ইসলামী চিন্তা-গবেষণার গুরুত্ব

157

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

(পূর্ব প্রকাশের পর)
সামাজিক প্রথা ও প্রচলনের প্রতি দৃষ্টিদান : ফকীহগণ ইসলামী আইন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রথা ও প্রচলনকে গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করেছেন, যার দৃষ্টান্ত অসংখ্য যেমন-রজ:স্রাব ও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময়কাল, গর্ভধারণের মেয়াদ, যেসব অপবিত্রতাকে ক্ষমা করা হয়েছে, শপথ, অঙ্গীকার, অসীয়ত ইত্যাদি। ইসলামী বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রথার গুরুত্ব প্রমাণিত হয় ফিকহী মূলনীতি ‘রীতি ও বিবেচ্য বিধান’ থেকে যা মূলত ইবনে মাসউদ (রা.) এর উক্তি-“মুসলমানগণ যা ভালো মনে করেন আল্লাহর কাছেও তা ভালো। আর তারা যা খারাপ মনে করেন তা আল্লাহর কাছেও খারাপ”। “ইবনে হাম্বল, আহমদ, ইমাম, আল-মুসনাদ, বিশ্লেষণ: শুয়াইব আরনোট ও অন্যান্য, বৈরূত: মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি. পৃ. ৮৪। এর আলোকে প্রণীত। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞগণ ৪টি বিশেষ শর্ত প্রদান করেছেন। “ইবনে নুজাইম, যয়নুদ্দীন ইবনে ইবরাহীম, আল-আশবাহ ওয়ান নাজায়েয, বিশ্লেষণ: মুহাম্মদ সুয়ূতী, জালালুদ্দীন আব্দুর রহমান, আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ের, বৈরূত: দারুল কিতাব আল-আরাবী, ১৪০৭ হি. পৃ. ১৯২-১৯৩।
১. সামাজিক প্রথাটি ব্যাপক সমাদৃত থাকা। ২. প্রথাটি প্রচলনের শুরু থেকে অদ্যাবধি অবিকৃত অবস্থায় থাকা। ৩. উক্ত প্রথার বিপরীতে ভিন্ন কোন প্রথা চালু না থাকা। ৪. প্রথাটি শরীয়াতের স্পষ্ট বিধান বিরোধী না হওয়া।
শরীআহ অভিযোজন (ঝযধৎরযধ অফধঢ়ঃধঃরড়হ) : শরীআহ অভিযোজন বর্তমান সময়ে ব্যাপক ব্যবহৃত একটি ফিকহী পরিভাষা। প্রাচীন ফিকহের কিতাবে এ পরিভাষার কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না, তবে কাছাকাছি কিছু পরিভাষা আছে, আধুনিক সময়ে আলিমগণ বিভিন্নভাবে এই পরিভাষাটি সংজ্ঞায়িত করেছেন। ড. ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন, শরীআহ অভিযোজন অর্থ উদ্ভূত পরিস্থিতির উপর শরঈ নস প্রয়োগ। “কারযাভী, ড. ইউসুফ আব্দুল্লাহ, আল-ফাতওয়া বাইনাল ইনদিবাত ওয়াত তাসঈব, কুয়েত: দারুল কালাম, ১৪০২ হি, পৃ. ৭২’’। কোন মাসআলার শরীআহ অভিযোজন অর্থ উক্ত মাসআলাটিকে (শরীআহ বিরোধী বিধান থেকে) মুক্তকরণ ও তাকে নির্দিষ্ট গণ্য দলীলের সাথে সম্পৃক্তকরণ। “কুলআহ, ড. মুহাম্মদ রিওয়াস ও কুনাইবী, ড. হামিদ সাদিক, মুজামু লুগাতিল ফুকাহা, বৈরুত: দারুন্ নাফাইস, ১৪০৮ হি. পৃ. ১৪৩। এক কথায়, সাম্প্রতিক কোন বিষয়কে শরীআহ’র রঙে রঙিন করাকে বলা হয় শরীআহ অভিযোজন। অর্থাৎ, যেসব বিষয়ে শরীআহ’র সাথে সাংঘর্ষিক কিছু নেই তাকে শরীআহ’র বিধানের সাথে খাপ খাওয়ানো বা শরীয়াতের বিধানের সাথে তার যোগসূত্র স্থাপন।
