক্ষেপণ হবে।
বিটিআরসি জানিয়েছে, ৩ দশমিক ৭ মেট্রিক টন ওজন নিয়ে টানা ১৫ বছর অবস্থান করবে। ১৫ বছর চলে যাওয়ার পর স্যাটেলাইট আরও ৩ বছর বার্তা দিতে পারবে। তবে ওই তিন বছরকে ‘লাইভ টাইমের’ ধরা হয়নি। স্যাটেলাইট নির্মাণের এই মহাকর্মযজ্ঞে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিয়েছে এক হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বাকি এক হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বিদেশী ঋণে নির্মিত হয়েছে। নিজস্ব কক্ষপথ ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্থাপন করা হবে স্যাটেলাইটটি। গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০ থেকে ২২ দিন সময় লাগবে। গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় দু’টি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। দেশের গ্রামাঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা হবে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনা, কেবল টিভি সেবা ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম)সহ জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত কাজেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করবে। আজও দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ সরাসরি সম্প্রচার দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিল। দেশের সব জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সাধারণ মানুষকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দৃশ্য দেখানোর সব আয়োজন ঠিক রেখেছে।