আজ অমর একুশে

167

কাজিরবাজার ডেস্ক
তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা…। মায়ের কোলে, সে তো বলাই বাহুল্য, অপার শান্তি। একইভাবে মাতৃভাষায় কথা বলা পরম তৃপ্তির। সন্তানের এটি জন্মগত অধিকার। কিন্তু বাঙালিকে এ অধিকার আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আদায় করতে হয়েছিল।
আজ বৃহস্পতিবার সেই ঐতিহাসিক দিন। পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেয়া অমর একুশে। ১৯৫২ সালের এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছিল বাঙালি। সইমু না আর সইমু না অন্য কথা কইমু না/যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান/এই জানের বদলে রাখুম রে/বাপ-দাদার জবানের মান…। কী আশ্চর্য বোধ। ভাষা চেতনা। সেই বায়ান্ন সালে। ভাবা যায়! মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে মহা ইতিহাস গড়েছিল বাঙালি। সেই থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস। এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিরল মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। দিবসটি সারা বিশ্বে ইন্টারন্যাশনাল মাদার লেগুয়েজ ডে হিসেবে পালিত হচ্ছে।
প্রতিবারের মতো আজও সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হবে মহান শহীদ দিবস। একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। আজ সর্বত্র সকলের কণ্ঠে বাজবে চির বেদনার গান, শোকসঙ্গীত : আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…। বায়ান্নর আত্মত্যাগের ইতিহাস ভোলেনি বাঙালী। সে প্রশ্ন আসে না। বরং প্রতি বছর নতুন আবেগ নব চেতনায় জাগ্রত হয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। একইভাবে আজ রাজধানী ঢাকার সকল পথ গিয়ে মিলবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে স্মৃতির মিনার। সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচী পালন করা হবে। সাধারণ মানুষ সাদা কালো পোশাক পরে ঘর থেকে বের হবেন। এ রঙে শোক। এ রঙই প্রকাশ করবে শক্তি।
বায়ান্নর ভাষার সংগ্রাম আন্দোলিত করেছে বিশ্ববাসীকেও। বহুকাল আগে যে বাংলাকে নিশ্চিহ্ন করার অযুত চেষ্টা হয়েছিল, আজ তা নিয়ে পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের বিপুল আগ্রহ। একুশের ইতিহাস হারাতে বসা মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষায় অনুপ্রাণিত করছে। বাংলা ভাষার মতো ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা সাহিত্যও। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখন সারা দুনিয়ার। বিশ্বকবি হিসেবে স্বীকৃত। প্রতিনিয়ত অনুবাদ হচ্ছে কবিগুরুর রচনা। দূর-দূরান্তের দেশে নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। তেমনি বাংলা ও বাঙালির মহান নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। জ্যোতি ছড়াচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও আগে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিব। বিস্মৃত সে ইতিহাসও সামনে আসছে এখন। পাওয়া যাচ্ছে দুর্লভ দলিল দস্তাবেজ। ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি সারা বিশ্বে বাংলারই প্রতিনিধিত্ব করছেন। পৃথিবীর রাজনীতি, জাতিরাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস আলোচনায় অনিবার্য হয়ে আসছে তাঁর নাম। বাংলা ভাষার আলোচনায় তিনি আসছেন। তেমনি তাঁর আলোচনায় আসছে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের নাম।
একটু পেছন থেকে বললে, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। জন্ম নেয় পৃথক দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চলের মানুষ বাঙালী। মাতৃভাষা বাংলা। অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিন্ধী, পশ্তু, বেলুচসহ আরও কয়েকটি ভাষা। এ অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ নেতৃত্ব উর্দুকে গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। অথচ তারও অনেক আগে পূর্ব বাংলায় ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। মায়ের ভাষার প্রতি বাঙালীর অনুভূতি কত তীব্র ছিল তা জানিয়ে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেনÑ যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি…। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই অনুভূতি স্পর্শ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এ অঞ্চলের মানুষকে পেছনে ফেলে রাখার প্রাথমিক ষড়যন্ত্র হিসেবে ভাষার ওপর আঘাত হানে। মায়ের ভাষা বাংলা মুখ থেকে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সব অনুভূতি তুচ্ছ করে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসতে থাকে শীর্ষ মহল থেকে। এমন ষড়যন্ত্রে হতবাক হয়ে পড়ে বাংলার মানুষ। বাঙালীর সে সময়ের মনোজগত তুলে ধরে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছিলেন, ‘মাগো, ওরা বলে/ সবার কথা কেড়ে নেবে।/তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা,/ তাই কি হয়?’
