বাংলা ভাষার মূল্যায়ন

329

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

বিষয় ছিলো ‘চৎড়হড়সরহধষরংঃধঃরড়হ রহ ইবহমধষর’ (১৯৮৩) ইংরেজি ভাষাতেই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ ফিলমোর এর ঈধংব এৎধসসবৎ এবং চমস্কির অংঢ়বপঃ এর পরবর্তী মডেলের মিশ্র ভিত্তিতে গঠিত একটি কাঠামোতে বাংলা সর্বনাম প্রধান বাক্য গঠনের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেন।
হুমায়ুন আজাদ অবশ্য তার বিদেশে গবেষণার ফল দেশে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হননি তিনি বাংলা ভাষায় ‘বাক্যতত্ত্ব’ (১৯৮৫) নামে একখানি বড় গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন। গ্রন্থটিতে তিনি বাক্য, প্রথাগত বাক্যতত্ত্ব, সাংগঠনিক বাক্যতত্ত্ব সম্পর্কে প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদে বিশদ আলোচনার পর রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা এবং সেই তত্ত্ব বাংলা বিশেষ্য পদ এবং বাংলা সর্বনামীয়করণের ওপর প্রয়োগ করেছেন। পাঠকদের সুবিধার জন্যে পরিশিষ্টে তিনি প্রথাগত ব্যাকরণ এবং সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে দুইটি পরিচ্ছেদে আলোচনা রেখেছেন। গ্রন্থটি শেষ হয়েছে প্রথাগত, সাংগঠনিক ও রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের তুলনার মধ্য দিয়ে। ‘বাক্যতত্ত্ব’ গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ মূলত বাংলা বিশেষ্যপদ এবং সর্বনাম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, বাংলা ক্রিয়াপদ সম্পর্কে নয়।
হুমায়ুন আজাদ ‘প্রথাগত’, ‘সাংগঠনিক’ ও ‘রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ’ এর তুলনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান জন্মেছে প্রথাগত ব্যাকরণে প্রতিক্রয়ায় এবং রূপান্তর ব্যাকরণ উদ্ভুত হয়েছে প্রথাগত ব্যাকরণে প্রেরণায় ও সাংগঠনিক প্রণালির প্রতিক্রিয়ায়। সাংগঠনিকেরা প্রথাগত ব্যাকরণকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছিলেন : তাঁদের দৃষ্টিতে প্রথাগত ব্যাকরণ বিশৃঙ্খলা ও অবৈজ্ঞানিক। রূপান্তরমূলক ভাষা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রথাগত ব্যাকরণের চেয়েও দুর্বল সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান, কেননা তা ভাষার সৃষ্টিশীলতায় বিশ্বাস না করে ভাষার খন্ডাংশের বহিরঙ্গের বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। রূপান্তরবাদীরা সাংগঠনিক প্রণালি পরিত্যাগ করেছেন : তাঁদের বোধে সাংগঠনিক ব্যাকরণ ছদ্ম বৈজ্ঞানিক তা বিজ্ঞানের বহিরঙ্গের অনুকরণ করেছে মাত্র। রূপান্তর ব্যাকরণ পুনরায় যোগসূত্র রচনা করেছে প্রথাগত ব্যাকরণের সাথে। [কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’ (১৯৮৮)] বাংলাদেশে আরো যারা ভাষাতত্ত্ব চর্চায় রত তাদের মধ্যে রয়েছেন কাজী দীন মুহম্মদ, মনিরুজ্জামান, মনসুর মুসা, রাজীব হুমায়ুন, দানিউল হক, আজিজুল হক প্রমুখ। কাজী দীন মুহম্মদ লন্ডনের ঝঙঅঝ-এ ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন এবং বাংলা ব্যাকরণের ক্রিয়াবাচক পদের সংগঠনে ধ্বনিতাত্ত্বিক সূত্রসমূহ পরীক্ষা করেন। তাঁর অভিসন্দভার্ট ইংরেজি ভাষায় রচিত এবং তা ‘ঞযব ঠবৎনধষ ঝঃৎঁপঃঁৎব রহ ঈড়ষষড়য়ঁরধষ ইবহমধষর’. নামে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ক্রিয়াপদ ও তার ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ক এই গবেষণাটি বাংলা ভাষায় এখনও রূপান্তরিত বা প্রকাশিত হয়নি তবে ‘বাংলা ক্রিয়াপদ’ (বাএপ ১৪.৩ কা-পৌ), ‘বাংলা ক্রিয়া : ব্যাকরণ সংক্রান্ত শ্রেণীবিভাগ’ (সা প ৯.