সন্ত্রাস প্রতিরোধে মহানবী (সা:)’র কৌশল

136

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
এরূপ করতে নিষেধ করেছেন।” “ইমাম ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, রিয়াদ: দারুত ত্বায়্যিবাহ লিন নাশরি ওয়াত তাওযী’, ১৯৯৯, খ. ৩, পৃ. ৪২৯”
ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন, স্বল্প-বিস্তর যতটুকুই হোক শান্তি স্থাপনের পর আল্লাহ পৃথিবীতে কম বা বেশি যাই হোক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন।” “ইমাম কুরতুবী, আল-জামি’ লি-আহকামিল কুরআন, রিয়াদ: দারু ‘আলামিল কুতুব, ২০০৩, খ.৭, পৃ. ২২৬”
অনর্থ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হতে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ যাহা তোমাকে দিয়েছেন তা দ্বারা আখেরাতের আবাস অনুসন্ধান করো এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলো না; তুমি অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ো না, আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালবাসেন না।” “আল-কুরআন, ২৮: ৭৭”
৪। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না।” “আল-কুরআন, ৬: ১৫১, ১৭: ৩৩” আদম সন্তানকে সম্মানিত ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন: “আমি তো আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; তাদেরকে উত্তম রিয্ক দান করেছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।” “আল-কুরআন ১৭:৭০” এত মর্যাদাবান ও অনুগ্রহপুষ্ট শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী সমগ্র মানবজাতির কোন এক সদস্যের প্রাণহানি ঘটানোকে সমগ্র মানবজাতির প্রাণহানী ঘটানোর সাথে তুলনা করে আল্লাহ বলেন: “এই কারণেই বনী ইসরাঈলের প্রতি এই বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা ব্যতীত কেউ কাউকেও হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল।” “আল-কুরআন, ৫: ৩২” অন্য আয়াতে আল্লাহ ইচ্ছাকৃত কোন মু‘মিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লা’নত (অভিশাপ) করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।” “আল-কুরআন, ৪: ৯৩”
৫। সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য অর্জনে আত্মঘাতি হামলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই হামলার মাধ্যমে সন্ত্রাসী তার নিজের জীবনকে ধ্বংস করে ফেলে। অথচ আল-কুরআনে নিজেকে ধ্বংস করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মঘাতি হামলা আত্মহত্যার শামিল, আর উভয়ই স্পষ্ট হারাম। আল্লাহ বলেন: “নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না। তোমরা সৎকাজ কর, আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণ লোকেদের ভালোবাসেন।” “আল-কুরআন, ২: ১৯৫।”
এভাবে আল-কুরআনুল কারীমে অসংখ্য আয়াতে অন্যায়ভাবে মানব হত্যা, আহত করা, আত্মহত্যা করা, অন্যের সম্পদ লুট করা, পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা, বিশৃঙ্খলা ঘটানোসহ সন্ত্রাসের বিভিন্ন রূপ, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট, পরিণাম, প্রতিরোধ, শাস্তি সম্পর্কে নির্দেশনা এসেছে। এসব আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে রাসূল (সা.) এর হাদীসে এ প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত নির্দেশনা পাওয়া যায়।
সন্ত্রাস প্রতিরোধে আল-হাদীসের নির্দেশনা ঃ সন্ত্রাস প্রতিরোধে আল-কুরআনে বর্ণিত নির্দেশনার আলোকে আল-হাদীসেও ব্যাপক নির্দেশনা এসেছে। প্রাসঙ্গিক কারণে কিছু হাদীস নিম্নে পেশ করা হলো-
