সিলেটের কৃতি সন্তান সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত আর নেই ॥ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক

14

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব) চিত্তরঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) আর নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বয়েন্টনবিচের বেথেসডা সাউথ হাসপাতালের হসপিস কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকালে) তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। বীর উত্তম খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা সি আর দত্তের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন ও সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সি আর দত্তের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে।
সি আর দত্ত গত কয়েক বছর ধরে ছেলে ডাঃ রাজা দত্ত, মেয়ে মহুয়া দত্ত, পুত্রবধূ, জামাতা ও দুই নাতির সঙ্গে নিউইয়র্কে বসবাস করে আসছিলেন বলে জামাতা প্রদীপ দাসগুপ্ত জানিয়েছেন। গত বিজয় দিবসে নিউইয়র্কে ছেলে রাজা দত্তের বাসায় যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আয়োজনে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে একাত্তরের স্মৃতিচারণ করেন তিনি। সে সময় তিনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কোন অনুষ্ঠানে সেটাই ছিল তার সর্বশেষ বক্তৃতা।
গত বছরের শেষ দিকে ফ্লোরিডায় ছোট মেয়ে কবিতা দাসগুপ্ত হ্যাপির বাসায় চলে যান সি আর দত্ত। এ বছর মার্চে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়লে নিউইয়র্কে না ফিরে তিনি ফ্লোরিডাতেই থেকে যান। প্রদীপ দাসগুপ্ত জানান, সম্প্রতি বাথরুমে পড়ে গিয়ে ডান পায়ের গোড়ালি ভেঙ্গে যায় সি আর দত্তের। হাসপাতালে নেয়ার পর তার পায়ে অস্ত্রোপচারও করা হয়। সে সময় উনাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করতে হয়েছিল। উনি ছিলেন এ্যাজমার পেশেন্ট। সার্জারির পর তার শ্বাসকষ্ট মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়, কিডনিও অচল হয়ে পড়ে। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংজ্ঞা ফেরানো সম্ভব হলেও পরে অবস্থার আরও অবনতি হয়। সোমবার দুপুরেই চিকিৎসকরা তাকে ফেরানোর আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে জানান প্রদীপ।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয় এই মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য করতে চান তারা। তার আরেক মেয়ে কানাডা থেকে ঢাকায় আসছেন বাবার মরদেহ গ্রহণ করার জন্য। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব প্রবীণ সাংবাদিক হারুন হাবীব বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে তিনি আর ফিরলেন না। চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের জন্য জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে সিআর দত্ত বীর উত্তমকে স্মরণ রাখবে। রাষ্ট্রপতি প্রয়াতের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সি আর দত্তের মৃত্যুতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ রাখবে। প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত সি আর দত্তের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। শোকবার্তায় তিনি বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সি আর দত্তের আত্মার শান্তি কামনা ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়া, সি আর দত্তের মৃত্যুতে ডেপুটি স্পীকার মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া ও চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি অসমের রাজধানী শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন সি আর দত্ত। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ছিলেন পুলিশ অফিসার। প্রাথমিক শিক্ষা শিলংয়ে শুরু হলেও পরে তার পরিবার স্থায়ীভাবে চলে আসে হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাসের পর খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন সি আর দত্ত। ১৯৫১ সালে যোগ দেন তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন সি আর দত্ত। সেই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে।
১৯৭১ সালে ৪ নম্বর সেক্টরে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে নিজেই নেতৃত্ব দেন সি আর দত্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের চূড়ান্ত মুহূর্ত যখন উপস্থিত, সে সময় ছুটিতে দেশেই ছিলেন সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মেজর সি আর দত্ত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তাকে দেয়া হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব। সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেল লাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত ৪ নম্বর সেক্টর ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থান।