শুরু হচ্ছে আওয়ামী লীগের শুদ্ধি অভিযান ॥ আজ কৃষক লীগের সম্মেলন

23

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ধারাবাহিক সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোয় বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান আজ থেকে শুরু হচ্ছে। প্রায় সাড়ে সাত বছর পর আজ বুধবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন কৃষক লীগের দশম জাতীয় সম্মেলন। সকাল এগারোটায় রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কৃষক লীগের সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করা হবে।
কৃষক লীগের সম্মেলনের মাধ্যমেই ক্ষমতাসীন দলটিতে শুরু হচ্ছে বড় শুদ্ধি অভিযান। কৃষক লীগের সম্মেলনেও সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থ ও বিতর্কিতদের ঝেড়ে ফেলে ক্লিন ইমেজের নতুন নেতৃত্ব আসছে, এটি প্রায় স্পষ্ট। কৃষক লীগের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নির্মিত দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল মঞ্চেই আগামী ১৬ নভেম্বর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং ২৩ নভেম্বর আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ধারাবাহিকভাবে জাতীয় শ্রমিক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সবক’টি সম্মেলনেই প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের এসব সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোতে ‘বুড়ো লীগ’ দের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও ক্লিন ইমেজের নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসা হবে। সম্মেলনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দলটিতে একদিকে যেমন বড় পদ পেতে তরুণ ও সাবেক ছাত্র নেতাদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহী-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তেমনি গত ১০ বছরে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নেতৃত্বে থাকা বিতর্কিত ও দুর্নীতির গড্ডালিকায় গা ভাসিয়েছেন তাদের পদ হারানোর আতঙ্ক স্পষ্ট। কারণ দলের বিভিন্ন বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিতর্কিতদের মূল দল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোন পদে রাখা হবে না।
১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির কার্যক্রমে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে কাজ করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষক লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ১৫ আগস্টে শহীদ কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত। বঙ্গবন্ধু শেষ প্রত্যাশা নিয়ে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, গত ১০ বছরে বর্তমান কৃষক লীগের নেতারা তার কতটুকু পালন করতে পেরেছেন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সারাদেশে কৃষক কল্যাণ কিংবা কৃষকদের উন্নয়নে কৃষক লীগের ভূমিকা কতটুকু ছিল, এ প্রশ্ন উঠলে সংগঠনটির অনেক কেন্দ্রীয় নেতারা তার কোন পরিসংখ্যানই দিতে পারেননি। শুধু দিবস ভিত্তিক কিছু কর্মসূচী ছাড়া সাংগঠনিক শক্তির ওপর ভর করে সারাদেশে কৃষকদের উন্নয়নে তেমন কোন ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বর্তমান নেতারা।
কৃষক লীগের গত ১০ বছরের ভূমিকা মূল্যায়ন করেই আজকের সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনটিকে ঢেলে সাজানো হতে পারে বলেই দলীয় সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে। প্রকৃত কৃষক সংগঠক এবং তৃণমূলে কৃষকদের কল্যাণে কাজ করতে পারবেন এমন নেতাদের বাছাই করেই এবার কৃষক লীগের কমিটি গঠন করা হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা মাধ্যমে কৃষক লীগের নেতাদের তথ্য নিয়ে ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব বাছাই করেছেন। জানা গেছে, আজ উদ্বোধনের পর দ্বিতীয় অধিবেশনে কৃষক লীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে, তাতে বর্তমান নেতৃত্বে থাকা অধিকাংশ নেতাই বাদ পড়তে পারে।
