রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার সব আসামি খালাস ॥ ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয়- আদালত

34

কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচজনের সবাইকে খালাস দিয়েছেন আদালত। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়। ৭২ ঘণ্টা পার হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম কামরুন্নাহারের আদালত বৃহস্পতিবার এ রায় ঘোষণা করেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আফরোজা ফারহানা আহমেদ (অরেঞ্জ), বাদী পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মেদ, এম এ বি খায়রুল ইসলাম লিটন ও মোশারফ হোসেন কাজল। রায়ে আসামি পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ে বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে সেটা পর্যালোচনা করে আপীল করব।
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, দুই ভিক্টিম স্বেচ্ছায় রেইনট্রি হোটেলে যায়। সেখানে নিজেদের ইচ্ছায় তারা সাফাত আহম্মেদ ও নাঈম আশরাফের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। তাদের ভয়ভীতি বা মারধর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করা হয়নি। স্বেচ্ছায় তারা আসামিদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান। এই মামলাটি ৯৩ দিন ট্রায়ালে সময় নিয়েছে। এই সময়ে অন্যান্য অনেক মামলার বিচার করা সম্ভব হতো। টানা ৩৮ দিন পর তারা বললেন ‘আমরা ধর্ষণের শিকার হয়েছি। এই মামলাটি একটি অহেতুক মামলা। এই অহেতুক মামলায় রাষ্ট্রের অনেক সময় অপচয় হয়েছে। মূলত আসামি সাফাতের সাবেক স্ত্রী পিয়াসা এই মামলাটি করতে সহায়তা করেন ভিকটিমকে। পুলিশ অহেতুক মামলাটি গ্রহণ করেছে। পরবর্তীতে ট্রায়ালে পাঠিয়ে বিচার বিভাগের অযথা সময় নষ্ট করেছে। এদিকে খালাসপ্রাপ্ত আসামি সাদনান বলেছেন, ‘জয়, সত্যের জয় হয়েছে। আমরা ভিকটিমাইজড। আদালতের মাধ্যমে সত্যের জয় হয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে এ রায়ে তারা সংক্ষুব্ধ। মামলার রায় প্রকাশ হলে সেটা পর্যালোচনা করে আমরা আপীল করব।
আদালত যে পাঁচজনকে খালাস দিয়েছেন তারা হলেন, সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ (পুলিশের কাছে এস এম হালিম নামে চিহ্নিত), সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই রায় পড়া শুরু করেন বিচারক।
গত ২৭ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু সিনিয়র আইনজীবী বাসেত মজুমদার মারা যাওয়ায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তাই বিচারক রায় ঘোষণার জন্য ১১ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। তার আগে গত ১২ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বিচারক অসুস্থ থাকায় রায় ঘোষণার জন্য ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক ২৭ অক্টোবর দিন ধার্য করেছিলেন।
গত ৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেন আদালত। একইসঙ্গে জামিনে থাকা সাফাতসহ পাঁচ আসামির জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ২০১৭ সালের ৭ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট এ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। ওই বছরের ১৯ জুন একই ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।
অভিযোগপত্রে আসামি সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিমের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়েছে। এছাড়া মামলার অন্য তিন আসামি সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে ওই আইনের ৩০ ধারায় ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত অভিযুক্তরা মামলার বাদী, তার বান্ধবী ও বন্ধুকে আটকে রাখে। অস্ত্র দেখিয়ে ভয় প্রদর্শন ও অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন। বাদী ও তার বান্ধবীকে জোর করে একটি কক্ষে নিয়ে যায় আসামিরা। বাদীকে সাফাত আহমেদ ও তার বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করে। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, সাদমান সাকিফকে দুই বছর ধরে চেনেন মামলার বাদী। তার মাধ্যমেই ঘটনার ১০ থেকে ১৫ দিন আগে সাফাতের সঙ্গে দুই শিক্ষার্থীর পরিচয় হয়। ওই দুই শিক্ষার্থী সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যান। সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী তাদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডে রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যান। হোটেলে যাওয়ার আগে বাদী ও তার বান্ধবী জানতেন না যে সেখানে পার্টি হবে। তাদের বলা হয়েছিল, এটা একটা বড় অনুষ্ঠান, অনেক লোকজন থাকবে। অনুষ্ঠান হবে হোটেলের ছাদে।
সেখানে যাওয়ার পর তারা কাউকে দেখেননি। সেখানে আরও দুই তরুণী ছিলেন। বাদী ও তার বান্ধবী সাফাত ও নাঈমকে ওই দুই তরুণীকে ছাদ থেকে নিচে নিয়ে যেতে দেখেন। এ সময় বাদীর বন্ধু ও আরেক বান্ধবী ছাদে আসেন। পরিবেশ ভালো না লাগায় তারা চলে যেতে চান। এ সময় অভিযুক্তরা তাদের গাড়ির চাবি শাহরিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নেয় এবং তাকে মারধর করেন। ধর্ষণের সময় গাড়িচালককে ভিডিও করতে বলেন সাফাত। বাদীকে নাঈম আশরাফ মারধর করেন।
জবানবন্দী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে : সাফাত আহম্মেদের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, যারা প্রসিকিউশন করেছেন, সাক্ষ্য প্রমাণ আদালতে এনেছেন, ২২ জন সাক্ষী হাজির করা হয়। পরেই মেডিক্যাল রিপোর্ট, ডিএনএ রিপোর্ট, ভিকটিমের জবানবন্দী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এজন্য আদালত তাদের খালাস দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, এ মামলার তদন্তকারী টিম মামলা তদন্তে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যখন কেউ ধর্ষিতা হয়। ধর্ষিত হওয়ার পর এমনকিছু উপাদান থাকে (কাপড় চোপড়, ডিএনএ, মেডিক্যাল রিপোর্ট) যা খুব জরুরী। কারণ মেডিক্যাল রিপোর্টটা যদি না থাকে তাহলে সমাজে সবাই মিথ্যা মামলায় নিমজ্জিত হতে পারে। সুতরাং এটা একটি সাইন্টিফিক ফরেনসিক রিপোর্ট। ডাক্তার যদি বলেন হয়েছে তাহলে মেনে নিতেই হবে।
খালাস পাওয়ার পর আসামি সত্যের জয় হয়েছে : ‘জয়, সত্যের জয় হয়েছে। আমরা ভিকটিমাইজড। আদালতের মাধ্যমে সত্যের জয় হয়েছে।’ এমনটিই বলছিলেন বনানীর রেইনট্রি হোটেলে শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলা থেকে খালাস পাওয়া সাদমান সাফিক। আদালতের আদেশের পর এ সময় তারা একে অপরকে বলতে থাকেন, বিজয়ের চিহ্ন দেখাও, আমাদের জয় হয়েছে, বিজয় চিহ্ন দেখাও।
দুই শিক্ষার্থী ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছেন : রাষ্ট্রপক্ষ : বনানীর দ্য রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার রায়ে সব আসামি খালাস পাওয়ায় সংক্ষুব্ধ রাষ্ট্রপক্ষ। এর ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছেন বলেও মন্তব্য করেছেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আফরোজা ফারহানা আহমেদ (অরেঞ্জ)। রায় প্রকাশের পর এ কথা জানান আফরোজা ফারহানা আহমেদ (অরেঞ্জ)। তিনি বলেন, আদালতের রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। প্রকৃতপক্ষে দুই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছেন। যেহেতু আদালত আজকের রায়ে আসামিদের খালাস দিয়েছেন। এ মামলার রায় প্রকাশ হলে সেটা পর্যালোচনা করে আমরা আপীল করব।