বাণিজ্য চাঙ্গা করতে বাজেটে যা থাকছে

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনা যে ক্ষত তৈরি করে দিয়ে গেলো তা মোকাবিলায় এবারের বাজেট বড় ভূমিকা রাখতে পারে। করোনার প্রভাবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের বিশেষ ‘সাপোর্ট’ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ কাজ হারানোরা যাতে কাজ ফিরে পায়, যাদের বেতন কমেছে- তারা যাতে আগের বেতনে ফিরতে পারে, সেই উদ্যোগ থাকবে নতুন বাজেটে। সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করে অর্থনীতির মেরুদণ্ড ফের খাড়া করতে চায় সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
প্রসঙ্গত, করোনায় দরিদ্রদের পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন ও জীবিকাও হুমকিতে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছেন। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে দেশে নতুন করে দরিদ্রের কাতারে পড়েছেন প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। অবশ্য আগামী বাজেটে তাদের জন্য বিশেষ কোনও বরাদ্দ থাকছে না। তবে তারা যাতে পরোক্ষভাবে উপকারভোগী হয় সে ব্যবস্থা থাকবে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী বাজেটে শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির করপোরেট কর হার আড়াই শতাংশ করে কমতে পারে। বছরে তিন কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়, এমন প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসান নির্বিশেষে ন্যূনতম কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে দশমিক ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। উৎপাদনমুখী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়াতে আমদানি পর্যায়ে আগাম ভ্যাট ১ শতাংশ কমবে। এমনটা করা হচ্ছে মূলত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর করের বোঝা কমাতে। যাতে তারা নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, সার্বিকভাবে আগামী বাজেটে নতুন দরিদ্রদের জন্য সহায়তা কর্মসূচির পরিবর্তে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর উদ্যোগই বেশি থাকছে। তার মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারে আগামী বাজেটে বিনিয়োগকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
পুরনো শিল্পকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি নতুন শিল্প স্থাপনে নানা কর ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে। শুধু শিল্পখাতে নয়, স্বাস্থ্যেও বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
আগাম কর কমছে
নতুন বাজেটে ভ্যাট আইন আরও ব্যবসাবান্ধব ও যুগোপযোগী করতে আমদানি পর্যায়ে আগাম কর (এটি) হার কমানো হচ্ছে। ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রিফান্ড জটিলতার কারণে কয়েকটি শিল্পকে আগাম কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। এ তালিকায় আছে-স্ক্র্যাপ ভেসেল, ইস্পাত শিল্পের ওয়াস্টেজ ও স্ক্র্যাপ, ফেরো অ্যালয়, স্পঞ্জ আয়রন, পিভিসি ও পেট রেজিন উৎপাদনে ব্যবহৃত ইথাইলিন গ্লাইকল, টেরেফথালিক এডসড, ইথাইলিন/প্রোপাইলিন আমদানি। এ ছাড়া উপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য আমদানিকৃত কাজু বাদামেও আগাম কর প্রত্যাহার হচ্ছে।
কমছে ন্যূনতম কর
পাইকারি ব্যবসায়ী, পণ্য পরিবেশক, ব্যক্তি মালিকানাধীন (প্রোপাইটরশিপ) ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেনের ওপর ন্যূনতম আয়কর কমানো হচ্ছে। এখন ৩ কোটি টাকার বেশি টার্নওভার হলে লাভ-ক্ষতি যাই হোক দশমিক ৫০ শতাংশ হারে ন্যূনতম কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে এটি দশমিক ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত নতুন শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন শুরুর পরবর্তী প্রথম ৩ বছর ন্যূনতম কর হার দশমিক ১০ শতাংশ থাকছে। তবে মোবাইল অপারেটরদের লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে টার্নওভারের ওপর ২ শতাংশ এবং তামাক প্রস্তুতকারক কোম্পানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর এক শতাংশ বহাল থাকছে।
কমছে করপোরেট কর
গতবছরের বাজেটে তার আগের বছরের বাজেটের চেয়ে করপোরেট কর হার কমানো হয়েছিল। সেটার ধারাবাহিকতায় আগামী বাজেটেও এ করে ছাড় থাকছে। তবে ঢালাওভাবে সব খাতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। পুঁজিবাজার চাঙ্গা করার স্বার্থে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত শিল্পের কর কমানো হচ্ছে।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি করপোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর সাড়ে ৩২ থেকে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। তবে অপরিবর্তিত থাকছে বাণিজ্যিক ব্যাংক, সিগারেট, জর্দা ও গুলসহ তামাকজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি এবং মোবাইল কোম্পানির কর হার।
জরিমানাতেও স্বস্তি
