ছাতকের বিভিন্ন হাওরে বজ্রপাতে এপ্রিলে নিহত ১৫, আহত অর্ধশতাধিক

39

আতিকুর রহমান মাহমুদ, ছাতক থেকে :
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলাসহ বিভিন্ন উপজেলার হাওরে বজ্রপাত আতঙ্কে শ্রমিক সংকটে ধান কর্তন ব্যাহত হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এপ্রিল মাসে বজ্রপাতে ১৫ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। হাওরের পাকা ধান কর্তন অবস্থায় অধিক সংখ্যক শ্রমিক বজ্রপাতে হতাহত হয়েছে। ধান কর্তন অবস্থায় শ্রমিক মারা যাওয়ার কারণে ভয়ে শ্রমিকরা ধান কর্তন করতে আগ্রহী হচ্ছেনা। এতে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় হাওরে ধান কর্তনে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকেই প্রাণের ভয়ে ধান কর্তন ছেড়ে কৃষকের বাড়ি থেকে শ্রমিকরা রাতের আধারেও পালিয়ে গেছে। ফলে হাওরের পাকা বোরো ধান নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আগাম বন্যার পূর্বাভাসে জেলা প্রশাসন বন্যা সতর্ক বার্তা প্রত্যেক এলাকাতে মাইকিং করে হাওরের বোরো ধান দ্রুত কর্তন করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়। বন্যার পূর্বাভাস পেয়েও কৃষকরা তাদের পাকা ধান কর্তন করাতে পারছেন না শ্রমিক সংকটের কারণে। বেশি অর্থ মজুরি দিয়েও শ্রমিকদের কাজে লাগাতে পারছেন না তারা। সবাই ভয়ে আতঙ্কিত, কোন সময় যে বজ্রপাত হয় আর প্রাণহানি ঘটে এই ভয় শ্রমিকদের উপর ভর করেছে। হাওর পারের কৃষকরা জানান, হাওরের ফসল কর্তন শুরু হলেও সম্প্রতি বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনার কারণে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। কোন শ্রমিক ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না প্রাণের ভয়ে। ইতোমধ্যে ৪০ভাগ ফসল কর্তন হয়েছে। পর্যাপ্ত শ্রমিকের অভাবে বাকী ৬০ভাগ পাকা ধান জমিতে পড়ে আছে। বন্যার ঝুঁকির পাশাপাশি অতি বর্ষণে জলাবদ্ধতা, শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী ঝড়সহ নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি প্রবেশ করে পাকা ধান তলিয়ে যাওয়ার কারণে জেলার প্রায় ১৭হাজার হেক্টর বোরো ফসল বিনষ্ট হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১শ’ ৫০কোটি টাকারও অধিক। এ মৌসুমে শ্রমিক সংকট নিয়ে বোরো ফসল কর্তন শুরু হলেও বিশেষ করে বজ্রপাতে হতাহতে শ্রমিক সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। মজুরির চেয়ে অধিক অর্থের বিনিময়েও ধান কর্তনে রাজি হচ্ছেনা বজ্রপাত আতঙ্কে।
জানা যায়, চলতি এপ্রিল মাসে জেলার বিভিন্ন হাওরে বজ্রপাতে নিহত ১৫ ও আহত হয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক। ১৭ এপ্রিল দক্ষিণ সুনামগঞ্জ দিরাই ও জামালগঞ্জের হাওরে ধান কর্তন অবস্থায় বজ্রপাতে ৬জন কৃষক-শ্রমিক মারা গেছেন। ওই দিন আহত হয়েছে ১০জন। নিহত দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পশ্চিম বীর গাঁও ইউনিয়নের ঠাকুরভোগ হাওরে ঠাকুরভোগ গ্রামের জাবেদ আলীর পুত্র জুবেল মিয়া (১৯), দিরাই উপজেলার বরারগাঁও হাওরে বরারগাঁও গ্রামের মৃত আবদুল খালিকের পুত্র জমসেদ আলী (৪০), কালিকুটা হাওরে রঙ্গারচড় গ্রামের