শরীআহ অভিযোজনের গুরুত্ব : আধুনিক সময়ের ফকীহগণের নিকট দু’টি কারণে শরীআহ অভিযোজন শব্দটি বিশেষ গুরুত্ববহ। প্রথমত, সাম্প্রতিক বিষয়গুলো সমকালীন সর্বশেষ অবস্থাসমৃদ্ধ। পূর্ববর্তী ফিকহের কিতাবে যে সম্পর্কে কোন আলোচনা বিদ্যমান নেই। আবার বিষয়গুলো জটিল, দুর্বোধ্য অথচ জীবনঘনিষ্ঠ। এ কারণে এর বিধান নির্ণয় কষ্টসাধ্য। কেননা এক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা প্রয়োজন। অতএব শরীআহ অভিযোজন উক্ত পরিক্রমার একটি পদক্ষেপ ও পর্যায়। “আল-আওদাহ, সালমান ইবনে ফাহাদ, জাওয়াবিতুত দিরাসাত আল-ফিকহিয়্যাহ, তা. বি. পৃ. ৮৯।
দ্বিতীয়ত, বিগত কয়েক যুগে সভ্যতার উন্নতি ও সমাজব্যবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে ইতিহাসে এর কোন দৃষ্টান্ত নেই। এসব উন্নতি ও পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে যেসব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কিত বিধান গবেষণা করার মত ‘মুজতাহিদ মুতলাক’ (স্বাধীন ও স্বতন্ত্র চিন্তার অধিকারী শরীআহ উদ্ভাবক) এর অভাব এবং মাযহাবী মুজতাহিদের সংখ্যাধিক্যের কারণে শরীআহ অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা সাম্প্রতিক বিষয়ে বৈশিষ্ট্য, এর গুণাগুণ বিবেচনা ও তাকে রূপায়নের ক্ষেত্রে এর স্পষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
শরীআহ অভিযোজনের সময় লক্ষণীয় : ক. শরীআহ অভিযোজন শরীআহ’র মূলনীতির ভিত্তিতে শুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে হতে হবে। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিকটতম মূলনীতির মাধ্যমে অভিযোজনক করা যাতে ঐ মূলনীতির বিধানকে উক্ত বিষয়ের বিধান হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এতে কোন জটিলতা নেই। বরং জটিলতা তখনই দেখা দেবে যদি অসামঞ্জস্য মূলনীতির মাধ্যমে অভিযোজন করা হয়। খ. পরিস্থিতিকে শুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ রূপায়নের জন্য সাধনা করা। বিষয়টি গবেষক, বিচারক ও আইন বিশ্লেষকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কিছু বিধান উক্ত বিষয়ের রূপায়ণেরই একটি অংশ। অতএব যে ব্যক্তি সাম্প্রতিক বিষয় রূপায়ণ করবে তার উচিত এর পূর্ণ ও শুদ্ধ রূপায়ণ করা এবং ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অবস্থা, শাখা-প্রশাখা, মূলনীতি ইত্যাদি অবগত হওয়া। গ. মুজতাহিদকে মাসআলা উপস্থাপন ও মূলনীতির সাথে একীভূতকরণের ফিকহী যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। “কাহতানী, ড. মুফসির, মানহাজু ইসতিখরাজ আল-আহকাম আল-ফিকহিয়্যাহ লিন নাওয়াযিল আল-মুআসারাহ, মক্কা: উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০০, খ. ১, পৃ. ৩৯৭-৪০৪ (সংক্ষিপ্ত)।
সম্মিলিত ইজতিহাদ: ইসলামী আইন গবেষণার ক্ষেত্রে সম্মিলিত ইজতিহাদ একটি নতুন মাত্রা। ইসলামের প্রাথমিক যুগসমূহে মুসলিম পন্ডিতগণের অক্লান্ত পরিশ্রম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাদের পারদর্শিতার ফলে ব্যক্তিগত বা একক গবেষণার মাধ্যমে সফলতার সাথে তৎকালীন বিভিন্ন বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয় সম্ভব হলেও বর্তমান সময়ে তা কষ্টসাধ্য। কোরআন-সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ’র দুর্বল অবস্থানের কারণে শেষের শতাব্দীগুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার সেই সোনালী সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। যার প্রেক্ষিতে সঠিক ইজতিহাদ করার মত প্রজ্ঞাবান আলিম এর ব্যাপক অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে বর্তমানে একক গবেষণার সাম্প্রতিক বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয়ের যোগ্যতাসম্পন্ন গবেষকের অভাব মুসলিম বিশ্বের প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে বর্তমান সময়ে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চিন্তা-চেতনার জগতে বিরাট বিপ্লব সাধিত হওয়ায় জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন দিক নিয়ে ইজতিহাদ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহ সম্মিলিত ইজতিহাদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে।
সম্মিলিত ইজতিহাদ কী? : সম্মিলিত ইজতিহাদ একটি আধুনিক ফিকী পরিভাষা। পূর্ববর্তী উসূলের কিতাবসমূহে এ বিষয়ক স্বতন্ত্র কোন অধ্যায় পাওয়া যায় না। সম্মিলিত ইজতিহাদের পরিচয়ের জন্য ইজতিহাদের সংজ্ঞা আবশ্যক। বিভিন্ন গ্রন্থে ইজতিহাদের অসংখ্য সংজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা ইমাম ফাতুহী র. এর সংজ্ঞাটিকে অধিকতর প্রণিধানযোগ্য সাব্যস্ত করতে পারি। তিনি বলেন ‘কোন বিষয়ের শরঈ বিধান অর্জনের জন্য ফকীহ কর্তৃক তার শক্তি ব্যয় করা।’ “ফাতহী, ইবন নাযযার, শারহু আল-কাওকাব আল-মুনীর, বিশ্লেষণ: ড. মুহাম্মদ আল-যুহাইলী ও ড. নাযিয়াহ আল-হাম্মাদ, মক্কা: উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪১৩ হি. খ. ৪, পৃ. ৪৫৮। বর্তমান সময়ের কেউ কেউ সামষ্টিক ইজতিহাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যেমন- * ড. আব্দুল মাজীদ শারফী বলেন, বিধান উদঘাটনের পদ্ধতির আলোকে কোন বিষয়ের শরঈ বিধান সম্পর্কে ধারণা অর্জনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহ কর্তৃক চেষ্টা সাধনা এবং পরামর্শের পর উক্ত বিধানের উপর তাদের সকলের বা অধিকাংশের ঐক্যমত। “শারফী, ড. আব্দুল মাজীদ, আল-ইজতিহাদ আল-জামায়ী ফীত তাশরীঈ আল-ইসলামী, মক্কা: কুতুবুল উম্মাহ সিরিজ- ৬২, ১৪১৮ হি. পৃ. ৪৬। * ড. আল-আবদু খলীল বলেন, কোন বিষয়ের শরঈ বিধানের উপর কোন যুগের উম্মতে মুহাম্মাদীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুজতাহিদের ঐক্যমত। “খলীল, ড. আল-আবদু, আল-ইজতিহাদ আল-জামায়ী ফী হাজাল আসর, জর্ডান: জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ, সংখ্যা-১০, ১৯৮৭, পৃ. ২১৫। প্রকৃতপক্ষে সম্মিলিত ইজতিহাদ হচ্ছে- কোন বিষয়ের শরঈ বিধান নির্ণয়ের জন্য একদল আলিমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং পারস্পরিক পরামর্শ ও পর্যালোচনান্তে উক্ত বিষয়ের উপর ঐক্যমত্য স্থাপন করাকে সম্মিলিত ইজতিহাদ বলা হয়। যেমন ইসলামিক ফিকহ একাডেমী জিদ্দায় করা হয়ে থাকে।
বর্তমান সময়ে সম্মিলিত ইজতিহাদের গুরুত্ব: এ কথা অনস্বীকার্য যে, কোন বিষয়ে একক কোন ব্যক্তির চিন্তা- চেতনা ও মতামতের চেয়ে উক্ত বিষয়ে একদল মানুষের চিন্তা-চেতনা ও গবেষণার সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়ক। তা ছাড়া পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে সঠিক বিষয়টিই বেরিয়ে আসা স্বাভাবিক। এ কারণেই শূরা (পরামর্শ) থেকে নির্গত ফলাফল অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, “সকল কাজে তাদের সাথে পরামর্শ করে, অত:পর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর।” আল কোরআন, ৩: ১৫৯।
