ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী ॥ নীতি ও আদর্শ না থাকলে সাময়িক নেতা হওয়া যায়, কিন্তু দেশকে কিছুই দেওয়া যায় না

46
ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্মারক প্রদান করা হয়।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগের জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, নীতি ও আদর্শ না থাকলে সাময়িক নেতা হওয়া যায়, কিন্তু সেই নেতৃত্ব দেশকে কিছুই দিতে পারে না। নীতি-আদর্শ নিয়ে চললে দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা যায়। যা একজন রাজনীতিবিদের কাছে অমূল্য সম্পদ। তাই ত্যাগের মহিমায় বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ নিয়ে এদেশের মানুষের জন্য কিছু করে যেতে পারলেই জাতির পিতার আত্মা শান্তি পাবে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ গৃহীত মাসব্যাপী কর্মসূচীর সমাপনী দিনে শনিবার গণভবনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করা স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে প্রমাণিত করতেই এই হত্যাকা- ঘটানো হয়।
তিনি বলেন, সারাজীবন বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে শুধু দিয়েই গেছেন, কোন কিছুই নিয়ে যাননি। শেষে বুকের রক্ত পর্যন্ত দিয়ে গেছেন। তার সন্তান হিসেবে আমার ব্যক্তিগত কোন কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। সন্তানদের জন্য কি করে গেলাম সেটিও চিন্তা করি না। শুধুমাত্র দেশের মানুষকে কী দিতে পারলাম, তাদের জন্য কতটুকু করতে পেরেছি সেটিই আমার প্রধান লক্ষ্য, বিবেচ্য বিষয়। সেই লক্ষ্য নিয়েই ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে দিনরাত পরিশ্রম করেছি বলেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসু’র জিএস গোলাম রাব্বানীর পরিচালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জীব দাস, সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন, ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম, সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান হৃদয়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মেহেদী হাসান ও সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের আহমেদ।
অনুষ্ঠানে সুদীর্ঘ ৫১ বছরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঐতিহ্য, সংগ্রাম, আন্দোলন ও দেশের জন্য আত্মত্যাগের একটি ভিডিও প্রমাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। দেখানো হয় ছাত্রলীগের কর্মীদের বানানো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মোবাইল গেম প্রোমো। ছাত্রলীগের বার্ষিক প্রকাশনা মাতৃভূমি এবং মাসিক প্রকাশনা জয় বাংলার মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল এবং কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলকে নিয়ে আঁকা চিত্রকর্ম প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেয়া হয়। আর ছাত্রলীগের এই আলোচনার মাধ্যমে শেষ হলো জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে নেয়া আওয়ামী লীগের মাসব্যাপী কর্মসূচী।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞ, একই দিনে বাবা-মা-ভাইসহ সব আত্মীয়-স্বজন হারানোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বার বার আবেগে জড়িয়ে পড়েন, ভেঙ্গে পড়েন কান্নায়। এ সময় পুরো অনুষ্ঠানস্থলে পিনপতন নীরবতার সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর কন্যার সঙ্গে ছাত্রলীগের বহু নেতা-কর্মীর চোখ দিয়েও বইছিল শোকের অশ্রু। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশের মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। বুকের রক্তও দিয়ে গেছেন, কিন্তু কিছুই নিয়ে যাননি। আমার মা-ভাইসহ নিহতদের সবাইকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়, কাফনের কাপড়টুকুও দেয়া হয়নি। আর রেডক্রসের রিলিফের কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে জাতির পিতাকে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করা হয়।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ও দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা ও বিজয়কে ব্যর্থ করতে তখনও নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হয়েছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক পাকিস্তানের দালাল ছিল, যারা পরবর্তীতে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাদের বিচার শুরু করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি প্রদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলছিলেন। কিন্তু পরাজিত শত্রু ও তাদের এদেশীয় দোসররা স্বাধীনতার পর ৭ নির্বাচিত এমপিকে হত্যা, পরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে মানুষ হত্যা করেও যখন দেখল জাতির পিতা জনপ্রিয়তা এতটুকু কমানো যায়নি, বরং বাংলাদেশ ক্রমেই শক্তিশালী অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন তখনই ১৫ আগষ্টের নির্মম আঘাত হানা হয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে স্বাধীনতার পরবর্তী ১০ বছরেই বাংলাদেশ বিশ্বসভায় উন্নত-সমৃদ্ধ ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াত।
