মাহে রমজান: প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা

41

হাফিজ মাওলানা ফরহাদ আহমদ :
পবিত্র রমজানুল কারীম আমাদের দোরগোড়ায়। রহমত ও মাগফেরাতের মাস এটি। এ মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অগণিত বান্দাহকে মাফ করেন। এ মাসে বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, দোজখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। পবিত্র কুরআনুল কারীম এ মাসে নাজিল হয়েছে। এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ মাসে একটি ফরজ ইবাদত সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সমতূল্য। এ মাসের নফল ইবাদত প্রতিদানের দিক দিয়ে ফরজের সমান। এ মাসে বিশেষ কিছু ইবাদত আছে, যা অন্য মাসে নেই। বান্দাহর জন্যে আল্লাহর নৈকট্যলাভের মহাসুযোগ রয়েছে এ মাসে।
আমরা যদি রমজানের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি- গোনাহ ছাড়তে পারি এবং তাক্বওয়া অর্জন করতে পারি, তাহলে বাকি এগারো মাসেও গোনাহমুক্ত তাক্বওয়া ভিত্তিক জীবন যাপন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে। পক্ষান্তরে আমরা যদি রমজান হেলায় কাটিয়ে দিই, তাহলে বাকি এগারো মাস আমরা যেমন ছিলাম, তেমনই থাকবো। আমাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসবে না, তাকওয়া অর্জন করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
তাই, এখন থেকেই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে- আগত রমজান যেনো আমার জন্যে নাজাতের ওসিলা হয়।
রাসূল সা. হাদীসের মধ্যে ইরশাদ করেন-‘তোমাদের কেউ যখন কোনো আমল করে, তখন সে তা ভালোভাবে সম্পাদন করাকে আল্লাহ পছন্দ করেন।’ (আল মু’জামুল আউসাত লিত্তাবরানী- হাদীস নং: ৮৯১)
তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে রমজানে আমাদের আমলগুলো নিখুঁত, শুদ্ধ ও পরিপাটি হতে হবে। এটা করতে হলে প্রয়োজন পূর্ব পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরাম এবং পূর্বসূরি বুযুর্গরা রমজান আসার আগেই রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন।
হুজুর (সা.) রজব মাস শুরু হতেই রমজান পর্যন্ত পৌঁছার দোয়া করতেন। সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফরা রমজান আসার আগেই আটঘাট বেধে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন।
হযরত ইবনু রজব হাম্বলি রাহ. লাত্বাইফুল মাআ’রিফ নামক কিতাবে মুয়া’ল্লা ইবনুল ফযলের উক্তি উল্লেখ করেন, তিনি বলেন-
‘পূর্ববর্তীরা ছয়মাস আগ থেকেই আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন তাঁদেরকে যেনো রমজান পর্যন্ত পৌঁছানো হয় এবং পরের ছয়মাস দোয়া করতেন রমজানটা যেনো তাঁদের পক্ষ থেকে কবুল করা হয়।
রমজানের জন্যে প্রস্তুতিমূলক কাজ:
রমজানুল মুবারককে নিজেদের জন্যে কার্যত রহমত হিসেবে রূপান্তরিত করতে হলে আমাদেরকে নিম্নোক্ত প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো করতে হবে।
(১) গোনাহ ছেড়ে দেয়া এবং তাওবাহ ইস্তিগফার করা:
রমজান মাস ইবাদতের মাস। আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির মাস। মানুষের কলব গোনাহমুক্ত না হলে ইবাদতে একাগ্রতা আসে না। পাপিষ্ঠ অন্তরে রহমতের বারিও বর্ষিত হয় না।
হযরত হাসান বসরী রাহ. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন- মানুষ যখন কোনো পাপ করে, তখন সে রাত জেগে ইবাদতের তাউফিক হতে বঞ্চিত হয়।