যেসব কারণে বর্তমান সময়ে সম্মিলিত ইজতিহাদ গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে রয়েছে-
ক. একক গবেষণার তুলনায় সম্মিলিত গবেষণা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেননা সমকালীন বড় বড় আলিম, গবেষক, বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে সামগ্রিক দিক পর্যালোচনার মাধ্যমে সম্মিলিত ইজতিহাদ সম্পন্ন হয়। খ. সম্মিলিত ইজতিহাদ ইজতিহাদকে চলমান রাখে এবং তা বন্ধ হওয়া রোধ করে। ইজতিহাদ ইসলামী আইনের একটি মৌলিক বিষয় ও ইসলামের গতিশীলতা প্রমাণের প্রধান অবলম্বন। গ. সম্মিলিত ইজতিহাদ মুসলিম উম্মাহ’র ঐক্যের পথ সুগম করে। কারণ মুসলিম উম্মাহ’র আলিমগণ একত্রিত হয়ে গবেষণা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা সমাধানে ব্রতী হয়। আর জনসাধারণ তাদের নির্ণীত বিধানের সাথে একমত হয়ে অনুসরণ করেন। যার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ’র ঐক্য ফুটে ওঠে।
সাম্প্রতিক বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সম্মিলিত ইজতিহাদের গুরুত্ব বর্ণনা করে ড. ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন, আধুনিক বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইজতিহাদকে সামষ্টিক ইজতিহাদের উন্নীত করতে হবে। যে পদ্ধতিতে আলিমগণ উক্ত উত্থাপিত বিষয়ে বিশেষত সাধারণ জনগণ যার অনুসরণ করবে সে বিষয়ে পরামর্শ ও পর্যালোচনা করবেন। নিশ্চয় একক মতামতের চেয়ে একদল মানুষের চিন্তা-গবেষণা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর উপযোগী। “আল-কারযাভী, ড. ইউসুফ আব্দুল্লাহ, আল-ইজতিহাদ ফীশ শরীআহ আল-ইসলামিয়্যাহ, কুয়েত: দারুল কলম, ১৪১০ হি, পৃ. ১৮২।
ড. মুফসির কাহতানী তার গ্রন্থে শেখ মোস্তফা আল-যারকাহ এর উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, অতীতে ব্যক্তিগত ইজতিহাদের প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে তা বরং ক্ষতিকর, যা হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মাযহাবের ফকীহগণ ইজতিহাদের দরজা রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সমসাময়িক সমস্যা সমাধানের একমাত্র অবলম্বন ইজতিহাদ এক্ষেত্রে আমাদেরকে ইজতিহাদের নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। আর তাহল ব্যক্তিগত ইজতিহাদের পরিবর্তে সম্মিলিত ইজতিহাদ এবং এর মাধ্যমে আমরা ইজতিহাদের প্রথম পথ চলা অর্থাৎ আবু বকর ও উমর (রা.) এর যুগে ফিরে যাব। “কাহতানী, ড. মুফসির, মানহাজু ইসতিখরাজ, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ২৭৮ (সংক্ষিপ্ত)।
সাম্প্রতিক বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয়ের পদ্ধতি: সাম্প্রতিক বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের পদ্ধতি অবগত হতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের ক্রমধারায় এ সংক্রান্ত পদ্ধতিগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। ইসলামী আইনের প্রাথমিক যুগগুলোতে কীভাবে সাম্প্রতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হত নিম্নে সংক্ষেপে তা বিধৃত হল- সাম্প্রতিক বিষয়ে সিদ্ধান্তদানে মহানবী সা. এর পদ্ধতি মহানবী (সা.) এর সময়ে সাম্প্রতিক বিষয়ে সিদ্ধান্তদান মূলত দু’টি বিষয়নির্ভর ছিল।
