জন্ম নিয়ন্ত্রণে ইসলামী দৃষ্টিকোণ

68

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

জন্ম নিয়ন্ত্রণ (ইরৎঃয পড়হঃৎড়ষ) আন্দোলন আঠারো শতকের শেষাংশে ইউরোপে সূচনা হয়। সম্ভবত: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসই (গধষঃযঁং) এর ভিত্তি রচনা করেন। এ আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য হল বংশ বৃদ্ধি প্রতিরোধ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার দেখে মি. ম্যালথাস হিসাব করেন, পৃথিবীতে আবাদযোগ্য জমি ও অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান সীমিত। কিন্তু বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমাহীন। ১৭৯৮ সালে মি. ম্যালথাস রচিত অহ বংংধু ড়হ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ধহফ ধং রঃ বভভবপঃং, ঃযব ভঁঃঁৎব রসঢ়ৎড়াসবহঃ ড়ভ ঃযব ংড়পরবঃু. (জনসংখ্যা ও সমাজের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে এর প্রভাব) নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম তার মতবাদ প্রচার করেন। এরপর ফ্র্যান্সিস প্ল্যাস (ঋৎধহপরং চষধপব) ফরাসী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার প্রতি জোর প্রচারণা চালান। কিন্তু তিনি নৈতিক উপায় বাদ দিয়ে ঔষধ ও যন্ত্রাদির সাহায্যে গর্ভনিরোধ করার প্রস্তাব দেন। আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার চার্লস নোল্টন (ঈযধৎষবং শহড়ষিঃড়হ) ১৮৩৩ সালে এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন সূচক উক্তি করেন। তিনি তার রচিত ঞযব ঋৎঁরঃং ড়ভ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধের চিকিৎসা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং এর উপকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। কিন্তু মাঝখানে ১৮৪০ সাল থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন বন্ধ থাকে। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা এর প্রতি কোনরূপ গুরুত্বারোপ ও সহযোগিতা করতে অস্বীকার জানিয়েছিলেন।
আবার ১৮৭৬ সালে নতুন করে ম্যালথাসীয় আন্দোলন (ঘবি গধষঃযঁংরধহ গড়াসবহঃ) নামক নতুন আন্দোলন শুরু হয়। মিসেস এ্যানী বাসন্ত ও চার্লস ব্রাডার ডাঃ নোল্টনের (ঋৎঁরঃং ড়ভ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু) গ্রন্থটি ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ডাঃ ড্রাইসডেল (উৎুংফধষব)-এর সভাপতিত্বে একটি সমিতি গঠিত হয় ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচার কার্য শুরু হয়ে যায়।
১৮৭৯ সালে মিসেস বাসন্ত-এর রচিত খধি ড়ভ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ (জনসংখ্যার আইন) নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ সালে হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানীতে এ আন্দোলন ছড়িয়ে যায় এবং ক্রমে ইউরোপ ও আমেরিকার সকল সভ্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানে স্থানে জন্মনিরোধ ক্লিনিক (ইরৎঃয ঈড়হঃৎড়ষ ঈষরহরপং) খুলে দেয়। ‘‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৯২), পৃঃ ১৩-১৫।’’
বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে প্রকাশ্যে সন্তান হত্যার হিড়িক পড়ে গেছে। এমনকি দৈনিক পত্রিকাসহ সকল মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচারণা চলছে। যেমন ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট’, দুইটি সন্তানের বেশী নয়, একটি হ’লে ভালো হয়’ ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু স্যাটেলাইট ক্লিনিক গর্ভবর্তী মায়ের সেবার নামে গর্ভপাত ঘটানোর গ্যারেজে পরিণত হয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি : জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি দু’প্রকার : (১) সাময়িক ব্যবস্থা ও (২) স্থায়ী ব্যবস্থা।
(১) সাময়িক ব্যবস্থা :
(ক) আযল তথা ভিতরে বীর্যপাত না করা (ডরঃয ফৎধধিষ)
(খ) নিরাপদ সময় মেনে চলা (ঝধভব ঢ়বৎরড়ফ)।
(গ) কনডম ব্যবহার। (ঘ) ইনজেকশন পুশ। (ঙ) পেশীতে বড়ী ব্যবহার। (চ) মুখে পিল সেবন ইত্যাদি।
(২) স্থায়ী ব্যবস্থা : (ক) পুরুষের অপারেশন। (খ) নারীর অপারেশন।
(ক) পুরুষের অপারেশন : পুরুষের অন্ডকোষে উৎপাদিত শুক্রকীটবাহী নালী (ঠধং ফবভবৎবহং) দু’টি কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে, কিন্তু বীর্যে ক্রমোজম শুক্রকীট না থাকায় সন্তান হয় না। ‘‘ ডা. এস.এন. পান্ডে, গাইনিকলজি শিক্ষা, (কলিকাতা : আদিত্য প্রকাশনী, ১৯৭৭), পৃঃ ১২৪।’’
(২) নারীর অপারেশন : নারীর ডিম্বাশয়ে উৎপাদিত ডিম্ববাহী নালী (ঋধষষড়ঢ়রধহ ঞঁনব) কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পূর্ণ ক্রমোজম ডিম্ব (গধঃঁৎবফ ঙাঁস) আর জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে না। ‘‘ ঐ, পৃঃ ১২৫।’’
নারী অথবা পুরুষে যেকোন একজন স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, অপর জনকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় না। কারণ নারীর ডিম্ব পুরুষের শুক্রকীট দ্বারা নিষিক্ত না হ’লে সন্তানের জন্ম হয় না। ‘‘ ঐ, পৃঃ ১৪’’
জন্ম নিয়ন্ত্রণের কুফল : জন্মনিয়ন্ত্রণের বহুবিধ কুফল রয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল-
ব্যভিচারের প্রসার : ব্যভিচার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অবৈধ যৌন সম্ভোগের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (ইসরা ১৭/৩২)। কিন্তু শয়তান মানুষকে দরিদ্রতার ভয় দেখিয়ে অসামাজিক, অনৈতিক কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে। নারী জাতি আল্লাহভীতির পাশাপাশি আরও একটি নৈতিকতা রক্ষা করতে বাধ্য হয়। তাহ’ল অবৈধ সন্তান জন্মের ফলে সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট হবার আশংকা। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়ার ফলে, এ আশংকা থেকে একদম মুক্ত। যারা নৈশক্লাবে নাচ-গান করে, পতিতা বৃত্তি করে, প্রেমের নামে রঙ্গলীলায় মেতে উঠে, তারা অবৈধ সন্তান জন্মানোর আশংকা করে না। তাছাড়া কখনও হিসাব নিকাশে গড়রমিল হয়ে অবৈধ সন্তান যদিও গর্ভে এসে যায়, তবে স্যাটেলাইট ক্লিনিক নামের সন্তান হত্যার গ্যারেজে গিয়ে প্রকাশ্যে গর্ভ নষ্ট করে ফেলে।
ইংল্যান্ডে প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৮৬ জন নারী বিয়ে ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। অবৈধ সন্তান জন্মের সময় এদের শতকরা  ৪০ জন নারীর বয়স ১৮-১৯ বছর, ৩০ জন নারীর বয়স ২০ বছর এবং ২০ জন নারীর বয়স ২১ বছর। এরা তারাই যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরও এ দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়েছিল। ‘‘ ঝবযধিৎু ঙংধিষফ, ঞযব চংুপড়ষড়মু ড়ভ ঝবী (খড়হফড়হ : ১৯৫১), চ. ৫০’’।
