মহাসড়ক থেকে টোল আদায়ের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

49
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চায়না কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন যাওয়ার প্রাক্কালে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে গ্রুপ ছবিতে অংশ নেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে সড়ক ও মহাসড়কের ওপর নির্মিত ব্রীজ, সেতু থেকে টোল আদায়ের রীতি থাকলেও মহাসড়ক ব্যবহার করার জন্য টোল দেয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে এটি বাইরের অনেক দেশেই রয়েছে। বিদেশের মতো এবার দেশেও টোলের আওতায় আনা হচ্ছে জাতীয় মহাসড়ক। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় মহাসড়কগুলো টোলের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। টোল থেকে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা দিয়েই সারা বছর সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে পণ্য পরিবহনের উৎসমুখে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্প নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ওই নির্দেশ দেন। বৈঠকে মোট ১০ প্রকল্পে অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৩২৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিল থেকে ৫ হাজার ৩২৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ৯৯৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা খরচ করা হবে।
বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের কথা জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন যে দেশের মহাসড়কগুলো টোল সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে। টোল থেকে আদায়কৃত অর্থ একটা এ্যাকাউন্টে জমা রাখতে হবে। পরবর্তীতে ওই অর্থ দিয়ে সংশ্লিষ্ট মহাসড়কগুলোর মেনটেইনেন্স (রক্ষণাবেক্ষণ) ব্যয় নির্বাহ করতে হবে। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন সেতু এবং ফ্লাইওভারে চলাচলের জন্য যানবাহনের ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত হারে টোল আদায়ের ব্যবস্থা থাকলেও কোন মহাসড়কে চলার জন্য টোল দিতে হয় না।
বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা সচিব নুরুল আমিন, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম এবং ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস।
দেশে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতায় সড়ক রয়েছে ২১ হাজার ৫৯৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯০৬ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক। বিশ্বে অনেক দেশেই যে মহাসড়কে টোল আদায়ের ব্যবস্থা আছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, টোলের জন্য বিশেষ করে জাতীয় মহাসড়কগুলোর কথা বলা হয়েছে। যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-খুলনা এবং ঢাকা-রংপুর এসব মহাসড়কেই টোল আদায়ের কথা বলা হয়েছে। পশ্চিমা দেশে এটা খুবই জনপ্রিয়। এটাকে তারা বলে ‘ইউজার পেইড’ বা ব্যবহার করেন, পেমেন্ট করেন। এই টোলের টাকা আলাদা এ্যাকাউন্টে যাবে। এগুলো রাস্তা মেরামতে ব্যয় করা হবে। মহাসড়কে টোল আদায় হলে বিভিন্ন সেতু থেকে আদায় করা টোল থাকবে না বন্ধ হয়ে যাবে এমন এক প্রশ্নে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এটি পরিকল্পনা হবে। বিষয়টি ভেবে দেখা হবে। যেটি ভাল হবে সেটিই প্রস্তাব করা হবে।
কীভাবে টোল আদায় হবে তা তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বিদেশে আমরা যেটা দেখেছি, সেকশন সেকশন হয়। ধরুন, ২০০ মাইল রাস্তা। প্রত্যেক ৫০ মাইল রাস্তায় একটা গেট থাকে। স্থানীয় গাড়িগুলো ১০ মাইল গিয়ে আরেক রাস্তায় গেলে টোল আসবে না। লং ডিসটেন্স ট্রাভেলারদের (দূরবর্তী যানবাহন) জন্য এটা হবে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কাজ করবেন আমাদের প্রকৌশলীরা।
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কয়েকটি নির্দেশনার কথাও বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী। বৈঠকে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে ভারি যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে ‘এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ স্থাপন হওয়ার পর গাড়ির ওজন মাপার প্রক্রিয়া কেউ যেন ‘টেম্পারিং’ করতে না পারে সেজন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। যাতে মনিটরিংয়ের জন্য সমন্বিত একটি সার্কিট ব্যবস্থা থাকবে। ডিজিটাল সমন্বিত সার্কিট ব্যবস্থা থাকলে ফাঁকির পরিমাণ কমবে। এছাড়াও বাস/ট্রাক মহাসড়কে চলার সময় যাতে সিট ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত লোক বহন না হয় কিংবা ট্রাকের নির্দিষ্ট আকারের চেয়ে যেন ‘ওভার সাইজ’ না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখতে বলেছেন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ঢাকার বাইরে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। যাতে মানুষ ঢাকামুখী না হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যেক প্রকল্পে লোকবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দ্রুত সম্পন্ন করার কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
সভায় অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হচ্ছে, কুড়িগ্রাম (দাসের হাট)-ভুরুঙ্গামারী-সোনাহাট স্থলবন্দর সড়ক জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৬৮৫ কোটি টাকা। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে পণ্যবহনের উৎসমুখে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৩০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। জানা গেছে, যানবাহনের অতিরিক্ত ওজনের (ওভারলোড) কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হচ্ছে সড়কের আয়ুষ্কাল। দেশের সড়কের এমন পরিণতি ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের উৎসমুখে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্যই এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
এছাড়াও ভুয়াপুর-তারাকান্দি জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। চারলেনে উন্নীত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চার বছরের জন্য পারফরম্যান্স বেইজড অপারেশন ও দৃঢ়করণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৭৯৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
সব ক্ষেত্রে নিরাপদ পানি ব্যবহার জনস্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম শর্ত। কিন্তু পরিবেশে রাসায়নিক দ্রব্য ও জীবাণুর কারণে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি এখন সবার জন্য প্রায় দুষ্প্রাপ্য। তাই সারাদেশের মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে ৫২টি নতুন পরীক্ষাগার স্থাপন করতে নেয়া হয়েছে ১৭৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকার প্রকল্প। পানির গুণগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প নামের প্রকল্পটি ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হবে।
নরসিংদী জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩২৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। কারাগার নিয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রত্যেক কারাগারে ভার্চুয়াল কোর্ট সিস্টেম চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, কারাবন্দীর মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ৫০ শতাংশ কারাবন্দী বা তার পরিবারকে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি কারাগারে ভার্চুয়াল কোর্ট সিস্টেমও চালুর কথা বলেছেন তিনি।
মানসম্পন্ন বীজ আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৬৮৮ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ বিষয়ে বিদেশে চাহিদা আছে এমন জাতের আলুর উৎপাদনের দিকে নজর দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী। এমএ মান্নান আরও বলেন, আগেই বলেছিলেন কার্গো বিমান কেনার কথা। প্রধানমন্ত্রী আবারও সেটি বলেছেন ২টি কার্গো বিমান কেনা হবে যাতে নিজেদের ভাড়া দিয়ে নয় বরং নিজেদের কার্গোতেই সবজি রফতানি করা যায়।
অনুমোদিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাব-স্কাউটিং সম্প্রসারণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩৫৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৪৫১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্প অনুমোদনকালে প্রধানমন্ত্রী দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কত সেই পরিসখ্যানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, পুরনো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে যাতে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় যে কত শিক্ষার্থী তারা ভর্তি করতে পারবে। এজন্য একটি নীতিমালা করতে হবে। প্রয়োজন হলে যেসব জেলায় বিশ^বিদ্যালয় নেই সেসব জেলায় নতুন করে তা করতে হবে।
কনভারশন অব ১৫০ মেগাওয়াট সিলেট গ্যাস টারবাইন পাওয়ার প্ল্যান্ট টু ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৯১০ কোটি ৬ লাখ টাকা। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুুদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীবর্গ সভার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। সভায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, এসডিজির মুখ্য সমন্বয়ক, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের সচিব এবং উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।