১। রাসূল (সা.) বলেন: “বিবাহিতা ব্যভিচারী, হত্যার বদলে হত্যা এবং দ্বীন (ইসলাম) ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অপরাধ ব্যতীত ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্য দানকারী কোন অমুসলিমের রক্ত বৈধ নয়।” “ইমাম বুখারী সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়: আদদিয়াত, অনুচ্ছেদ: কওলুল্লাহ তা’আলা “ইন্নান নাফসা বিন নাফসি… হুম যালিমুন (আল- মায়িদাহ-৪৫), প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ২৫২১”২। সন্ত্রাস অর্থই হচ্ছে ত্রাস, ভয় আতঙ্ক সৃষ্টি করা, অন্যকে আতংকিত করা। কিন্তু আল-হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে, কোন মুসলিমকে আতংকিত করা বৈধ নয়। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেন: “কোন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিম ভাইকে আতংকিত বা সন্ত্রস্ত করা বৈধ নয়।“ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায়: আল আদাব, অনুচ্ছেদ: মাই ইয়াখুযুশ শাইআ‘আলাল মিযাহি,প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ৪৫৮”
৩। সন্ত্রাস একটি অন্যায় কর্ম। যে কোন অন্যায় কর্ম দেখে তা প্রতিরোধ করা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। সাধ্যানুযায়ী প্রতিরোধ প্রচেষ্টা পরিচালিত করার নির্দেশনা প্রদান করে রাসূল (সা.) বলেন: “তোমাদের মধ্যকার যে ব্যক্তি অন্যায় করতে দেখবে, সে যেন তাঁকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করে। যদি সম্ভব না হয় তাহলে কথা দ্বারা প্রতিবাদ করবে, তাও সম্ভব না হলে অন্তর দ্বারা প্রতিবাদ করবে। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।” “ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: আল ঈমান, অনুচ্ছেদ: বায়ানু কওলিন নাহয়ি আনিল মুনকারি মিনাল ঈমান…. ওয়াজিবানে, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ৬৯”
সন্ত্রাস সম্পর্কে উল্লেখিত আলোচনা থেকে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ইসলাম সমর্থনেতো করেই না, বরং তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যারা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে কিংবা ভীতি প্রদর্শন করে তারা প্রকৃতপক্ষে মুসলিম নয়। তারা ইসলামের তথা কুরআন ও হাদীসের রীতিনীতি ও নির্দেশনাকে বিসর্জন দিয়েছে। তেমনি বর্তমানে যারা ধর্মের নামে বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা করে নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে এবং বিভিন্ন ধরণের হুমকি দিয়ে মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে তারা মুসলিমদের দলভুক্ত নয়। তাদেরকে ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত মনে করে তাদের কোনো সহযোগিতা করা যাবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তোমরা সৎ ও তাকওয়াভিত্তিক কাজে একে অপরকে সহযোগিতা কর, পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা কর না।” আল-কুরআন, ৫:২ বরং তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।
সন্ত্রাস প্রতিরোধে রাসূল (সা.) এর কার্যক্রম ঃ মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে অশান্ত ও বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে শান্তি, শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ : “আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণা করেছি।” “আল-কুরআন, ২১: ১০৭।” এজন্য তিনি সর্বদাই বিশ্বে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন ও তৎপর ছিলেন এবং সন্ত্রাস, অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার প্রতিরোধে সমগ্র জীবন বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। রাসূল (সা.) একদিকে ছিলেন শান্তি স্থাপনকারীদের জন্য সুসংবাদদানকারী অপরদিকে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের জন্য ছিলেন সতর্কবাণী। আল্লাহ বলেন: “হে নবী! আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।” “আল-কুরআন, ৩৩: ৪৫-৪৬”
উজ্জ্বল প্রদীপরূপী রাসূল (সা.) তাঁর সমগ্র জীবনে যে আদর্শ বাস্তবায়িত করেছেন, তা অনুসরণের মাধ্যমে আজো পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আদর্শ অনুকরণীয় হিসেবে রাসূল সা. কেই গ্রহণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: “তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূল (সা.) এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” “আল-কুরআন, ৩৩: ২১”
