“শিমুল বাগানে ভ্রমণ”

73

॥ শাকেরা খানম শাকী ॥

বৃহস্পতিবার, সপ্তাহের শেষ দিনটায় ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ কথার মাঝে কেউ একজন বলে উঠলো চল কাল একটা ট্যুরে হয়ে যাক। বেশ কিছু দিন থেকেই শিমুল বাগান যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। সুতরাং গন্তব্য স্থান ঠিক হলো। সুনামগঞ্জ-তাহিরপুরের শিমুল বাগান। তবে হুট হাট প্ল্যান যেহেতু তাই কেউই তেমন প্রস্তুত ছিলাম না। বান্ধবীরা একে অন্যকে বলতে লাগল কে কে যাবি রাতের মধ্যে নিশ্চিত হয়ে জানা। বাসায় এসে আব্বুকে বললে উনি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেন। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে আবার সিলেট ফিরে আসা সম্ভব না দেখে অনুমতি দিতে চাইলেন না। ঐ দিকে বন্ধুরা বার বার বলছে যাবো কি না নিশ্চত হয়ে জানাতে। বলতেই হলো আমার যাওয়া হচ্ছে না।
শুক্রবার ভোর ৭ টায় সবার রওয়ানা দেয়ার কথা। আমার ঘুম ভাঙ্গল ৭.২০ মিনিটে। খুব আগ্রহ জাগলো সবার সাথে ট্যুরে যেতে তবে এতক্ষণে হয়তো সবাই চলে গেছে। একজনকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম এখনো যাওয়া হয়নি। সুতরাং শেষ চেষ্টাটা করে দেখলাম। আব্বু আম্মুকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা অনেক অনুরোধ করে, অনেক কাঠ খড় পোড়ানোর পর রাজি হলেন। ফোন দিয়ে বন্ধুদের বললাম অনুমতি আমি পেয়ে গেছি তোরা দাঁড়া আমিও যাবো। তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম নাস্তা না করেই। গিয়ে দেখি সবাই অপেক্ষা করে আছে। এক কাপ চা খেয়ে রওয়ানা দিলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। প্রথমে লোকাল বাসে সুনামগঞ্জ যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লোকাল বাসে গেলে একটু ঝামেলা পোহাতে হতো। কারণ সুনামগঞ্জ নতুন বাস স্ট্যান্ড থেকে মটর সাইকেল করেই শিমুল বাগান যেতে হয়। যেহেতু আমাদের সাথে ছিল ঘুরাঘুরি ডট কম ট্রাভেল গ্র“পের সদস্য বন্ধু খালেদ, তাই ও-ই আইডিয়াটা দিলো যে মাইক্রো বাসে যাওয়াটা সুবিধাজনক হবে। আমরা দশজন ছিলাম সুতরাং অনায়াসে মাইক্রো বাসে করে রওয়ানা দিলাম তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য শুধু শিমুল বাগানই নয় সাথে যাদুকাটা নদী, বাঁশ বাগান, বারেক টিলা এবং শাহ আরেফিন মাজার।
বন্ধুদের সাথে যাত্রাপথটা কেমন হবে নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছেন। সত্যিই অসাধারণ ছিল। সুনামগঞ্জ শহর থেকে আরেক বন্ধু যোগ দিলো আমাদের সাথে প্রায় আড়াই ঘন্টা পথ পাড়ি দিয়ে পৌছলাম বন্ধু খালেদের বাড়ি। ওখান থেকে হালকা নাস্তা শেষে আমাদের ঘুরাঘুরি শুরু করলাম। প্রথমে শাহ আরেফিন মাজার। লাউড়ের গড় গ্রামে অবস্থিত এই মাজারটির পরিবেশ আধ্যাত্মিকতায় ঘেরা। সাথে ছিল মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের ছোঁয়া। কথিত আছে হযরত শাহজালাল (রহ.) এর সাথে আগত ৩৬০ আউলিয়াদের একজন এই শাহ-আরেফিন (রঃ) যেহেতু দিনটা ছিল শুক্রবার তাই অন্যদিনের তুলনায় ভক্তদের উপস্থিতি একটু বেশিই লক্ষ্য করা গেলো। এই স্থানটির সাথে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা থাকায় ভারতের উঁচু পাহাড়ী অঞ্চলগুলোর অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটকদের বেশ দৃষ্টি আকষর্ণ করে। মাজারে কিছু সময় অতিবাহিত করে নদীর দিকে যাত্রারম্ভ করলাম। যেহেতু বর্ষা মৌসুম এখনো আসেনি আর শীতের আমেজটাও কাটেনি তাই নদীর পানি ছিল কম। ফলে আনেকটা জায়গা জুড়েই জেগে উঠেছে চর। বসন্তের হাওয়াটা ছিল প্রাণ জুড়ানো।