১ বর্ষা ১৩৭২) এবং ‘বাংলা ক্রিয়াপদের রূপ’ (সা প ১৯৬৫), এই তিনটি প্রবন্ধ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মহিশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর গবেষণা করেন। তাঁর বিষয় ছিলো ‘ঈড়হঃৎড়ষষবফ ঐরংঃড়ৎরপধষ জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ নধংবফ ড়হ ভরাব ইবহমধষর উরধষবপঃং.’ তিনি পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি প্রধান উপভাষার উপাদানের ভিত্তিতে পশ্চিম বাংলার ভাষার প্রতœ রূপ পুনগঠন এবং ভূ-চিত্র অঙ্কন করেন। তাঁর গবেষণা কমিটির বাংলা রূপান্তর এখনও প্রকাশিত হয়নি তবে বাংলায় ‘ভাষাতত্ত্ব অনুশীলন’ নামক তাঁর একটি প্রবন্ধ সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। এই সঙ্কলনে ‘বাংলাদেশে ভাষা ও উপভাষাতত্ত্বের অনুশীলন’, ‘সংস্কৃত ও রুশ ভাষা : তুলনা’ কুমিল্লা উপভাষায় ব্যক্তি সর্বনামরূপের ধ্বনিগঠন ও রূপমূল-সমস্যার বিকল্পতত্ত্ব’ প্রভৃতি ভাষাতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধাবলী রয়েছে। মনিরুজ্জামান ভারতের উদয়নারায়ণ সিংহের সঙ্গে যৌথভাবে মাঠ পর্যায়ে একটি গবেষণা কর্ম সম্পন্ন করেন, বিষয়টি ছিলো- টংরহম উরমষড়ংংরপ ঝঃুষব রহ ইবহমধষর রহ াবৎুরহম ংড়পরধষ পড়হঃবীঃং: অ পধংব ংঃঁফু ড়ভ ইধহমষধফবংয ইবহমধষববং.’ এ গবেষণা কর্মটি ইংরেজি ভাষায় উরমষড়ংংরধ রহ ইধহমষধফবংয ধহফ ষধহমঁধমব চষধহহরহম’ (১৯৮৩) নামক গ্রন্থে প্রকাশিত তবে এটি বাংলা ভাষায় এখনো রূপান্তরিত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনসুর মুসার ভাষাতত্ত্ব-চর্চা সাধারণভাবে সমাজভাষাতত্ত্ব এবং বিশেষভাবে ভাষা পরিকল্পনা বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভূত। তিনি ইংল্যান্ডের ইর্কশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে সিংহলের ভাষাপরিকল্পনা নিয়ে এবং হাওয়াই ইস্টওয়েস্ট সেন্টারে সমাজভাষাতত্ত্ব তথা ভাষাপরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা করেন। সিংহলের ভাষা পরিকল্পনাবিষয়ক তাঁর অভিসন্দর্ভটি অদ্যাবধি বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি। তবে সমাজভাষাতত্ত্ব তথা ভাষাপরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা করেন। সিংহলের ভাষা পরিকল্পনাবিষয়ক তাঁর অভিসন্দর্ভটি অদ্যাবধি বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি। তবে সমাজভাষাতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর দুটি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, যার প্রথমটি ‘ভাষা পরিকল্পনা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (১৯৮৪) এবং দ্বিতীয়টি ‘বাঙালা পরিভাষা : ইতিহাস ও সমস্যা’ (১৯৮৫)। ভাষা পরিকল্পনাবিষয়ক গ্রন্থটিতে মনসুর মুসার যেসব প্রবন্ধ রয়েছে তার মধ্যে ভাষা পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক হলো : ‘বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতি’, ‘তুর্কী ভাষা আন্দোলন’, ‘ঔপনিবেশিক ভাষানীতি প্রসঙ্গে’, ‘ভাষা পরিকল্পনা’, ‘বাংলা ভাষা ও প্রশাসনিক নির্দেশ’, বাংলা প্রচলন সংক্রান্ত বিবেচনা।’। মনসুর মুসার দ্বিতীয় গ্রন্থটি বাঙলা পরিভাষার ইতিহাস ও সমস্যা বিষয়ক। এ গ্রন্থে তিনি পরিভাষার সমস্যা এবং বাংলা ভাষায় পরিভাষা প্রণেতাদের মোটামুটি পরিচয় দিয়েছেন; তবে তা সংক্ষিপ্তভাবে : বাংলা ভাষায় পরিভাষা প্রণয়নে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পথিকৃৎ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’, ঐ প্রচেষ্টা বাংলা পরিভাষা প্রণয়নে কতটা অগ্রসর হতে পেরেছিলো গ্রন্থে তার পরিচয় থাকলে গ্রন্থের নামের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ হতো।