সামাজিক বন্ধনহীন পরিস্থিতি, অস্থির ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ, বলগাহীন নেতৃত্ব, শঠতা, প্রবঞ্চনা, হত্যা, লুটতরাজ প্রভৃতি অকল্যাণকর কার্যকরণের ফলশ্র“তিতে আরবের গোত্রে গোত্রে কলহ বিবাদ, যুদ্ধ বিগ্রহ সর্বত্র স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। মানুষের শান্তিময় জীবন মারাত্মকভাবে লংঘিত হতে থাকলে জনসাধারণ এই অশান্ত অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। উদ্বিগ্ন মানুষের উদ্বেগকে দূর করার জন্য রাসূল (সা.) যে কার্যক্রমসমূহ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে সর্বপ্রথম দূর করার জন্য রাসূল (সা.) যে কার্যক্রমসমূহ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে সর্বপ্রথম ছিল “হিলফুল ফুযুল” নামক চুক্তি সম্পাদন। রাসূল (সা.) এর বয়স যখন ১৫ বছর, “আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর- রাহীকুল মাখতুম, অনু. “খাদিজা আখতার রেজায়ী, ঢাকা: আল কোরআন একাডেমী লন্ডন (পরিবেশিত), ১৯৯৯, পৃ. ৭৫” এই যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী হাশিম সম্প্রদায়ের নেতা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র জুবাইরের প্রস্তাবে মক্কার আব্দুল্লাহ ইবনে জাদ’আনের বাসভবনে বনী হাশিম, বনী যুহরা, বনী তাঈম, বনী মুত্তালিব, বনী আসাদ গোত্রের সকললে সম্মিলিতভাবে অন্যায়, অত্যাচার, সন্ত্রাস প্রতিরোধ করতে ঐকমত্যে উপনীত হয় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। মুহাম্মাদ সা. এই চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেন। চুক্তিটিকে ইতিহাসে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে অভিহিত করা হয়। “মো. আব্দুল কাসেম, মানবশ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) রাজশাহী: “মোসা. হোসনে আরা বেগম, ২০০৫, পৃ. ৬৭” “আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬” এই চুক্তিতে আবদ্ধ গোত্রসমূহ যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার সারমর্ম হলো:
১। আমরা দেশের অশান্তি দূর করার নিমিত্ত যথাসাধ্য চেষ্টা করব। ২। বিদেশী লোকদের ধন-প্রাণ ও মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। ৩। দরিদ্র ও অসহায় লোকদের সহায়তা করতে আমরা কখনই কুণ্ঠিত হবো না। ৪। অত্যাচারী ও তার অত্যাচারকে দমাতে ও ব্যাহত করতে এবং দুর্বল দেশবাসীদেরকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করব। “মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা-চরিত, ঢাকা: কাকলী প্রকাশনী, নবম মুদ্রণ, ২০১০, পৃ. ১৮৮” এই প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী হিলফুল ফুযুলের সদস্যগণ বহুদিন যাবৎ কাজ করতে থাকেন। এই সেবা- সংঘের প্রচেষ্টায় দেশের অত্যাচার অবিচার বহুলাংশ হ্রাস পেলো, রাস্তাঘাট নিরাপদ হয়ে উঠল। রাসূল (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুযুল সংঘ ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ইসলামের আগমনের পর এই সেবা সংঘ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল। কারণ, সকল প্রকার অন্যায়, অমঙ্গল ও পাপের মূলোৎপাটন করার এবং সর্বাধিক ন্যায়, মঙ্গল ও পুণ্য সাধনের দায়িত্ব নিয়ে যখন ‘ইসলাম’ আত্মপ্রকাশ করল তখন আর উক্ত সেবাসংঘের কোন প্রয়োজনই রইল না। “শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মদ তাফাজ্জল হোছাইন, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) সমকালীন পরিবেশ ও জীবন, সম্পাদনা: ড. এ.এইচ. এম মুজতবা হোছাইন, ঢাকা: ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, ২০০৯, পৃ. ২০১।”