১. ওহী মাতলু বা কোরআন: পবিত্র কোরআন সাধারণত সাম্প্রতিক অবস্থার বিশ্লেষণ, মুসলমানদের করণীয় বা তৎসংশ্লিষ্ট বিধান নিয়ে অবতীর্ণ হতো, যাকে উক্ত অংশ অবতরণের কারণ বা ‘শানে নুযুল’ বলা হয়। অতএব কোরআন অবতরণের সময়কালে উদ্ভূত যে কোন পরিস্থিতির বিধান সরাসরি কোরআন থেকে পাওয়া যেত।
২. ওহী গায়র মাতলু বা সুন্নাহ: যাকে রাসূল (সা.) এর বাণীমূলক, কর্মসূচক ও মৌনসম্মতিমূলক সুন্নাহ বলা হয়। “ইবনে খালদুন, আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ, মুকাদ্দামাহ, ব্যাখ্যা ও ভূমিকা: ড. মুহাম্মদ আল-ইসকিন্দারানী, বৈরূত: দারুল কিতাব আল-আরাবী, ১৪১৭ হি. পৃ. ৪১৮-৪১৯। সাম্প্রতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত দানের ক্ষেত্রে ওহী গায়র মাতলুর যেসব পদ্ধতি গ্রহণ করা হত তার মধ্যে রয়েছে-
ক. রাসূল (সা.) কোরআনের ব্যাখ্যা করতেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন: ‘আপনার প্রতি আমি স্মরণিকা অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐসব বিষয় ব্যাখ্যা করেন, যেগুলো তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। “আল-কোরআন, ১৬: ৪৪। এ কারণে মহানবী (সা.) কোরআনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করতেন, এর বিধান বাস্তবায়ন করতেন, এর আলোকে বিভিন্ন বিধান প্রয়োগ করতেন। এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে কোন কোন বিধান রহিত করতেন। খ. উদ্ভূত বিষয়ের বিধান তিনি নিজেই প্রদান করতেন। বিশেষত যেসব বিষয়ের কোন বিধান কোরআনে আসেনি। রাসূল (সা.) এর ঘোষিত বিধানের মধ্যে রয়েছে দাদীর উত্তারধিকার, যাকাতুল ফিতর বা ফিতরা, বিতরের সালাত ইত্যাদি। “ইবনে খালদুন, মুকাদ্দামাহ, প্রগুক্ত, পৃ. ৪১৮। গ. উদ্ভূত বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের জন্য মহানবী সা. সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করতেন। যেমন- বদরের যুদ্ধবন্দীদের ক্ষেত্রে তিনি এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। “মুসলিম, ইমাম, আস-সহীহ, প্রাগুক্ত, অধ্যায়: আল জিহাদ, জিহাদ ওয়াস সিয়ার, অনুচ্ছেদ: ইমদাদ বিল মালাইকাতি ফী গাযওয়াতে বদর, তা. বি. খ. ৫, পৃ. ১৫৬। সাম্প্রতিক বিষয়ে সিদ্ধান্তদানে সাহাবীগণের পদ্ধতি মহানবী (সা.) এর ইন্তিকালের পর সাহাবীগণ সাম্প্রতিক বিষয়ের সিদ্ধান্তদানের ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ’র পাশাপাশি আরো কিছু নতুন পদ্ধতি যুক্ত করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
ক. ইজমা বা সম্মিলিত ইজতিহাদ: সাম্প্রতিক বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিটি মহানবী (সা.) এর ইন্তিকালের পরপরই প্রয়োগ শুরু হয়। যার মাধ্যমে আবু বকর (রা.) কে খলিফা নির্বাচন করা হয়। এ পদ্ধতির আলোকে সাহাবীগণ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিধান নির্ণয় করেছিলেন তার মধ্যে রয়েছে- “আল-মারাগী, আব্দুল্লাহ মুস্তফা, আল-ফাতহুল মুবীন ফী তাবাকাতিল উসূলিয়্যিন, বৈরূত: মুহাম্মদ আমীন দামিজ, ১৩৯৪ হি. খ. ১, পৃ. ১৯, ২১।