তাই রমজানে ইবাদতের তাউফিক পেতে হলে এবং আল্লাহর রহমতে অবগাহন করতে হলে এখন থেকে সমস্ত গোনাহ ছেড়ে দিতে হবে, পেছনের গোনাগ থেকে আল্লাহর কাছে খালেস দিলে তাওবাহ করতে হবে। পুতঃপবিত্র দেহমন নিয়ে একনিষ্ঠতার সাথে মহান রবের ইবাদতে মশগুল হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
(২) হালাল খাদ্য গ্রহণ করা এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকা:
রমজানে মকবুল ইবাদতের তাউফিক পেতে হলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো- হালাল খাওয়া এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকা। কারণ দোয়া ও ইবাদত কবুল হওয়া এবং আখিরাতের মুক্তির জন্যে পূর্বশর্ত হলো হালাল ভক্ষণ। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলগণকে যা করার আদেশ করেছেন ঈমানদারগণকেও সে কাজই করার আদেশ করেছেন।’ আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু (হালাল) হতে ভক্ষণ করো, এবং নেক কাজ (আমলে সালিহ) করো।’ (আল্লাহ তাআলা) আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে আমি যেসব পবিত্র বস্তু রিজিক হিসেবে দিয়েছি, তা থেকে আহার করো।’অতঃপর রাসুল সা. এমন এক ব্যক্তির উল্লেখ করলেন, যে দূরদূরান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সফর করে। ফলে তার চুলগুলো এলোমেলো ও ধূলি-ধূসরিত রুক্ষ হয়ে পড়েছে। সে আসমানের দিকে হাত উত্তোলন করে বলছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং আহার্য হারাম। এ অবস্থায় আল্লাহ কেমন করে তার দোয়া কবুল করতে পারেন?’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩৯৩)
অন্য হাদীসে আছে ‘হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সা. ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি হালাল খায়, সুন্নাহ মোতাবিক আমল করে এবং মানুষ তাঁর অনিষ্টতা থেকে মুক্ত থাকে- সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিযী- হাদীস নং ২৫২০)
উপরিউক্ত হাদীসদুটি থেকে আমরা জানতে পারলাম- ইবাদত ও দোয়া কবুল হতে হলে এবং আখেরাতে মুক্তি পেতে হলে হালাল রিজিক ভক্ষণ করতে হবে। তাই রমজানে আমাদের রিজিক যেনো পূর্ণ হালাল হয়, সেদিকে সতর্কদৃষ্টি রাখতে হবে। আরেফ বিল্লাহ ডা. আব্দুল হাই রাহ. বলতেন- কারো মালে যদি হারামের সংমিশ্রণ থাকে, তাহলে প্রয়োজনে সে ঋণ করে রমজানের ব্যয় নির্বাহ করবে, তারপরও হারাম মাল তার পেটে ঢুকাবে না।
(৩) রোজা সংক্রান্ত মাসআলা মাসাঈল শিক্ষা
রমজানের আরেকটা প্রস্তুতি হচ্ছে রমজান আসার আগেই রোজার প্রয়োজনীয় মাসআলাগুলো শিখে নেয়া। আজকাল এসব মাসআলা শেখা তেমন কঠিন নয়। ইউটিউবে রোজার ফাযাইল মাসাঈল সম্পর্কে হক্কানী উলামায়ে কেরামের প্রচুর ভিডিও আছে। এগুলো শুনা যেতে পারে। যাঁদের হাতে সময় আছে, তাঁরা বাংলা ভাষায় রচিত রমজান ও রোজা সংক্রান্ত বই পড়তে পারেন। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় রচিত ও অনূদিত নিম্নোক্ত কিতাবগুলো পড়া যেতে পারে- কিভাবে কাটাবেন মাহে রামাজান- আল্লামা তাকী উসমানী, সিয়াম ও রামাজান, ফাযায়েল ও মাসায়েল- মারকাযুদ্দা’ওয়াহ, রমজানুল মুবারকের সওগাত- আল্লামা তাকী উসমানী, সিয়াম সাধনা ও শান্তির পথ- ইমাম গাজালী, ইসলামে রোজা ও যাকাতের বিধান- মুফতি রফী উসমানী, তোহফায়ে রামাজান- মুফতি সালমান মনসুরপুরী, রমজানের আধুনিক জরুরী মাসায়েল- ইসলামিয়া কুতুবখানা, আহকামে এ’তেকাফ- মুফতি তাকী উসমানী। বইগুলো রকমারিতে অর্ডার দিয়ে সংগ্রহ করতে পারেন অথবা এগুলোর পিডিএফ ফাইলও ডাউনলোড করতে পারেন
(৪) শা’বানে আমলের রিহার্সেল করে নেয়া