মৃত নরেন্দ্র দাসের পুত্র জ্ঞানেন্দ্র দাস (৫৫), জগদল হাওরে নগদিপুর গ্রামের আবদুল করিমের পুত্র সামছুল হক (২৮), সাকিতপুর গ্রামের হাওরে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া গ্রামের কনা মিয়ার পুত্র মিলাদ মিয়া (১৮) এবং জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাগ ইউনিয়নের পাকনার হাওরে গজারিয়া গ্রামের ইউনুস আলীর পুত্র বাধন মিয়া (১৭) ধান কর্তন অবস্থায় বজ্রপাতে মারা যায়। দিরাই উপজেলার সাকিতপুর গ্রামের আবু তাহের, শাল্লা উপজেরার ফয়জুল্লাপুর হাওরে ফারুক আহমদ ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ডুংরিয়া গ্রামের শিমুল মিয়াসহ বজ্রপাতে ১০জন আহত হয়। ১এপ্রিল তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নের মাটিয়ান হওরে নতুন হাটি গ্রামের জাহান আলমের পুত্র ইজাজুল হক (২২), ৪ এপ্রিল শাল্লা উপজেলার কাশিপুর গ্রামের মিরেশ দাস (২৫), ৫ এপ্রিল ছাতক উপজেলার ভাতগাঁও ইউনিয়নের জিয়াপুর হাওরে জিয়াপুর গ্রামের ফয়জুল মিয়া (৫০) এবং একই দিন তাহিরপুর উপজেলার বড়দল ইউনিয়নের উলীপুর গ্রামের সুজন মিয়া (১৭) হাওরে কাজ করার সময় মারা যায়। ৯এপ্রিল ধর্মপাশা উপজেলার রবিউল আউয়াল (২৫), জসিম উদ্দিন (২২), শাহ আলম (২০) হাওরে বজ্রপাতে গুরুতর আহত হয়। ২১ এপ্রিল দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরে পাগলা আস্তমা গ্রামের মৃত মছদ্দর আলীর পুত্র গিয়াস উদ্দিন (২০) ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোহাম্মদপুরের মৃত নুর উদ্দিনের পুত্র আজিজুর রহমান (৪০) বজ্রপাতে মারা যায়। আহত হয় আবদুর রাজ্জাকের পুত্র শুকুর আলী (২৭) ও মজিদ উল্লার পুত্র আবদুস সালাম (২৫)। একই দিন ছাতক উপজেলার কুড়িবিলে মাছ ধরতে গিয়ে জাউয়াবাজার ইউনিয়নের দেবেরগাঁও গ্রামের সামছুল হক (২৮), ছমির উদ্দিন (১০), সোহেল মিয়া (৩০), তোরাব আলী (১৩), আবদুস শহিদ (৩০), সালমান আহমদ (১১) ও আল আমিন (১৫) বজ্রপাতে আহত হয়।
হাওরে উঁচু জায়গা না থাকার কারণে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় খনিজ সম্পদ থাকার কারণে বজ্রপাতের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা যায়, জেলায় ২লক্ষ ১৮হাজার ৫শ’ ৬৪ হেক্টর জমিতে বোর ধান আবাদ হয়েছে। এতে উৎপন্ন হওয়ার কথা ২৫লক্ষ ৫০হাজার মেট্রিকটন ধান। যার বাজার মূল্য দাড়ায় ৪হাজার কোটি টাকা। হাওরে অতি বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা, শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী ঝড় ও ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে পাকা ধান পানিতে তলিয়ে গিয়ে বিনষ্ট হয়েছে ১৭হাজার হেক্টর ফসল। যার ক্ষতির পরিমান দাঁড়ায় প্রায় দেড় শত কোটি টাকা। এর মধ্যে বর্তমানে যোগ হয়েছে বজ্রপাত। বজ্রপাতের ভয়ে এবং শ্রমিক সংকটের কারণে জমিতে পাকা ধান বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই শ্রমিক নিয়ে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। শ্রমিক না পেয়ে পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে ধান কর্তনে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা।