কাজিরবাজার ডেস্ক :
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের ঢেউ জাতীয় সংসদেও। নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়ে আসা মহাজোটের সংসদ সদস্যরা মেতেছিলেন বিজয় উৎসবে। রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচিত ২৯৮ সংসদ সদস্যের মধ্যে চার ধাপে বৃহস্পতিবার ২৮৯ শপথ নিয়েছেন। জাতীয় সংসদ ভবনের শপথ কক্ষে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তাদের চার দফায় শপথবাক্য পাঠ করান। এ সময় নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করেন। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অনুষ্ঠিত শপথ অনুষ্ঠান ঘিরে সংসদ ভবনজুড়ে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ।
জাতীয় সংসদ ভবনে শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা ১১টা। কিন্তু সকাল থেকেই নির্বাচিত এমপিরা একে একে সংসদ ভবনে আসতে থাকেন। নির্ধারিত সময়েই স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সংসদ সদস্য হিসেবে প্রথমে নিজে শপথ গ্রহণ এবং শপথ বইয়ে স্বাক্ষর করেন। স্পীকার শপথবাক্য পাঠ করার পর প্রধানমন্ত্রী হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত সদস্যরাও তাকে অভিনন্দন জানান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংসদের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান।
এর পর স্পীকার দু’ধাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ২৫৫ সংসদ সদস্যকে শপথবাক্য পাঠ করান। এর পর তৃতীয় ধাপে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ৩, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ২, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ২, তরিকত ফেডারেশনের এক, জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) এক এবং স্বতন্ত্র তিন সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণ করেন। চতুর্থ ধাপে বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির ২১ সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণ শেষে সকলেই শপথ বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
সংসদ সচিবালয় জানায়, নির্বাচন কমিশনের গেজেট অনুযায়ী নির্বাচিত ২৯৮ এমপির মধ্যে চার ধাপে ২৮৯ জন শপথ নিয়েছেন। অসুস্থতার কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শপথ নিতে পারেননি। তিনি বুধবার স্পীকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে শপথের জন্য সময় চেয়েছেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের বৃহস্পতিবার বিকেলে শপথ গ্রহণের কথা থাকলেও তিনি পরে স্পীকারের কাছে সময় প্রার্থনা করেছেন। দুই/এক দিনের মধ্যেই তিনি শপথ নেবেন বলে জানিয়েছেন। আর নির্বাচিত হলেও এখন পর্যন্ত শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত সংসদ সদস্য। সংসদ অধিবেশন শুরুর পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে তারা শপথ না নিলে তাদের সংসদ সদস্য পদ শূন্য হয়ে যাবে। এ বিষয়ে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, সৈয়দ আশরাফ শপথের জন্য সময় চেয়েছেন। উনি দেশে ফিরে আসার পর শপথ নিতে চান। এমনিতেই নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথের জন্য ৯০ দিন সময় পাবেন বলে তিনি জানান।
শপথবাক্যে নির্বাচিত এমপিরা আইন মেনে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে থেকে দেশের আইনসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করেছেন। শপথ গ্রহণকালে এমপিরা নিজ নিজ নাম উচ্চারণ করে স্পীকারের সঙ্গে সঙ্গে পড়তে থাকেন- ‘সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, তাহা আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; এবং সংসদ সদস্যরূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দেব না।’
শপথ পাঠ করানোর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। অনুষ্ঠানে এমপিদের প্রথম সারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডান পাশে ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও খন্দকার মোশারফ হোসেন। আর বাঁ পাশে ছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ওবায়দুল কাদের, মোহাম্মদ নাসিম, ড. আব্দুর রাজ্জাক। মাঝে নাজমুল হাসান পাপনের পাশে ছিলেন নতুন দুই সংসদ সদস্যÑমাশরাফি বিন মর্তুজা ও শেখ তন্ময়। শপথ শেষে সংসদের ভিআইপি কাফেটারিয়ায় নতুন এমপিদের জন্য ছিল চা চক্রের আয়োজন। এর পর সংসদ সচিবের দফতরে রক্ষিত সংসদ সদস্যদের রেজিস্টার খাতায় তারা স্বাক্ষর করেন।
এদিকে শপথ অনুষ্ঠান ঘিরে সংসদ ভবন ও আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সকাল থেকেই এলাকায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি লক্ষ্য করা যায়। দর্শনার্থীদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। গণমাধ্যম কর্মীদের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়। আর এই কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও সংসদ ভবনজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। শপথ অনুষ্ঠান সামনে রেখে সংসদ ভবনের অভ্যন্তরসহ আশপাশের এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। বাহারি রঙের ফুলের টব সারি সারি বসিয়ে সংসদ ভবন নতুনরূপে সাজানো হয়। শপথ গ্রহণের পর সংসদ সচিবের কার্যালয়ে সংসদ সদস্যরা এসে নির্ধারিত রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর করেন এবং তৃতীয় তলায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নবনির্বাচিত একে একে পরিচয়পত্রের জন্য ছবি তোলেন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই নতুন এমপিদের হাতে তাদের পরিচয়পত্র তুলে দেয়া হয়। সংসদ সদস্যদের ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পূরণের জন্য দেয়া হবে। সংসদ সদস্যদের মাঝে সংবিধানের কপি বিতরণ করা হয়। আর সকাল থেকেই সংসদ ভবনে প্রবেশ করে পুরনো এমপিরা যেমন সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় ও কোলাকুলিতে মেতে ওঠেন তেমনি এবারও প্রথম নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সবার সঙ্গে বিজয় উৎসবে শামিল হন।