রমজান মাসে বিশেষ কিছু ইবাদত আছে, যেগুলো বছরের অন্য সময় করা হয় না। রমজানে দিনে রোজা রাখতে হয় এবং রাতে লম্বা নামাজ পড়তে হয়। শা’বান মাসে এগুলোর অনুশীলন শুরু করে দিলে রমজানে কাজগুলো সহজ হবে। রাসূল সা. শা’বান মাসে প্রচুর পরিমাণে রোজা রাখতেন। হাদীসে বর্ণিত আছে-
তাই শা’বান মাসে নফল রোজা রাখা এবং রাত জেগে নফল নামাজ পড়ার আমল করা যেতে পারে। তাছাড়া তিলাওয়াত ও তাসবিহ-তাহলীলের আমলও শা’বানে বাড়ানো যেতে পারে। যাতে রমজানের আমলগুলো সহজাতভাবে করা যায়।
(৫) আগের রমজানে ত্রুটি ও কমতিগুলো চিহ্নিত করা:
রমজান আসার আগেই একটু ফিকির করে আগের রমজানের ভুলত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে নেয়া উচিত। যাতে একই ভুল দ্বিতীয়বার না হয়। আগের রমজানে যেসব কারণে একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করা যায় নি, এগুলো এ রমজান আসার আগেই শোধরে নেয়া দরকার। যাতে করে রমজান মাস পরিকল্পিতভাবে ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে কাটানো যায়।
(৬) আমলের রুটিন করে নেয়া:
রমজান মাসকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হলে আগে থেকে রুটিন করে নেয়া উচিত। রমজানের একটু। মুহূর্তও যাতে বেকার না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। বর্তমানে দেশের সর্বত্র লকডাউন চলছে। হোম কোয়ারেন্টাইনকে সম্পূর্ণভাবে ইবাদ বন্দেগীতে মশগুল রাখার জন্যে পূর্বপরিকল্পনা, রুটিন ও ছক তৈরি করে নেয়া ভালো।
(৭) বিশেষ ইবাদতের প্রস্তুতি:
রমজানের বিশেষ ইবাদতগুলো সুচারুরূপে পালন করার জন্যে আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়ার দরকার। রমজানের সবচেয়ে বড় আমল হচ্ছে রোজা রাখা। রোজা রাখার জন্যে প্রস্তুতি শা’বান মাসেই নেয়া উচিত। সাহরী ও ইফতারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী যোগাড় করে নেয়া ভালো। ব্যবসা বাণিজ্য, দুনিয়াবি ঝামেলা ও দৌড়ঝাঁপ যথাসম্ভব কমিয়ে আনা ভালো।
রমজানের একটি বিশেষ ইবাদত হচ্ছে তারাবিহ। তারাবিহর নামাজে কুরআন খতম করা এটাও আলাদা এক ইবাদত। যেহেতু বর্তমান জরুরী অবস্থায় প্রত্যেক মসজিদে খতমে তারাবিহ হওয়া অনিশ্চিত, তাই ব্যক্তি উদ্যোগে ঘরে ঘরে খতমে তারাবিহর জামাত চালু করা করা যেতে পারে। এর জন্যে এখন থেকেই চিন্তা ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
রমজানের আরেকটা বিশেষ ইবাদত হচ্ছে শেষ দশকে ই’তিকাফ করা। ই’তিকাফের ফযিলত থেকে কাউকে মাহরুম না হওয়া চাই। সাংসারিক ঝামেলা থেকে ফারেগ হয়ে নিবিষ্টমনে ই’তিকাফ করার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি এখন থেকেই গ্রহণ করতে হবে।
তাছাড়া রমজানে উমরাহ করা এবং দান সাদাকাহ করারও বিশেষ ফযিলত আছে। তাই যাঁদের সামর্থ আছে, তাঁরা রমজানে বেশি করে সাদাকাহ করা এবং সম্ভব হলে উমরাহর নিয়ত করা উচিত। এজন্যে মানসিক ও আর্থিক প্রস্তুতি এখন থেকেই গ্রহণ করতে হবে।
(৮) আল্লাহর কাছে তাউফিক কামনা করা:
রমজান মাস যাতে সুস্থতার সাথে যথাযথভাবে ইবাদত করা যায়, এজন্যে এখন থেকে আল্লাহর কাছে তাউফিক কামনা করতে হবে। বেশি বেশি করে তাওবাহ ইস্তিগফার করে দেহমনকে পাকসাফ করে রবের দরবারে দাঁড়াবার উপযোগী করে তুলতে হবে।
আল্লাহ তায়া’লা যেনো আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত হায়াত দেন এবং কাঙ্খিত উপায়ে যেনো রমজান কাটানোর তাউফিক দান করেন। আমীন।
লেখক: শিক্ষক- জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর, বিয়ানীবাজার, সিলেট।