এরপরও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানের উর্দুপ্রেমীরা। গণচেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন নতুন ফর্মুলা দিতে থাকে। এ অবস্থায় আন্দোলন সংগ্রামের পথ বেছে নিতে হয় বাঙালীকে। ১৯৪৮ সাল এবং ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তার প্রমাণ। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৫২ সাল। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। কিন্তু সব ভয় জয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে। বাংলার দাবি চিরতরে স্তব্ধ করতে মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও আবদুস সালাম, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা অনেকে। গীতিকবির ভাষায় : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী/তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি…। মায়ের ভাষার জন্য বিরল রক্ত¯্রােত। রাজপথ ভেসে গিয়েছিল তরুণ তাজা খুনে। ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসেন। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয় প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ। তবে কাজ হয় না কোন। বাঙালীর ভাষার আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
ভাষার অধিকারের পক্ষে লড়ার পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক প্রভূত্ব ও শাসন শোষণের বিরুদ্ধে একুশ ছিল বাঙালীর প্রথম প্রতিরোধ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার যে স্ফূরণ ঘটেছিল তা-ই পরবর্তীতে বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রেরণা জোগায়। কোথায় বরকত কোথায় সালাম/ সারা বাংলা কাঁদিয়া মরে/যে রক্তের বানে ইতিহাস হলো লাল/যে মৃত্যুর গানে জীবন জাগে বিশাল/সে জাগে ঘরে ঘরে…। বাংলার প্রতি ঘরে বোনা হয়েছিল একুশের রক্তবীজ। বায়ান্নর সে বীজ থেকে আজকের বাংলাদেশ।
আজ মায়ের ভাষার মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার আহ্বানে, একুশের চেতনায় সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথে সারাদেশে পালিত হবে মহান শহীদ দিবস। সমাজের সব অন্যায় অসাম্য ধর্মান্ধতা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করবে বাঙালী। গীতিকবির ভাষায়Ñ স্বাধীন এই বাংলা আমার/কোটি প্রাণ শহীদ মিনার/নেবই নেব, নেবই নেব/নেবই নেব আমরা মনের মতো এই দেশ গড়ে…।
একুশের প্রথম প্রহরে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর পরই সর্বস্তরের জনতার ঢল নামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ ফুল দিয়ে ভাষার প্রতি নিজেদের ভালবাসার কথা জানান। নগ্ন পায়ে অংশ নেয় প্রভাত ফেরিতে। আজ শহীদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। একই সঙ্গে সর্বত্র ওড়ানো হবে শোকের কালো পতাকা।
রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, যথাযথ চর্চা সংরক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিশ্বে আজ বহুভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব মাতৃভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে টেকসই ভবিষ্যত অর্জন করতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন ইতিবাচক অবদান রাখবে। দিবসটি উপলক্ষে তিনি বাংলাভাষীসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। সেই সঙ্গে মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদদের অম্লান স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দেয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। বাংলা ভাষাভাষীসহ বিশ্বের সব ভাষা ও সংস্কৃতির জনগণকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অমর একুশে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। সব ভেদাভেদ ভুলে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পবিত্র সংবিধান ও গণতন্ত্র এবং দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
অমর একুশের কর্মসূচী ॥ শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৯ উপলক্ষে সারাদেশেই থাকবে নানা আনুষ্ঠানিকতা। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নির্মিত শহীদ মিনারে ফুল দেবেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও পৃথক কর্মসূচী পালন করা হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাতে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হবে। কালোব্যাজ ধারণ করবেন নেতাকর্মীরা। বিএনপির পক্ষে দলীয় নেতাকর্মীরা সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন বলে জানা গেছে। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হবে। বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করবে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। আজ ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চে একুশের বিশেষ আয়োজন নিয়ে থাকবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এভাবে নানা আয়োজনে সারাদেশেই স্মরণ করা হবে ভাষা শহীদদের। জানানো হবে বিনম্র শ্রদ্ধা।