সন্ত্রাস প্রতিরোধে তরুণ বয়সে মুহাম্মদ (সা.) যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার বাস্তবায়ন তার সমগ্র জীবনে পরিলক্ষিত হয়। তিনি নবুওয়াত পাওয়ার পরেও এই প্রতিজ্ঞার কথা ভুলেননি। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির পর কোন একদিন বলেন: “আজও যদি কোন উৎপীড়িত ব্যক্তি “হে ফুযুল প্রতিজ্ঞার ব্যক্তিবর্গ’ বলে ডাক দেয়, আমি অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দেব। কারণ, ইসলাম এসেছে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং উৎপীড়িত, অত্যাচারিতকে সাহায্য করতে। “মোহাম্মদ আকরম খাঁ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৮” এভাবে মহানবী (সা.) মক্কানগরী থেকে অন্যায়, অত্যাচার ও সন্ত্রাস দূর করে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং পরবর্তী সময়ের জন্য সন্ত্রাস প্রতিরোধের আদর্শ রেখে গিয়েছেন।
রাসূল (সা.) নবুওয়াত লাভের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত অহীভিত্তিক ফর্মূলা অনুযায়ী বিশ্বকে গড়ে তোলার জন্য সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত করেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস কোন সাফল্যজনক পদ্ধতি হতে পারে না। বিশেষ করে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদ যদি সমাজে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়ে পড়ে-যেমনটি মহানবী (সা.) এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবে হয়েছিল, তাহলে সন্ত্রাস নির্মূলে সন্ত্রাসী নির্মূলের নির্বুদ্ধিতাগত নীতির ফলে পুরো সমাজটাকেই প্রায় নির্মূল করে ফেলতে হবে। আবার সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করার কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বসে থাকলে সন্ত্রাস ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। উভয় অবস্থায়েই সমাজের সর্বনাশ অনিবার্য। তাই মহানবী (সা.) সন্ত্রাস প্রতিরোধে মধ্যপন্থা গ্রহণ করেছিলেন। বিশ্ব থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করে তথায় শান্তি স্থাপনের চেষ্টায় মহানবী (সা.) তাঁর সমগ্র নবুওয়াতী জীবন ব্যয় করেছিলেন। সন্ত্রাস প্রতিরোধ বা নির্মূলে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পদক্ষেপ অগণিত। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো- ক. বাই’আতে আকাবা ঃ নবুওয়াতের দ্বাদশ বছর হজ্ব উপলক্ষে মক্কায় আগত লোকদের মধ্যে ১২ জন রাসূল (সা.) এর সাথে আকাবা নামক স্থানে সাক্ষাৎ করলে তারা তাঁর নিকট ইসলাম গ্রহণপূর্বক অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিত্যাগ করার অঙ্গীকার করলেন। এই অঙ্গীকার গ্রহণ অনুষ্ঠানকে আকাবার প্রথম বাইয়াত বলা হয়। “ইবনে হিশাম, সীরাতে ইবনে হিশাম, অনু. আকরাম ফারুক, ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ২০০৩, পৃ. ১১৫” এই বাইআতে সাহাবাগণ যে বিষয়গুলোর উপর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তার বিবরণ দিয়ে বাই’আতের অন্যতম সদস্য উবাদা ইবনুস সামিত (রা.) বলেন : “আমরা রাসূল (সা.) এর সাথে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার (শরীক) করবো না, চুরি-ডাকাতি করবো না, ব্যভিচার করবো না, সন্তান হত্যা করবো না, কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটাবো না এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর অবাধ্যতা করবো না। অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন: “এসব অঙ্গীকার পূরণ করলে তোমাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। আর এর কোন একটি ভঙ্গ করলে তোমাদের পরিণতি আল্লাহর হাতে ন্যস্ত থাকবে। ইচ্ছে করলে মাফ করে দিবেন, ইচ্ছা করলে তিনি শাস্তি দিবেন। “ইমাম বুখারী, সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়: ফাযায়িলুস সাহাবা, অনুচ্ছেদ: উফুদুল আনসার ইলান নাবিয়্যি (সা.) বি মাক্কাতা ওয়া বাই’আতুল আকাবা, প্রাগুক্ত, খ. ৩, পৃ. ১৪১৩” এই প্রতিজ্ঞার বিষয়াবলীর সবগুলোই প্রত্যক্ষভাবে সন্ত্রাসের সাথে সম্পৃক্ত। তাই মহানবী (সা.) সন্ত্রাস প্রতিরোধে সর্বপ্রথম তার সাহাবাদেরকে সকল সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন, যার ফলে পরবর্তীকালে মক্কা-মদীনাসহ সমগ্র ইসলামী বিশ্ব থেকে সন্ত্রাস নির্মূল হয়েছিলো।                                                   (চলবে)