যারা ভ্যাট ফাঁকি দেন, আগামী বাজেটে তাদেরও কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। অর্থাৎ নতুন বাজেটে ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ হার দুটোই কমানো হচ্ছে। এখন ভ্যাট ফাঁকির ক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা আদায়ের বিধান রয়েছে। এটি কমিয়ে ফাঁকির সমপরিমাণ জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। এ ছাড়া সময়মতো ভ্যাট না দিলে আইন অনুযায়ী মাসে ২ শতাংশ হারে সরল সুদের বিধান রয়েছে। এটিও এক শতাংশ করা হচ্ছে।
হিজড়াদের চাকরি দিলে ৫ শতাংশ কর ছাড়
এবারের বাজেটে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নে বাজেটে কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আগামীতে কোনও প্রতিষ্ঠান বছরের পুরো সময় মোট জনবলের ১০ শতাংশ বা ১০০ জনের বেশি হিজড়াকে চাকরি দিলে প্রদেয় করের ওপর ৫ শতাংশ রেয়াত পাবে।
সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড় একক মালিকানায়
করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে একক মালিকানাধীন অপেক্ষাকৃত ছোট কোম্পানিগুলো। আসন্ন বাজেটে একক মালিকানাধীন কোম্পানিকে উৎসাহিত করতে বাজেটে ‘বিশেষ’ কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে কোম্পানি আইনের অধীনে গঠিত কোম্পানিকে সাড়ে ৩২ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। আগামী অর্থবছরে একক ব্যক্তির মালিকানাধীন কোম্পানির কর ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
ভ্যাট অব্যাহতির দীর্ঘ তালিকা
আসন্ন বাজেটে এসি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবং ফ্রিজ উৎপাদনে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি ১৬শ সিসি পর্যন্ত গাড়ি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া পলিপ্রোপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবার, মোবাইল ফোন, স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।
এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার শিল্পের বিকাশে প্রিন্টার, টোনার কার্টিজ, ইংকজেট কার্টিজ, কম্পিউটার প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এআইও, ডেস্কটপ, নোটবুক, নোটপ্যাড, ট্যাব, সার্ভার, কিবোর্ড, মাউস, বারকোড ও কিউআর কোড স্ক্যানার, পিসিবিএ/মাদারবোর্ড, পাওয়ার ব্যাংক, রাউটার, নেটওয়ার্ক সুইচ, মডেম, নেটওয়ার্ক ডিভাইস/ হাব, স্পিকার, সাউন্ড সিস্টেম, ইয়ারফোন, হেডফোন, এসএসডি/পোর্টেবল এসএসডি, হার্ডডিস্ক ড্রাইভ, পেনড্রাইভ, মাইক্রো এসডি কার্ড, ফ্ল্যাশ মেমোরি কার্ড, সিসিটিভি, মনিটর, প্রজেক্টর, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড, ই-রাইটিং প্যাড, ইউএসবি ক্যাবল, ডিজিটাল ঘড়ি ও পিসিবি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
হোম অ্যাপ্লায়েন্স সামগ্রী উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে আগামী ২ বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেকট্রিক কেটলি, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেসার কুকার। এসব পণ্য দেশে উৎপাদন করলে উপকরণ-যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট দেওয়া লাগবে না।
আইটি খাতে ছাড়
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আইটি খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যমান ২২টির পাশাপাশি আরও নতুন ৫টি সেবাকে করের বাইরে রাখা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- ক্লাডউ সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্লাটফর্ম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল এডপ্লকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস ও ফ্রিল্যান্সিং।
হাসপাতাল নির্মাণে ছাড়
করোনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নতুন বাজেটে বিশেষায়িত ও সাধারণ হাসপাতাল নির্মাণে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বিভাগীয় শহর ছাড়া অন্য জেলায় ২০০ শয্যাবিশিষ্ট বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সাধারণ হাসপাতাল নির্মাণ করলে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা পাওয়া যাবে।
বিশেষ ছাড় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য
বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের বার্ষিক (টার্নওভার) লেনদেনে বিশেষ কর ছাড় থাকছে বাজেটে। টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত। বাজেটে টার্নওভারের সীমা ৭০ লাখ টাকা করা হচ্ছে।
কৃষি আধুনিকায়নে ছাড়
করোনার চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে অর্থনীতিকে স্বস্তি দিয়েছে দেশের কৃষি খাত। এ খাতকে আরও সহজ করতে নতুন বাজেটে থাকছে কর ছাড়। কৃষি আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ তালিকায় আছে- থ্রেসার মেশিন, পাওয়ার রিপার, পাওয়ার টিলার, অপারেটেড সিডার, কম্বাইন হারভেস্টার, রোটারি টিলার, উইডার (নিড়ানি) ও উইনোয়ার (ঝাড়াইকল)।