১. আবু বকর (রা.) কে খলীফা নির্বাচন। ২. কোরআন সংকলনের অপরিহার্যতা। ৩. যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ৪. মদ্যপের শাস্তি ৮০ বেত্রাঘাত নির্ধারণ।
খ. কিয়াস: সাহাবীগণের যুগে এ পদ্ধতিটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। এমনকি সাম্প্রতিক বিষয়ের বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতি ছিল কোরআন ও সুন্নাহ থেকে সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়ের বিধানের আলোকে নতুন বিষয়ের বিধান উদ্ভাবন করা। বিভিন্ন বিষয়ে সাহাবীগণের কৃত কিয়াসের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করতে যেয়ে অনেক উলূসবিদ তাদের গ্রন্থে এ সংক্রান্ত পৃথক অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। “ইবনে কাইয়্যিম, ইলামুল মুয়াক্কিইন, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ২০১৩-২০৫, ইবনে খালদুন, মুকাদ্দামা, প্রাগুক্ত। গ. সাহাবীগণের অভিমত: সাহাবীগণ বিশেষত উমর (রা.) অন্য সাহাবীগণের বাণীর ভিত্তিতে অনেক নতুন বিষয়ের সমাধান দিতেন। বর্ণিত আছে, তাঁর সামনে নতুন কোন বিষয় উপস্থাপিত হলে তিনি আগে দেখতেন এর বিধান কোরআন ও সুন্নাহর রয়েছে কিনা। যদি না থাকত তবে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, আবু বকর কি এ জাতীয় কোন বিষয় ফয়সালা করেছিলেন? যদি আবু বকর (রা.) কৃত এমন কোন ফসালা থাকত তবে তিনি তার অনুসরণ করতেন। “বায়হাকী, আহমদ ইবন হুসাইন, আস-সুনান আল-কুবরা, বিশ্লেষণ: মুহাম্মদ আব্দুল কাদির আতা, মক্কা: মাকতাবাহ দারুল বায়, ১৪১৪ হি. অধ্যায় আদাবুল কাযী, অনুচ্ছেদ: মা ইকদী বিহিল কাযী ওয়া মা ইফতি বিহিল মুফতী, খ. ১০, পৃ. ১১৪। এছাড়াও অনেক সাহাবীর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ বর্ণনা রয়েছে যে, তাঁরা বড় বড় সাহাবীর মতামত অনুকরণ করে ফয়সালা করতেন। “ইবনে কাইয়্যিম, ইলামুল মুয়াক্কিইন, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ১৪-২২। এ যুগে কিয়াসের মাধ্যমে নতুন বিষয়ের ইসলামী বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দু’টি নতুন বিষয়কে বিবেচনায় আনা হয়েছিল। “আল-কারাফী, শিহাবুদ্দীন আবুল আব্বাস ইবনে ইদরীস শারহু তানকীহুল ফুসুল ফী ইখতিসারিল মাহসুল ফী উসূল, বিশ্লেষণ: তাহা আব্দুর রউফ সায়াদ, কায়রো: দারুল ফিকর, ১৩৯৩ হি, পৃ. ৪৪৬। আর তা হল, মাসালিহ মুরাসালাহ “মাসালিহ মুরাসালা’’ বলা হয়, শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্যের অনুরূপ কার্য সম্পাদন যা গৃহীত বা বাতিলকৃত হওয়ার ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট বিধান পাওয়া যায় না। ‘‘আবু যাহরা, ইমাম মুহাম্মদ, উসূল আল-ফিকহ, আল-কাহেরা: দারুল কিতাব আল- আরাবী, ১৯৫৭ পৃ. ২৬১। ও সাদ্দুজ জারাঈ “যেসব উপায়-উপকরণ ক্ষতিকর ও শান্তি বিঘœকারী নিষিদ্ধ কর্ম সম্পাদনে প্রলুদ্ধ করে সেসব কর্মের পথ রূদ্ধ করার নাম সাদ্দুজ জারাঈ। আয-যুহায়লী, ড. ওহাবাহ, উসূল আল-ফিকহ, দামিশক: দারুল ফিকর, ১৪০৬ হি. খ. ২, পৃ. ৮৭৪’’। (চলবে)