ইউপি নির্বাচনে সিলেটে পাঁচ কারণে হেরেছে নৌকা

2

স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটে সদ্য সমাপ্ত দ্বিতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের ভরাডুবি হয়েছে। বিভাগের ৪৪ ইউনিয়নের একটিতে ভোট স্থগিত হলেও ৪৩টির ২৩ টিতেই হেরেছে নৌকা।
ফলে বিভাগে অর্ধেকের বেশি চেয়ারম্যান পদ হাত ছাড়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির। এরই মধ্যে তিন প্রভাবশালী মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার ২০টি ইউনিয়নের ১৪টিতেই দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে ভোটারের কাছে গুরুত্ব পায়নি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের প্রতীক নৌকাও। দলীয় প্রতীক ছাড়াই এসব ইউপিতে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ভোটে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে বিএনপির রয়েছেন ১০ জন করে। জামায়াতে দুইজন ও খেলাফত মজলিসের একজন।
দল মনোনীত প্রার্থীদের এমন বিপর্যয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যেমন তোলপাড় চলছে, তেমনি রক্তক্ষরণ হচ্ছে পরাজিত দলীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে নির্বাচন সচেতন মহলকেও। অর্ধেকেরও বেশি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থীর হারের পর্যালোচনা শুরু হয়েছে, কারণ খুঁজছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও। আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ভরাডুবির কারণ খুঁজতে গিয়ে দলীয় নেতাকর্মী, ভোটার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং রাজনৈতিক সচেতন মহলের সঙ্গে কথা হয়। তাদের বিশ্লেষণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরাজয়ের পেছনে পাঁচটি কারণ উঠে এসেছে।
কারণগুলো হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী না দেওয়া, বিদ্রোহ দমাতে ব্যর্থতা, নৌকার বিরোধিতায় বিএনপি এবং বিগত সময়ের অপেক্ষায় সুষ্ঠু ভোট হওয়া। এই কারণগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতারা।
তারা জানিয়েছেন, দলের প্রতি তৃণমূল নেতাকর্মীদের আনুগত্য না থাকায় এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণেই ফল বিপর্যয় হয়েছে। এছাড়া বিএনপি ও তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কৌশলী প্রচারণাও ভোটারদের কাবু করেছে। এই অবস্থা পর্যালোচনা করে বাকি উপজেলাগুলোর আসন্ন নির্বাচনগুলোতে কীভাবে দলের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের আরও ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটের প্রচারণায় সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি উন্নয়নের পরিকল্পনা তুলে ধরার মাধ্যমে ভোটারদেরও কাছে টানতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্ব ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় নেতাকর্মীদের। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে তৃণমূলে কোনো প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নিতে হবে উপজেলা কমিটিগুলোকে।
ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সিলেট জেলার তিনটি উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের ছয়টিতে জয় পেলেও ৯টিতে নৌকা বিজয়ী হতে পারেনি। এই ৯টি ইউপিতে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী দুইজন ছাড়াও নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির পাঁচজন, জামায়াত ও খেলাফত মজলিসের একজন করে।
সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকের ১০ ইউনিয়নের মধ্যে চারটিতে জয় পেয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। বাকি ছয়টির মধ্যে ৩টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, দুটিতে স্বতন্ত্র হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিএনপি নেতা ও একটিতে জামায়াত নেতা বিজয়ী হয়েছেন। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ৫ ইউনিয়নের চারটিই হাতছাড়া হয়েছে আওয়ামী লীগের। দুটি করে ইউনিয়নে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী ও বিএনপি।
সিলেট বিভাগের মধ্যে একমাত্র হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে তুলনামূলক ভালো ফল পেয়েছে আওয়ামী লীগ। এ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৩টিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন নৌকা মার্কার প্রার্থীরা। একটিতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। অন্যটির ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে।
প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে মোমেনের নির্বাচনী এলাকা সিলেট-১ আসনের অন্তর্গত সিলেট সদর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের মধ্যে দুটিতে নৌকা জয় পেলেও অন্য দুটি হাত ছাড়া হয়।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের নির্বাচনী এলাকা সিলেট-৪ আসনের অন্তর্গত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটিতেই জিততে পারেননি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। এগুলোতে জয়ী হয়েছে বিএনপির দুইজন ও আওয়ামী লীগের একজন বিদ্রোহী। বালাগঞ্জের ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে দুটিতে জয়েরমুখ দেখলেও চারটি হাতছাড়া হয় আওয়ামী লীগের। এগুলোতে জয় পায় বিএনপির তিনজন ও আওয়ামী লীগের এক বিদ্রোহী প্রার্থী। দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের চরম ভরাডুবি হয়েছে বন ও পরিবেশমন্ত্রী শহাব উদ্দিন আহমদের নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজার-৩ আসনের অন্তর্গত জুড়ী উপজেলায়। এ উপজেলার ৫ ইউনিয়নের মধ্যে একটিতে জয়েরমুখ দেখলেও চারটিতে নৌকার ভরাডুবি হয়।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ইউপি নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই ভোট হয়েছে। শেখ হাসিনার অধীনে অবাদ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে এই নির্বাচনে আবারো প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, মানষের ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অন্যতম বাহন। এতোদিন যারা নির্বাচনের বর্জনের নামে মানুষ হত্যা করেছে, জ্বালাও পোড়াও করেছে, তারা এখন প্রতীক বিহীন প্রার্থী হয়েছেন।
নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবির বিষয়ে তিনি বলেন, তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে নমিনেশন বোর্ড প্রার্থী দিয়েছে। তৃণমূলের এরাতো আর ফিরিস্তা নয় যে শতভাগ যাচাই করতে পারবে, কার অবস্থান ভালো। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গোষ্ঠীগত, পাড়া-প্রতিবেশীর প্রভাব থাকে, সেটাই হয়েছে। তৃণমূল সংগঠন যারা করে, তাদের রাজনীতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতীকে নির্বাচন দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলে কষ্ট করে রাজনীতি করে, তারাও নৌকায় নির্বাচন করা এবং ভোট দেওয়ার আশা রাখে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আরো সময় লাগবে।
বিদ্রোহীদের বিষয়ে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জেলা-উপজেলা থেকে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। দলের বিদ্রোহীরা বিজয়ী হলেও তাদের ফেরার সুযোগ নেই। তাদের স্থায়ীভাবে দল থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন্দ্র নেবে।