বিএনপিতে গুরুত্ব হারাচ্ছে জামায়াত

23

কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘আপনাদের সঙ্গে জোট করে আমরা চাপে পড়েছি’ গত অক্টোবরে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম খানের এমন মন্তব্য শরিকদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
এই কথাটি নজরুল বলেছিলেন জোটের প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীকে উদ্দেশ করেই। ১৯৯৯ সালের পর থেকে জোটবদ্ধ দুই দলের মধ্যে নানা সময় মান-অভিমান হয়েছে, কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে এমন কথা কখনো বলা হয়নি।
দেড় যুগ আগে জোটবদ্ধ হওয়ার পর থেকে বিএনপির নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জামায়াতের যে ভূমিকা দেখা গেছে, তা এখন আর নজরে আসছে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকে বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত জামায়াতকে ছাড়াই নিচ্ছে। যদিও সিদ্ধান্ত হওয়ার পর জামায়াতের সঙ্গেও বসেছে তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমি বিষয়টি এইভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই যে, বিএনপি জনগণের দল। জনগণের মতামতই এখানে প্রাধান্য পাবে। আর জামায়াতের তো নিবন্ধন নেই। তাদের প্রতীক নেই। যে কারণে তারা হয়তো তাদের অতীতের যেসব বিষয় নিয়ে জনগণের মধ্যে নানা প্রশ্ন আছে, সেই বিষয়গুলোতে সংস্কার আনতে পারে। সেটা তাদের জন্য ভালো।’
বিএনপিতে জামায়াতের গুরুত্ব কমেছে কি না এমন প্রশ্নে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই সদস্য হাসি দিয়ে বলেন, ‘আপনিই বিচার করুন। জামায়াতের লোক আছে আমাদের সঙ্গে। কিন্তু দল নেই। কারণ তারা জামায়াত নামে তো দলও করতে পারছে না। এখন নির্বাচন করতে হবে স্বতন্ত্র বা অন্য কারও প্রতীক নিয়ে।’
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে ছিল বিএনপি। কিন্তু সে সময় জামায়াতের চাপাচাপিতে দলটি ভোটে যায়। আর ভোটে বাজে ফলাফলের পর প্রকাশ্যেই জামায়াতের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন বিএনপির সেই সময়ের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। আবার ২০১৪ সালে বিএনপির ভোট বর্জনের পেছনেও জামায়াতের প্রভাব ছিল ব্যাপক।
তবে এবার উল্টে গেছে দাবার ছক। বিএনপি ভোটে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত জামায়াতের নেতারা বর্জনের পক্ষেই কথা বলেছেন। কিন্তু ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার একদিন পর বিএনপি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আর ১১ নভেম্বর ভোটে আসার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই নিশ্চিত হয়ে যায়, এবার আর বর্জনের পথে হাঁটছে না আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলটি।
আর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ১০ নভেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে ২০ দলের অন্য শরিকদের পাশাপাশি জামায়াতেরও মত নেয় বিএনপি। তবে সেটি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
এবার জোটের মধ্যে আসন বণ্টনের আলোচনাতেও জামায়াতের দাবির বিষয়টি নিয়ে বিএনপি যতটা ভাবছে, তার চেয়ে বেশি কথা হচ্ছে আরেক শরিক জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিষয়টি নিয়ে।
গত ১৩ অক্টোবর গণফোরামের নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এরপর সরকারের সঙ্গে সংলাপ, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা বা অন্য যেকোনো সিদ্ধান্তে জামায়াতকে ডাকেনি।
বিএনপির নেতারা বলছেন, জামায়াত সমস্যায় জর্জরিত। তাদের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি হয়েছে, কেউ কারাগারে। নিবন্ধনও হারিয়েছে দলটি। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই চাপে আছে দলটি। এখন দলটিকে আগের মতো গুরুত্ব দিয়ে সমালোচনা গায়ে মাখতে চান না তারা।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের ভোট বিএনপির জন্য কার্যকর প্রমাণিত হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট প্রায় সমান হলেও জামায়াতের ৪ শতাংশের কিছু বেশি ভোট যোগ হওয়ায় নির্বাচনে ভূমিধস জয় পায় বিএনপি।
কিন্তু একাত্তরের আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রী করার পরই সমালোচনায় পড়ে বিএনপি। আর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে জোট আর কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। বরং উল্টো বিএনপির জন্য বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। আগের বারের চেয়ে ৮ শতাংশ ভোটই কেবল কমেনি তাদের, আসনও কমে ১৬৩টি।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ২০১৩ সালে সহিংস আন্দোলনের পরও জামায়াতকে দায়ী করা হয়। আর ওই নির্বাচনের পর একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেন, সময় এলে জামায়াতকে ছেড়ে দেবেন তিনি।
তবে ২০১৫ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও জামায়াতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে বিএনপি। তখনো ব্যাপক সহিংসতা হয়। আর দ্বিতীয়বারের মতো খালি হাতে ঘরে ফেরে বিএনপি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘নিবন্ধন না থাকলেও জামায়াত আমাদের জোটসঙ্গী। সবাই মিলেই সবকিছুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও নতুন করে ঐক্যফ্রন্ট যুক্ত হয়েছে। যে কারণে এমনটা মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।’
দলের অন্য একজন ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে ঐক্যফ্রন্ট হওয়ার পর থেকে জামায়াতের গুরুত্বটা ডাইভার্ট হয়ে গেছে; যা অনেকটা দৃশ্যমানও।’