বীরাঙ্গনার আত্মকথন

12

শাহানাজ পারভীন :

উপমা পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। এক চুমুকেই পান করলো অমৃত বারি। উত্তপ্ত অন্তর শান্ত হলো শীতল জলে।তারপর চেয়ারটা টেনে বসলো বারান্দায়। হাতে ছিল রবি ঠাকুরের কবিতা। দোল খাচ্ছিলো আর কবিতা পড়ছিল উচ্চস্বরে।
” লও তার মধুর সৌরভ
দেখো তার সৌন্দর্য্য বিকাশ
মধু তার করো তুমি পান
ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী
চেয়েনা তাহারে
আকাক্সক্ষার ধন হে মানবের”।
দীপ্ত চুপি চুপি এসে দাঁড়ালো উপমার পিছনে।উপমা টের পায়নি। সে তন্ময় হয়ে কবিতা পড়ছিল। পড়া শেষ হতেই হাত তালি দিল দীপ্ত।
মিষ্টি হেসে বলল, কী রে কখন এলি?
দীপ্ত : এই তো কিছুক্ষণ।
উপমা : ডাকিস নি কেন?
দীপ্ত : তোর মন:সংযোগ নষ্ট করতে চাইনি। তাছাড়া ডাকলে কী তোর মিষ্টি কন্ঠের আবৃত্তি শোনা যেতো?
উপমা: কী রে ব্যঙ্গ করছিস নাকি?
দীপ্ত: তোকে ব্যঙ্গ করার সাহস কার!
উপমা: বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু!
তারপর আরেকটা চেয়ার টেনে বলল, বোস। দুজন মুখোমুখি হয়ে বসলো।
উপমা লাইন কয়টা আবার পড়ে শোনালো।
দীপ্ত মায়া চোখে উপমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে গেল। উপমার ডাকে সম্বিৎ ফিরে এলো।
দীপ্ত: কী বলেছে তোর রবি প্রেম সম্পর্কে?
উপমা: কেন, তুই শুনিল নে?
দীপ্ত: শুনেছি। তবু তোর মুখ থেকে শুনতে চাই।
উপমার এক টুকরা হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো। তারপর দীপ্তের দিকে তাকিয়ে বলল-
প্রেম অসীম, অনন্তের ধন, আত্মার সম্পদ। দেহের সীমায় তাকে ধরা যায় না।
দীপ্ত হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর বলল-
থাক থাক মহারানী। বুঝেছি, সেই অসীম অনিবর্চনীয় প্রেম- ধনের অধিকারী যে নারী, তাকে তো দেহের মধ্যে পাওয়া যাবেনা। তাই তো!
উপমা: কাকে বলছিস? আমাকে?
দীপ্ত: তো কাকে বলব আবার ? এমন প্রেমের অধিকারিনী আর কে হতে পারে ম্যাডাম?
উপমা: তুই আর যাই বলিস। এটা কিন্তু সত্যিই আমার মনের কথা। রবীন্দ্রনাথ যেন আমার মনের কথাটাই লিখে গেছেন। কত যুগ পূর্বের কথা। অথচ মনে হচ্ছে জলজ্যান্ত বাস্তবতার স্পর্শ আছে। এজন্যই হয়ত তিনি বিশ্বকবি’র খেতাব পেয়েছেন।
দীপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-
যার তপস্যায় ভিজে আমার আঁখি,
আমার মরণ হলো তার আত্মার ভিতর,
তাহলে আমি খাঁচা ছাড়া পাখি?
উপমা: ঠিক বলেছিস। পাখিকে আটকে রাখতে নেই। সে তো উড়বেই ডানা মেলে সেই অসীম আকাশে। ঘুরবে সবুজ অরণ্যে। তার চলার পথে কেন সীমাবদ্ধ রেখা টানতে চাস?
দীপ্ত: আমি উড়ার গতিপথ রুদ্ধ করতে চাইনা। আমি তোর প্রেম সম্পর্কে ধারণার কথা বলছি। আমি তোর সাথে একমত নই। দেখ, আত্মা থাকে দেহের ভিতর। দেহ আত্মাকে স্পর্শ করবে না, এটা কি কখনও হয় বল?
