রোগীর স্বজনদের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ বেশি ছড়াচ্ছে

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনদের মাধ্যমে দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বেশি। রোগীদের পাশে স্বজন ও পরিচারকদের সার্বক্ষণিক থাকার পর গণপরিবহন ব্যবহার ও অবাধে বাইরে যাতায়াতের কারণে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। দেশের হাসপাতালগুলোতে কোভিডের সঙ্গে সমন্বিত চিকিৎসাতেও সংক্রমণ অধিকহারে বাড়ছে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গত বছরের ৮ মার্চে দেশে প্রথমবারের মতো করোনা শনাক্ত হওয়ার পর চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেশি সতর্ক থাকতে দেখা গেছে চিকিৎসক ও নার্সসহ রোগীর পরিবার-পরিজনদের। চিকিৎসক ও নার্সদের হাসপাতালে কাজ শেষে রাজধানীর আবাসিক হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সরকারী খরচে। সংক্রমণ বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় সরকারী উদ্যোগে এটি করা হয়েছিল। কিন্তু এবার সেই ব্যবস্থা নেই। সবাই নিজ বাসায় থেকেই চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন হাসপাতালগুলোতে। ফলে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসাসেবার জড়িতরা নিজ বাসায় যতই নিজেকে নিভৃতবাসে রাখুন না কেন পরিবারের মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। নিজের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের বিপাকে ফেলছেন তারা।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ইন্টার্নিশিপের ছাত্রী জোবাইদা ইসলামের প্রতিদিনই করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব থাকছে। রামেকে কোভিডের শয্যার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি থাকায় চিকিৎসকদের অতিরিক্ত চাপ নিতে হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে চিকিৎসকদের করোনা রোগীদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। জোবাইদা কোভিশিল্ড দুই ডোজের টিকা নেয়ার পরও সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার ভাইও একই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। জোবাইদা দায়িত্ব পালনের পর পৃথক ঘরে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলেও সম্প্রতি তার বৃদ্ধ বাবা-মা ও চিকিৎসক ভাইও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অর্থাৎ পুরো পরিবারই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া ওই পরিবারের গৃহ পরিচারিকারাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এভাবেই হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও রোগীর স্বজনদের মাধ্যমে করোনা ছড়াচ্ছে।
দেশের কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতেও সমন্বিত চিকিৎসাসেবা চালু রয়েছে। অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এসেই অনেকে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া তাদের স্বজনরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে কিছুটা স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হলেও রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরাসহ দেশে বিভিন্ন প্রান্তের জেলা-উপজেলা সদর হাসপাতালগুলোতে রোগী কানায় কানায় পূর্ণ সেটিও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডেল্টা ধরনের কারণে বাংলাদেশ সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেশগুলোর প্রথম সারিতে চলে আসলেও করোনা চিকিৎসায় আলাদা ফিল্ড হাসপাতাল নেই। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভেনশন সেন্টারে ১ হাজার শয্যার অত্যাধুনিক ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া রাজধানীতে আরও চারটি ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ফিল্ড হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হলে সমন্বিত চিকিৎসার ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে। সেক্ষেত্রে স্বজনদের দ্বারাও সংক্রমণ কম ছড়াবে।
গোটা দেশে করোনার হটস্পট হওয়ার কারণে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশাপাশি জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতে করোনার চিকিৎসা করা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে হাসপাতালগুলোতে শয্যার বিপরীতে রোগীর সংখ্যা বেশি। মৃদুু উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত রোগীদের তুলনায় গুরুতর আক্রান্ত রোগীদের স্বজন ও পরিচারিকার সংখ্যাও বেশি। করোনার এখনকার ঢেউয়ে গতবারের তুলনায় রোগীর স্বজনদের মধ্যে ভীতি কম কাজ করছে। একইসঙ্গে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নার্স ও চিকিৎসকদের অবহেলা ঘটার অভিযোগ এনে এবার স্বজনরা রোগীর সঙ্গেই অবস্থান করছেন।
