আসছে দারিদ্র্য বিমোচন বাজেট

15

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনার কারণে দেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতি মাথায় রেখে আসছে আগামী অর্থবছরের বাজেট। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বাজেটে থাকবে বেশ কিছু কর্মসূচী। করোনার কারণে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় আগামী অর্থবছরের ব্যয় মিটাতে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো হবে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ হবে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। করোনার কারণে কাজ হারিয়ে যারা দরিদ্র হয়েছেন তাদেরকে অর্থনীতির মূলগ্রোতে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার ভাষায়, আগামী বাজেটে গরিবদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হবে। তাদের জীবন-জীবিকার জন্য জায়গা করে দেয়ার পদক্ষেপ থাকবে নতুন বাজেটে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেই শেখ হাসিনার সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। এ কারণে জাতিসংঘ ঘোষিত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনে দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। দরিদ্রের হার ২০০৫ সালের ৪০ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে ২১ শতাংশে নেমে আসে। এছাড়া ওই সময় অতি দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ থেকে নেমে ১১ শতাংশে দাঁড়ায়। করোনাভাইরাসের মহামারী শুরু হলে গত এক বছরে দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নতুন করে দেশে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে বলে বেসরকারী একটি গবেষণায় উঠে এসেছে। যদিও এই সংখ্যা সঠিক নয় বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। এ কারণে নতুন করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস থেকে জরিপ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। করোনার কারণে দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে মানুষের কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে বলে অর্থমন্ত্রীর বিশ্বাস। দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। সম্প্রতি সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গরিবদের এই অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসা। যারা অতিরিক্ত গরিব আছেন, তারা গরিব হবেন এবং যারা গরীব আছেন তাদের মূল গ্রোতধারায় নিয়ে আসব। সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
জানা গেছে, বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার এ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গবর্ন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে সম্প্রতি দেশে নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষের দরিদ্র হওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। ওই তথ্য অনুযায়ী গত বছর ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ বস্তিবাসী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান, যাদের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এখনও ফেরেনি। প্রাক- কোভিড সময়ের তুলনায় শহরের বস্তিবাসীর আয় কমলেও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় গত জুনের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে দ্বিগুণ হয়েছে। ভাড়া বাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। সবার সঞ্চয় কমেছে আশ্চর্যজনকভাবে। অরক্ষিত দরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন শ্রেণীর মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ কোভিড-পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে সব শ্রেণীতেই ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের হার সামগ্রিকভাবে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানা গেছে, আগামী ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ১২ দশমিক ৩০ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৪ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা ছিল বর্তমান সরকারের। এজন্য দারিদ্র্য বিমোচন এবং বৈষম্য হ্রাস করতে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করা হয়। দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক সুরক্ষায় সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজেও এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি কর্মসূচী রয়েছে।
এর বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে এ্যাকশন প্ল্যান ২০১৬-২১ অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে আবার বাড়তে শুরু করেছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। শুধু তাই নয় করোনার কারণে সরকারের রাজস্ব আদায় চাপের মুখে রয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণে ব্যর্থ হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ অবস্থায় এবার সবচেয়ে বড় অঙ্কের বাজেট ঘাটতি করা হচ্ছে। এছাড়া বাজেটের ব্যয় মিটাতে এবারই সবচেয়ে বেশি বিদেশী ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র মতে, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশী ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদেশী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা এবং চীন, ভারতের মতো দ্বিপক্ষীয় অংশীদারদের সঙ্গে প্রতিবছর ঋণচুক্তির মাধ্যমে টাকা আনা হয়। এবার বিদেশী ঋণের এই অর্থ দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোতে ব্যয় করা হবে। কিন্তু বিদেশী টাকা খরচ করতে এখনও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে আরও দক্ষ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে গৃহীত প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা (ইআরডি) জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুত যে পরিমাণ ঋণ পাইপলাইনে জমা হয়ে আছে, তা কমিয়ে আনতে প্রতিবছর ১ হাজার কোটি থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার খরচ করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলারের বিদেশী ঋণ খরচ করতে পারছে। বাকি অর্থ পাইপলাইনে অলস পড়ে থাকছে। তাই বৈদেশিক ঋণের প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না।
জানা গেছে, করোনার কারণে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মেনে নিয়ে প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণের উচ্চাভিলাষী পথে আর যাচ্ছে না সরকার। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১ শতাংশের বেশি কমানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য থাকবে ৭ শতাংশের ঘরে। সরকার নতুন বাজেটের আকার ৫ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা ধরে এগোচ্ছে, যা শেষ মুহূর্তে কিছু বাড়তে-কমতে পারে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বাজেটকে অংশীদারিমূলক করতে প্রতিবছর যে প্রাক্-বাজেট আলোচনা হয়, গত বছরের মতো এবারও করোনার কারণে তা খুব বেশি হয়নি। অর্থ বিভাগ অনলাইনে কিছু বৈঠক করেছে। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কিছু বৈঠক করেছে সরাসরি, কিছু করেছে অনলাইনে।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই- ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। সেই হিসেবে বাকি চার মাসে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। করোনাকালে লক্ষ্যমাত্রার কতটা রাজস্ব আহরণ সম্ভব, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। সেই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরকে ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এবার এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য বাড়ানো হচ্ছে, যার আকার হবে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো।
জানা গেছে, করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই প্যাকেজে দরিদ্রদের খাদ্য বিতরণ, নগদ সহায়তা, ঋণ বিতরণ, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা গৃহনির্মাণসহ একাধিক কর্মসূচী রয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। করোনার কারণে গরিবরা আরও বেশি গরিব হয়েছেন। এ কারণে দরিদ্রদের অর্থনীতির মূলগ্রোত ধারায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ নিতে হবে আগামী বাজেটে।