রাজীব হুমায়ুন ভাষাতত্ত্বে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন ডেকান কলেজ, পুনেতে। সেখানে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো ‘উবংপৎরঢ়ঃরাব অহধষুংরং ড়ভ ঝধহফরঢ়র রহ রঃং ঝড়পরড়- ঈঁষঃঁৎধষ পড়হঃবীঃ.’ এই গবেষণা কর্মটির একটি বাংলা সংস্করণ ‘সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাজীব হুমায়ুন শিষ্ট কথ্য বাংলার সঙ্গে সন্দীপের উপভাষার তুলনা এবং সন্দীপী উপভাষার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নির্দেশ করার প্রয়াস পান। তাঁর এই কাজটিকে বিশুদ্ধ সমাজ-ভাষাতাত্ত্বিক বলা না গেলেও তিনি যে উপভাষা বর্ণনায় সামাজিক প্রেক্ষাপটকে ভিত্তি করেছেন তা স্বীকার্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দানিউল হক হনলুলু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন এবং ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর কিছু বাংলা প্রবন্ধ এবং ‘ভাষার কথা : ভাষাবিজ্ঞান’ (১৯৯০) নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আজিজুল হক বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব অধ্যায়ন করেন এবং দেশে প্রত্যাবর্তন করে ‘ভাষাতত্ত্বের নতুন দিগন্ত’ (১৯৯০) নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থের আলোচ্য সূচিতে রয়েছে, ভাষা, ভাষাতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্বের কালান্তর, ভাষাতত্ত্বের নতুন দিগন্ত, সীমিত সূত্র ব্যাকরণ, বাক্যাংশ সংগঠন ব্যাকরণ, রূপান্তরিক ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্বের সাম্প্রতিক প্রগতি এবং প্রকৃতি, ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দার্থতত্ত্ব, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব এবং অসামাজিক ভাষাতত্ত্ব। ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৫ এই বিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে বাংলা ভাষায় যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর রচয়িতাগণ সকলেই বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব শাস্ত্রের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। তাঁরা সকলেই দেশে প্রত্যাবর্তন করে তাঁদের ভাষাতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ফল বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এর ফলে যে বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব-চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ গবেষকদের ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্লেষণ পদ্ধতি বিদেশি, যদিও স্বদেশে তাঁরা মূলত বাংলা ভাষাতেই ভাষাতত্ত্ব-চর্চা করছেন তবুও একথা বলা যাবে না যে দেশের জীবিত ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে কেউ ভাষাতত্ত্বের তাত্ত্বিক বা পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক অবদান রাখতে পেরেছেন। কালানুক্রমিক-তুলনামূলক, সমাজ-ভাষাতত্ত্ব যে কোনো পদ্ধতিতেই হোক না কেন তাঁরা এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে উদ্ভুত কোনো গবেষণা পদ্ধতির উদ্ভব ঘটাতে পারেননি, এমন কি তাঁরা কেউ আধুনিক পদ্ধতিতে বাংলা ভাষার একটি ব্যাকরণও রচনা করেননি। তাঁদের কৃতিত্ব ভাষাতত্ত্বের প্রায় প্রতিটি শাখায় বাংলা ভাষায় গবেষণা কর্ম পরিচালনা। কিন্তু এখন বোধ হয় সময় হয়েছে বাংলা ভাষা বিশ্লেষণের জন্যে বাংলা ভাষার ধারণা থেকে উদ্ভুত নিজস্ব পদ্ধতির উদ্ভাবনা এবং তার মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ। বিশেষত বাংলা ভাষায় খাঁটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, রচনা, যা ছাত্র-ছাত্রীদের কাজে লাগতে পারে বা বয়স্কদের কিভাবে অতি অল্প সময়ে বাংলা ভাষা পড়তে ও লিখতে শেখানো যায় সে পদ্ধতি উদ্ভাবন করা। তাহলে বাংলাদেশে ভাষাতত্ত্ব-চর্চায় সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা আসবে, অন্যথা তা উন্নত দেশগুলোর ভাষাতত্ত্ব-চর্চার অনুকরণ সর্বস্বটীকা ভাষ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট। (সমাপ্ত)