গত বছর চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর স্বজনদের হাসপাতালে প্রবেশাধিকার সীমিত ছিল। এবার ঘটছে উল্টোটা। এবার করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সাধারণ শয্যা ও আইসিইউতেও স্বজনরা প্রবেশ করতে পারছেন। কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে একাধিক স্বজন অবস্থান করছেন। গত বছর রাজধানীর হাসপাতালগুলোর আইসিইউ কোভিড-১৯ রোগের হটস্পটে পরিণত হয়েছিল। নামীদামী হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের প্রধান চিকিৎসরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। এবার চিকিৎসকদের মধ্যে টিকাকরণ কর্মসূচী বাস্তবায়নের পর মৃত্যুর সংখ্যা কম। কিন্তু হাসপাতালে যাতায়াত করা রোগীদের স্বজনদের ক্ষেত্রে টিকা নেয়ার প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষকে এখন টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। তাই তারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে তা ছড়াচ্ছেও বেশি।
রাজধানীর কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল বলে পরিচিত ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট মুগদা জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের ভিড়। হাসপাতালটিতে ৩৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ফাঁকা ছিল ৮৫টি শয্যা। এছাড়া আইসিইউ শয্যার ২৪টির মধ্যে ২৩টিতে ছিল রোগী ভর্তি। রোগীর স্বজনরা অবাধে হাসপাতালে প্রবেশ করছে ও বাহির হচ্ছে। স্বজনদের গেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা পরিমাপও করা হচ্ছে না। এছাড়া কখন কোন স্বজন আসছে বা বের হচ্ছে সেটিরও কোন খেয়াল রাখা হচ্ছে না। তারা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ওষুধ কিনছে, খাবারের দোকানে খাবার কিনছে আবার বাড়িও যাচ্ছে রিক্সা, সিএনজি ও গণপরিহন ব্যবহার করে।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের মতো রাজধানীর বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারী হাসপাতাল, ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের করোনা ইউনিটে গিয়ে রোগীর স্বজনদের অবাধে প্রবেশ করতে ও বের হয়ে যেতে দেখা গেছে। অধিক সংমক্রণের রোগ হিসেবে করোনা রোগীকে খুবই যত্নসহকারে ও নিরাপদ দূরত্বে থেকে চিকিৎসার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো ঘটছে। ঢাকার মতো রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতেও একই চিত্র ফুটে উঠেছে। সব হাসপাতালেই সমন্বিত চিকিৎসাসেবা চালু রয়েছে। সমন্বিত চিকিৎসা চালু থাকার কারণে অন্যরোগে চিকিৎসাধীন রোগীর সঙ্গে তাদের স্বজনরাও নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। ওইসব স্বজনরা আবার নতুন করে সংক্রমণ ঘটাচ্ছেন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রোগীরা যখন হাসপাতালে প্রবেশ করে তখন তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমিত সুযোগ, সচেতনতার অভাব এবং তাদের পরিচারকের পাশাপাশি হাসপাতালের কর্মীদের স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অবহেলার কারণে নতুন করে বেশি সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। হাসপাতালের ভেতরে সাধারণ রোগী, করোনা রোগী, করোনা সন্দেহভাজন রোগী এবং তাদের পরিচারকরা করিডরে ভিড় করে আছেন। সবাই একসঙ্গে চলাচল করছিলেন। লাউডস্পিকারে সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার বিষয়ে মাঝে মাঝে ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল। তবে, অনেকেরই সেদিকে গুরুত্ব দিতে দেখা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেছেন, হাসপাতালে কোন জায়গা আর নিরাপদ নেই। আক্রান্তরা সবখানেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
হাসপাতালের বেশিরভাগ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলেছেন, করোনা রোগীতে হাসপাতাল ভরে গেছে। ফলে, করোনাভাইরাস করোনার ইউনিট ছাড়িয়ে অন্যান্য ওয়ার্ডে ছড়িয়ে পড়েছে এবং পুরো হাসপাতালটিকে একটি কোভিড-১৯ হটস্পটে পরিণত করেছে। পর্যাপ্ত পরীক্ষার অভাবে, কোভিড-১৯-এর হালকা বা উপসর্গহীন সংক্রমিত রোগী ও হাসপাতালের কর্মীরা হাসপাতালে অনায়াসে প্রবেশ করছেন এবং অন্যকে সংক্রমিত করছেন বলে তারা জানিয়েছেন।
ডেল্টা ধরনের কারণে সারাদেশই এখন করোনার হটস্পটে পরিণত হয়েছে। আর করোনায় চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পর স্বজনরাও নতুন করে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতালের আশপাশের এলাকা করোনায় হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। রোগী স্বজন ও পরিচারকদের অবাধে প্রবেশাধিকারের জন্যই এমনটি ঘটছে।