উপমা দীপ্তকে লক্ষ্য করে বলল,
” বলে যাও হে গুণী ,
তোমার কথা শুনি,
যে প্রেম শুধুই মন ছুঁয়ে দেয়,
সেই প্রেম-ই মানী।
দীপ্ত: বেশ সুন্দর বলেছিস তো! তাহলে আমার কথা মানছিস?
উপমা কোন উত্তর না দিয়ে বলল…
কি রে চা খাবি? নাকি কফি?
দীপ্ত: কফি।
কফি বানিয়ে আনলো উপমা। কফিতে চুমুক দিতেই হকারের ডাক। দিদিমনি পত্রিকা লইয়া যান।
উপমা খবরের কাগজ টেবিলে রাখতেই নিজের চোখ আটকে গেল এক জায়গায়। বড় করে লেখা শিরোনাম ‘ বীরাঙ্গনার আত্মকথন’।
তার মায়াবী চোখ দুটি কৌতুহলে চকচক করে উঠলো। পত্রিকাটি নিজের দিকে টেনে নিলো। একটি অদ্ভুত রকমের আর্টিকেল! পত্রিকাটিতে মনোযোগ দিল।
দীপ্ত গুণ গুণ করে গেয়ে উঠলো,
‘কত কথা যাও হে বলি, কোন কথা না শুনি…’
কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই উপমার। তার এক নিবিষ্ট মন পড়ে আছে পত্রিকার উপর।
দীপ্ত হঠাৎ খেয়াল করলো উপমার চোখের কোণে পানি চিক চিক করছে।
দীপ্ত: কি রে এত মনোযোগ দিয়ে সেই থেকেই কি পড়ছিস?
উপমার ভেজা চোখদুটো স্থির হয়ে রইল পত্রিকার পাতায়। বাকরুদ্ধ। এক পলক দীপ্তর দিকে তাকিয়ে আবার পড়া শুরু করলো।
ভাবনার গন্ডির জাল এক এক করে ছিঁড়তে লাগলো উপমা। বিজয়ের অনেক গল্প, অনেক বই পড়েছে সে। কিন্তু এই প্রথম কোন বীরাঙ্গনা নারীর সরাসরি সাক্ষাৎকার পড়ছে। অতি আবেগময় হয়ে উঠলো উপমা। নিজেকে সংবরণ করতে পারছেনা কিছুতেই। কখনও চোখের অশ্রুতে পত্রিকা ভেজাচ্ছে, কখনও ত্রুশবিদ্ধে আহত হচ্ছে হৃদয়। বীরাঙ্গনা নিজের কথাগুলো এ ভাবেই প্রকাশ করেছে-
‘বিজয়ের প্রতিটি ধূলিকণাতেই রয়েছে মৃত্যুর চাষ। হায়েনা নরপিশাচগুলো আমার শরীর নিয়ে ব্যস্ত। গায়ের শক্তিতে ছক্কা মেরে আমাকে সীমানা পেরিয়ে দিচ্ছে। আবার কিছু নরখাদক ক্যাচ ধরছে আমাকে। কে জিতবে! আমার শরীরটা নিয়ে যেন তুমুল প্রতিযোগিতা। উইকেটের কিন্তু পতন হচ্ছে না। এক এক ঘাতক যতবার আমার শরীরটাকে খামছে ধরছে ঠিক ততবার ফোটা ফোটা রক্তে ভিজে যাচ্ছে সবুজ ঘাস।
আমার মতো অনেক নারী, বধূ, বোনকে নিয়ে ওরা উদরপূর্তি করছিল। আমার কানে ভেসে আসছিল আর্তচিৎকার। কিন্তুু ঐ আকাশবিদারী চিৎকার নরপিশাচদের উপর কোন প্রভাব ফেলেনি সেদিন।
নরখাদক হায়নারা আমার স্তনে সিগারেটের আগুনের ছাপ দিয়ে উল্লাসিত নৃত্য করেছিল। আমার চোখের জল আর নির্গত রক্তে আঁকছিল আমার মাতৃভূমি দখলের নীলনকশা। আমার সারা শরীরে দাঁত ও নখের বিষাক্ত আঁচড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করেছি প্রতিক্ষণ।
উপমা আর পড়তে পারলো না। হু হু করে কেঁদে উঠলো। তারপর স্তব্ধ হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।
নিরবতা কাটিয়ে আবার পড়তে লাগলো-