‘বাকশাল’ নিয়ে সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বাকশাল বলে অনেকে গালি দেয়! কিন্তু বাকশাল মানে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ।
আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র ১৫ দিন আগে আমরা দু’বোন বিদেশে গিয়েছিলাম। কিন্তু এক রাতেই সবাইকে হারিয়ে আমরা নিঃস্ব-রিক্ত, এতিম হয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৬টি বছর আমাদের দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। ’৮১ সালে দেশে ফিরলেও ওই সময় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান আমাকে মিলাদ পড়তে ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। রাস্তায় বসে বাবা-মাসহ পরিবারের নিহত সদস্যদের জন্য মোনাজাত করেছি, মিলাদ পড়েছি। শোক-ব্যথা বুকে নিয়ে দেশে ফিরে আমাদের একমাত্র লক্ষ্যই ছিল দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা, উন্নত জীবন দেয়া। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর অনেকে বলেছিল, স্বাধীন হলে কী হবে বাংলাদেশ হবে ব্যর্থ রাষ্ট্র। তখনই আমার মনে একটা জিদ গড়ে উঠেছিল যে, বাংলাদেশকে আমরা এমনভাবে গড়ে তুলব, যেন সারাবিশ্ব তাকিয়ে দেখে। আজ সারাবিশ্বের সামনে বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের রোলমডেল। এখন বিদেশের কেউ বাংলাদেশকে আর অবজ্ঞার চোখে দেখতে পারে না। আর এটা সম্ভব হয়েছে যে দলটি স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ী হয়, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগ), শুধু তারা ক্ষমতায় আসলেই দেশের উন্নতি হয়। আর যারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, একাত্তরের পরাজিত শক্তির (পাকিস্তান) পদলেহনকারী, তোষামদকারীরা ক্ষমতায় থাকলে তারা কখনই চাইবে না বাংলাদেশ গড়ে উঠুক, মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলুক। তাই তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই দেশের উন্নতি হয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ এখন বিশ্বসভায় উন্নয়নের রোলমডেল। আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মধ্যে এক নম্বরে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। কারণ দেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধু অসম্ভব ভালবাসতেন, তাদের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে গেছেন। সেই দেশের মানুষের কল্যাণ ও উন্নত জীবন দেয়া সন্তান হিসেবে আমার প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটা মনে রেখেই দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি।
জাতির পিতার আদর্শ সম্পর্কে জানতে তাকে নিয়ে লেখাপড়া করার জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, বঙ্গবন্ধুর ডায়েরি নিয়ে লেখা কারাগারের রোজনামচা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার লেখা রিপোর্ট নিয়ে বই প্রকাশিত হচ্ছে। স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রাম-আন্দোলন, আত্মত্যাগ এবং তার আদর্শ সম্পর্কে জানতে হলে বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো পড়তে হবে।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। প্রতিটি ইতিহাসে ছাত্রলীগের নাম রয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামে অনেক ছাত্রলীগ নেতা আত্মাহুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, শোককে বুকে নিয়ে, ব্যথা-বেদনা বুকে চেপে রেখে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করেছি আমরা। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া রাখিনি। যে জাতির জন্য বাবা জীবন দিয়ে গেছেন, তাদের জন্য কতটুকু করতে পেরেছি, সেটিই বিবেচ্য বিষয়। যদি নিজেকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে হয় তাহলে তার মতো ত্যাগী কর্মী হিসেবে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।