কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়ার পর এবার ১১ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধে মিলল মাত্রাতিরিক্ত সীসার অস্তিত্ব। সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই অনুমোদিত এসব কোম্পানির দুধে সীসা পাওয়ার তথ্য জানিয়েছে আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
দুধে সীসা পাওয়া কোম্পানিগুলো হলো- মিল্কভিটা, আড়ং, প্রাণ মিল্ক, ডেইরি ফ্রেশ, ইগলু, ফার্ম ফ্রেশ, আফতাব মিল্ক, আল্ট্রা মিল্ক, আইরান, পিউরা ও সেইফ মিল্ক।
কদিন আগে এই ১১টিসহ মোট ১৪টি পাস্তুরিত দুধ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বলে জানিয়েছিল বিএসটিআই।
মঙ্গলবার হাইকোর্টে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজারে বিক্রি হওয়া খোলা দুধের নমুনায় ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা রিপোর্ট নিয়ে যখন তুলকালাম অবস্থার মধ্যেই আজ আদালতে প্রতিবেদন দিল নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকার্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম।
আদালত প্রতিবেদনে যেসব ব্র্যান্ডের দুধে ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে বিষয়ে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়।
এ সময় বিএসটিআইয়ের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার সরকার এম আর হাসান (মামুন)। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বিসিএসআইআর, প্লাজমা প্লাস, ওয়াফেন রিসার্চ, পারমাণু শক্তি কমিশন ও আইসিডিডিআরবির ল্যাবে পাস্তুরিত দুধ, খোলা দুধ ও গোখাদ্য পরীক্ষা করা হয়েছে বলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদনে জানায়।
শুনানি শেষে আদালত পশু ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া গাভিকে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক না দেওয়ার নির্দেশ দেয় দুগ্ধ খামারিদের।
আদেশের পর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ফরিদ বলেন, বিএসটিআই ২০০২ সালে পাস্তুরিত দুধের যে মান নির্ধারণ করেছিল তার ভিত্তিতেই বাজারে থাকা দুধের নমুনা পরীক্ষা করে এই প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তবে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক বা ডিটারজেন্টের উপস্থিতি সেখানে পরীক্ষা করা হয়নি।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পত্রিকার ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাজারে বিক্রি হওয়া গরুর দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্যে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নানা উপাদান পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গরুর খোলা দুধে অণুজীবের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৪ থাকার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৭.৬৬ পর্যন্ত। এরপর সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী মামুন মাহবুব।
পরে আদালত দুগ্ধজাত খাবারে ভেজাল প্রতিরোধে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি আদালত ঢাকাসহ সারা দেশের বাজারে কোন কোন কোম্পানির দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক এবং সিসা মেশানো রয়েছে, তা নিরূপণ করে একটি প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দেন। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। আজ সেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলো।
আজ আদেশের পাশাপাশি একটি রুলও জারি করেছে আদালত। জনস্বার্থে দুধের দূষণ পরীক্ষা ও গবেষণায় বিএসটিআই নিবন্ধিত দুধ কোম্পানিগুলোকে একটি তহবিল গঠন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। বিএসটিআই এবং দুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত কোম্পানিকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত ২৫ জুন বিএসটিআই আদালতকে জানায়, তাদের অনুমোদিত ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান নেই। ওই ১৪টির তালিকায় ছিল আজকের ১১টি।
একই দিন ঢাকা বিশ^দ্যিালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি বিভাগের গবেষকরা এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয় বাজারে পাস্তুরিত দুধের নমুনা পরীক্ষা করে তারা অন্তত তিন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক পেয়েছেন। বায়োমেডিকেল রিচার্স সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, পরীক্ষায় পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার সবগুলোতেই লেভোফ্লক্সাসিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং ছয়টি টি নমুনায় এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এছাড়া পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধের চারটি নমুনাতে ডিটারজেন্ট এবং অপাস্তুরিত দুধে একটি নমুনাতে ফরমালিন পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
ঢাবির রিপোর্ট প্রকাশের পর এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। দুগ্ধ খামারিরা একে ষড়যন্ত্র হিসেবে দাবি করেন। গত ৯ জুলাই যথাযথভাবে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি দাবি করে এই গবেষকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন।
পরে আবার বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির দুধের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে এবারও অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে। তবে এবার চারটি অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি ধরা পড়ে বলে ১৩ জুলাই জানান ড. ফারুক। এদিন তিনি আরও বলেন, তিনি সরকারি বক্তব্যে বিপন্ন বোধ করছেন। তিনি হুমকি পাচ্ছেন।
অধ্যাপক ফারুকের গবেষণার পক্ষে ইতিমধ্যে দেশের কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুধের দুষণ নিয়ে গবেষণায় তাকে ‘হয়রানির’ প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছে শিক্ষক সমিতি।