‘মনে মনে ভাবলাম এভাবে মরে বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই। বাঁচলে বাঁচার মতো বাঁচাবো। অন্তত একজনকে মারতে পারলে আমার মৃত্যু স্বার্থক হবে। ওরা আমায় আটকে রাখতো ছোট্ট একটি ঘরে। একদিন ভুল করে বাহির থেকে তালা না দিয়েই চলে গেল নরপিশাচরা। কোথায় যেন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান পেয়েছিল তাই। তড়িঘড়ি অপারেশন করতে চলে গেল সবাই। এই সুযোগটা কাজে লাগালাম। আমি খুব সতর্কতার সাথে বের হলাম। ওদের মধ্যে একজন ফিরে আসাতেই আমি একটা খাটের কোণে লুকিয়ে পড়লাম। সেখানে অনেক গুলো বোম দেখতে পেলাম। একটা আমার বুকের সাথে বেঁধে নিলাম খুব সাবধানে। তারপর চুপিচুপি আমাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেখানে চলে গেলাম। খানিকক্ষণ পর চারজন লোক আসলো আমার ঘরে। আমাকে টানাহেঁচড়া করতে থাকল। আমি যাতে আত্মহত্যা না করতে পারি এইজন্য আমার পরনের শাড়িটা পর্যন্ত খুলে রেখে দিয়েছিল। আমার দিকে আসতেছিল ওরা। আমি সুকৌশলে বোমটা ফাটিয়ে দিলাম। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ওদের মধ্যে দু’জনের দেহ। আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। দ্রুত আমাকে ধরে ফেললো আর একদল নরখাদক। আমাকে ইচ্ছে করলে তখন মেরে ফেলতে পারতো। কিন্তু কেন যেন মারল না। ওখান থেকে আমাকে অন্য ঘরে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে অনেক নারী ছিল। একটা কিশোরী মেয়ের চিৎকার শুনলাম। পানি পানি, আমাকে একটু পানি দিন প্লিজ’।
উপমা টেবিলে রাখা পানির গ্লাস থেকে নিজেই পানি খেয়ে নিল। সামনে দীপ্ত বসে আছে সে খেয়াল পর্যন্ত নেই। আবার পড়তে শুরু করলো…
‘আমি বুঝে গিয়েছিলাম ওরা আমাকে সহজভাবে মারবেনা। আমাকে তিলে তিলে মারবে। তাতে আমার কোনো আক্ষেপ ছিলনা। মনে মনে আমিও প্রস্তুত ছিলাম। আমি মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে চেয়েছি সেদিন। মনে মনে নিজের প্রতি নিজে কৃতজ্ঞতা জানালাম অন্তত দু’জনকে তো মারতে পেরেছি।
আমার হাত পা বাঁধলো। আমার মলদ্বার ও যোনিতে লোহার গরম সেঁক দিল। আমি একটা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।’
উপমা পড়তে পড়তে নিজেই মা বলে চিৎকার উঠলো। ঘৃনায়, ক্ষোভে, কষ্টে তার শরীর থর থর করে কাঁপছিলো। পত্রিকাটি ফেলে দিয়ে শিশুর মতো কিছুক্ষণ কাঁদলো। আসন ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাহিরে তাকিয়ে দেখে সামনে স্কুলের লাল সবুজের পতাকাটি সগৌরবে মাথা উঁচু করে পত পত করে উড়ছে। উপমা পতাকার দিকে নিবিষ্ট মনে তাকালো। সেখানে স্পষ্ট বীরাঙ্গনার ছবির জলছাপ দেখতে পেলো। বীরাঙ্গনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় দু-চোখ জলে পরিপূর্ণ হলো উপমার।
দীপ্ত আস্তে আস্তে এসে উপমার হাত ধরলো। বুঝতে পারলো উপমা বীরাঙ্গনার মাঝে নিজেকে হাজির করেছে। স্যালুট জানালো বীরাঙ্গনার প্রতি। তারপর দু’জন এক সুরে পতাকার দিকে তাকিয়ে গাইলো…
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’