নিমতলীর মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের পর গত বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড পুরো দেশকেই নাড়া দিয়েছে। আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের গুদাম আর কারখানা থাকা যে কতটা বিপজ্জনক, তা নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চকবাজারে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধারকাজে যাওয়া ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও বলেছেন, আশপাশের দোকান আর ভবনে থাকা রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও পারফিউমের গুদাম চুরিহাট্টার আগুনকে ভয়াবহ মাত্রা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকায় যে পরিমাণ দাহ্যসামগ্রীর মজুদ ছিল, তাতে ভয়ংকর এ ঘটনার ক্ষেত্র হয়তো আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। ২০১০ সালে রাসায়নিকের গুদামে ঠাসা নিমতলী এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ায় এবারের ঘটনা আগের মতোই ভয়াবহ রূপ পেয়েছে।
সব সময় দেখা যায়, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন পর কারো কোনো খবর থাকে না। এমনকি মনিটর করার জন্যও কাউকে পাওয়া যায় না। ফলে সমস্যা থেকেই যায়। আবার এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো সময় সরকারের ক্ষমতার চেয়ে ব্যবসায়ীদের প্রভাব ও ভূমিকা শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ায়। আইন প্রয়োগে দুর্বলতার সুযোগ নেয় ব্যবসায়ীরা। যতবারই সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে ততবারই তাদের উদ্যোগ, আইনের যথাযথ প্রয়োগের উদ্যোগ হোঁচট খেয়েছে। আবার এমনও দেখা গেছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারকে আপস করতে হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ মানুষের প্রতি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কঠোর হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকার সেটা করতে পারে না। পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম উচ্ছেদের ক্ষেত্রেও সরকারের দুর্বলতা রয়েছে। চকবাজারের ক্ষেত্রে বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও। পুরান ঢাকার নিমতলীতে ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে ভয়াবহ আগুনে ১২৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল মূলত রাসায়নিক দ্রব্যের অপরিকল্পিত গুদাম ও প্লাস্টিক কারখানার কারণে। ওই ঘটনার পর সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা রাসায়নিক দ্রব্যের অবৈধ গুদাম সরাতে; কিন্তু কোনো ফল হয়নি। নিমতলীর ঘটনার পর তদন্ত কমিটির সুপারিশও বিন্দুমাত্র বাস্তবায়িত হয়নি। নিমতলীর ঘটনার প্রায় ৯ বছর পরও পুরান ঢাকার কারখানাগুলো পরিচালনার জন্য কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও থাকে। কিন্তু কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয় না।
এবার কী হবে? কোনো সুপারিশ বোধ হয় প্রয়োজন নেই, চকবাজারের ঘটনা যদি সত্যি ‘জাগরণী বার্তা’ হয়ে থাকে, সত্যি যদি এখান থেকে কোনো শিক্ষা পাওয়া যায়, তাহলে আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা এখনই সরিয়ে ফেলতে হবে।