কৃষক লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। সম্মেলনের মাধ্যমে মোতাহার হোসেন মোল্লাকে সভাপতি ও এ্যাডভোকেট খন্দকার শামসুল হক রেজাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে এবারের সম্মেলনকে সামনে রেখে বর্তমানে নেতৃত্বে থাকা নেতারা ছাড়াও কৃষক লীগের সঙ্গে জড়িত অনেক নতুন মুখ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে ব্যাপক লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বেশ ক’জন কৃষিবিদও রয়েছেন। সবাই তাকিয়ে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। দলের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর মতামত এবং কাউন্সিলরদের আশা-আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েই ঘোষণা করা হবে কৃষক লীগের নতুন কমিটি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কৃষক লীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনের স্থলে ৯০ ফুট দীর্ঘ ও ৩০ ফুট প্রস্থ সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। মূলত কৃষকের কাচারি ঘরের আদলেই তৈরি করা হয়েছে এই মঞ্চ। মঞ্চের পাশে রাখা হয়েছে ‘আমার বাড়ি-আমার খামার’ স্লোগানের একটি মডেল। এতে দেখা যাচ্ছে, কৃষক তার উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রি করছেন এমন দৃশ্য।
সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে কৃষক লীগের নেতারা জানান, কৃষক লীগের জাতীয় সম্মেলনকে সফল করতে সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ হয়েছে। এই সম্মেলনকে ঘিরে এখন সাজ সাজ রব বিরাজ করছে। মূলমঞ্চ নির্মাণ করা হচ্ছে কৃষকের কাচারি ঘরের আদলে। নেতারা জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে স্থানে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাড়ি থেকে নেমে মঞ্চে আসবেন, সে প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়েছে সবুজ ঘাসে। রাস্তার চারপাশে লাগানো হয়েছে বাঁশবাগান, ফলদি ও ওষুধি গাছ। মোটকথা, কৃষক লীগের সম্মেলনে কৃষকের বাড়িতে আসবেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সেভাবেই সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
সকাল ১১টায় জাতীয় সম্মেলন শুরু হবে। প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা এবং বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। সংগঠনের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট খন্দকার শামসুল হক রেজার পরিচালনায় উদ্বোধনী অধিবেশনে শোক প্রস্তাব ও সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট উপস্থাপন করা হবে। এ সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও বক্তব্য রাখবেন। উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে দুপুর আড়াইটায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্ব কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এতে গঠনতন্ত্রের সংশোধনী প্রস্তাব উপস্থাপন ও অনুমোদিত হবে। এরপর নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন ও ঘোষণা করা হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সারাদেশে সংগঠনের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা থেকে প্রায় ৭ হাজার কাউন্সিলর ও ৯ হাজার ডেলিগেটস সম্মেলনে যোগ দেবেন। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নেতারাও সম্মেলনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন
কৃষক লীগ সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে সংগঠনটি কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ১১১ থেকে বাড়িয়ে ১৫১ করার সুপারিশ করবে। এছাড়া বর্তমান স্লোগান ‘কৃষক বাঁচাও-দেশ বাঁচাও’ পরিবর্তন করে ‘সুখী কৃষক-সুখী দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ করার জন্যও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রস্তাব দেবেন কৃষক লীগ নেতারা। কারণ হিসেবে নেতারা বলছেন, এক সময় কৃষকের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। এখন কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। সে কারণেই কৃষক লীগের স্লোগান পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেলে পরে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হবে।
জানা গেছে, সংগঠনের বর্তমান সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা আবারও একই পদে থাকতে ইচ্ছুক। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজাও সভাপতি পদে আসতে আগ্রহী। সভাপতি পদে পদপ্রত্যাশীর তালিকায় আরও রয়েছেন- সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি খান আলতাফ হোসেন ভুল, সহ-সভাপতি ওমর ফারুক, সাবেক এমপি ছবি বিশ্বাস, সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট হারুন অর রশীদ, বদিউজ্জামান বাদশা, বর্তমান নেতা শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, শরীফ আশরাফ হোসেনসহ প্রায় এক ডজন নেতা। আর সাধারণ সম্পাদক পদে কৃষিবিদ সমীর চন্দ্র, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কৃষিবিদ বিশ্বনাথ সরকার বিটু, কৃষিবিদ সাখাওয়াত হোসেন সুইট, আবুল হোসেন, গাজী জসিম উদ্দিন, আসাদুজ্জামান বিপুল, আতিকুল হক আতিকসহ অনেকেই।