তপ্ত ঝরঝরে বালুতে খালি পায়ে হাঁটার অভিজ্ঞতাটা অন্যরকম। যাদু কাটা নদীর যাদুতে মুগ্ধ হতেই হলো।
নদী পার হয়ে গেলাম ওপারের বাঁশ বাগানে। সারিবদ্ধ বাঁশঝাড়, বাঁশ পাতায় হাওয়া লেগে ঘর্ষণের ফলে যে আওয়াজ সৃষ্টি হয় তা যে কারোরই শ্রবণ ইন্দ্রীয় তৃপ্ত করতে সক্ষম। বাঁশ বাগান পেরিয়েই শিমুল বাগান। একই এলাকায় একাধিক দর্শনীয় স্থান।
বসন্ত ঋতুকে এদেশে ঋতুর রাজা বলা হয়। এর সঙ্গত কারণও রয়েছে। বাঙালি মাত্রই তা উপলব্ধি করতে পারে। গাছে গাছে নুতুন পাতা আর ফুলের বাহারি সাজ যেনো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। শিমুল ফুলের লাল রংও যেনো ওই দিন প্রকৃতিকে রাঙ্গিয়ে ছিল আপন সৌন্দর্যে। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য অবিভূত করছিল ওখানে বেড়াতে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের। শিমুল বাগানের ভেতর দিকটায় লেবু গাছের সারি লক্ষ্য করা গেলো। কচি সবুজ পাতাগুলোর ঘ্রাণে প্রাণ যেনো মুহূর্তে সজীবতা ফিরে পেলো। অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে যে ক্লান্তি সৃষ্টি হয়েছিল, প্রকৃতি আপন মহিমায় তা নিমিষে দূর করে দিলো। এখন নতুন উদ্যোমে চলতে শুরু করলাম বারেক টিলার দিকে। শিমুল বাগান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত টিলাটির চূড়া থেকে পুরো এলাকাটির নান্দনিক সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। টিলার পাদদেশে যাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ পানি আর পার ঘেঁষা মরুভূমির ন্যায় চর, এ যেনো পৃথিবীর বুক জুড়ে একখন্ড স্বর্গ। পাহাড়ের চূড়ার নির্মল বাতাস প্রানে শিহরণ জাগায়। পাহাড়ের উপর থেকে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত খুব কাছ থেকে দেখা যায়। সীমান্ত পিলারের নিকট যেতেই একজন সীমান্ত রক্ষী এগিয়ে এসে আমাদের সতর্ক করে দিলেন যেনো বেশি দূর না যাই। তাই আর বেশি দূরে না গিয়ে ফিরে আসতে শুরু করলাম। মন দোলানো পাহাড়ী হাওয়া মনের ভেতরের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে নাড়া দিচ্ছিল। মন না চাইলেও ফিরে আসতে উদ্যত হলাম কারণ বিকেল প্রায় শেষের দিকে। ও দিকে আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। চললাম খালেদের বাড়ির দিকে ওখানে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। সে এক বিশাল আয়োজন। এটুকু সময়ের মধ্যে খালাম্মা এত্তো কিছু রান্না করে ফেলেছেন দেখে সবাইকে অবাকই হতে হলো। উনাদের এই দিনের আদর আপ্যায়ন কোনো দিন ও ভুলতে পারব না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। এখন বিদায়ের পালা। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম সিলেট ফেরার উদ্দেশ্যে। পেছনে রেখে আসলাম প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর সঙ্গে নিয়ে আসলাম এক ঝুড়ি স্মৃতি কুড়িয়ে। ঘুরাঘুরি ডট কমের প্রথম অফিসিয়াল ট্যুরটা সফলই হয়েছিল বলা যায়।