সেখানে প্রতি তিন জন নারীর একজন বিয়ের পূর্বে সতীত্ব সম্পদ হারিয়ে বসে। ডাঃ চেসার তার রচিত ‘সতীত্ব কি অতীতের স্মৃতি?’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছেন’। ‘‘ঈযবংবৎ ওং ঈযধংঃরঃু ঙঁঃসড়ফবফ, (খড়হফবহ : ১৯৬০), চ. ৭৫’’
ওহফরধহ ঈড়ঁহপরষ ভড়ৎ গবফরপধষ জবংবধৎপয-এর ডিরেক্টর জেনারেল অবতার সিংহ পেইন্টাল বলেন, ডব ঁংবফ ঃড় ঃযরহশ ড়ঁৎ ড়িসবহ বিৎব পযধংঃব, ইঁঃ ঢ়বড়ঢ়ষব ড়িঁষফ নব যড়ৎৎরভরবফ ধঃ ঃযব ষবাবষ ড়ভ ঢ়ৎড়সরংব পঁষঃু যবৎব.  অর্থাৎ আমাদের নারীদেরকে আমরা সতী বলে মনে করতাম। কিন্তু অবৈধ যৌনকর্ম এখানে এতবেশী বৃদ্ধি পেয়েছে যে, লোকে এতে ভীত না হয়ে পারে না। ‘‘নারী ৯৭ পৃঃ; হাফেয মাসঊদ আহমদ; আত-তাহরীক (বিশ্বে বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজে নারী : একটি সমীক্ষা-) (৬ষ্ঠ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা জানুয়ারী ২০০৩), পৃঃ ৪’’
আমেরিকার বিদ্যালয় সমূহে অশ্লীল সাহিত্যের চাহিদা সর্বাপেক্ষা বেশী। যুবক-যুবতীরা এসব অধ্যয়ন করে অশালীন কাজে লিপ্ত হয়। এছাড়া হাইস্কুলের শতকরা ৪৫ জন ছাত্রী স্কুল ত্যাগ করার পূর্বে চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। আর এদের যৌন তৃষ্ণা অনেক বেশী। ‘‘এবড়ৎমব খরহফংবু, জবাড়ষঃ ড়ভ গড়ফবৎহ ণড়ঁঃয চ-৮২-৮৩’’ বৃটেনেও শতকরা ৮৬ জন যুবতী বিয়ের সময় কুমারী থাকে না। ‘‘দৈনিক ইনকিলাব, ৬ই জুন ১৯৯৮ইং’’ প্রাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে তাদের শিক্ষা ব্যয়ের প্রায় অধিকাংশ খন্ডকালীন যৌনকর্মী হিসাবে অর্জন করে থাকে। মঙ্গোলয়েড দেশসমূহে যৌন সম্পর্কীয় বিধি-বিধান অত্যন্ত শিথিল। থাইল্যান্ডের ছাত্রীদের বিপুল যৌনতা লক্ষ্য করা যায়। ‘‘ মাসিক পৃথিবী (প্রশ্চাত্যে যৌন বিকৃতি, জুলাই ২০০১ইং, পৃঃ ৫২-৫৩’’
চীনের ক্যান্টন শহরে কুমারীদের প্রেম বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য বিদ্যালয় খোলা হয়েছে। ‘‘জহুরী খবরের খবর, ১ খন্ড, ১১৬ পৃঃ’’ পশ্চিমা সভ্যতার পূজারীরা সর্বজনীন অবৈধ যৌন সম্পর্কের মহামারীর পথ প্রশস্ত করেছে। মরিয়ম জামিলা, ইসলাম ও আধুনিকতা, ৯৯ পৃঃ’’। চীনে যৌন স্বাধীনতার দাবী সম্বলিত পোষ্টারে যার সাথে খুশী যৌন মিলনে কুণ্ঠিত না হবার আহবান জানানো হয়। ‘‘খবরের খবর, ১ম খন্ড, ১১৬ পৃঃ’’। ইউরোপে যৌন স্বাধীনতার দাবীতে পুরুষের মত নারীরাও নৈতিকতা হারিয়ে উচ্ছৃংখল ও অনাচারী এবং সুযোগ পেলেই হন্যে হয়ে তৃপ্ত করত যৌনক্ষুধা। অশুভ এই প্রবণতার ফলে বৈবাহিক জীবন ও পরিবারের প্রতি চরম অনিহা সৃষ্টি হয়। ‘‘সায়্যেদ কুতুব, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, ৯৮ পুঃ’’। অর্থ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে আমেরিকার ৭৫ লাখ নারী পুরুষ বিবাহ ব্যতীত ‘লিভ টুগেদার’-এ। ‘‘দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ এপ্রিল ২০১১, পৃঃ ৫’’।
প্রাশ্চাত্যের যুবতীরা যাতে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভবতী না হয়ে পড়ে, সেজন্য তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে গর্ভনিরোধের দ্রব্যাদি দেয়া হয় এবং এ সকল দ্রব্য ব্যবহারের বিষয়ে তাদেরকে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়ে থাকে। এমনকি মায়েরা কন্যাদেরকে এই সকল দ্রব্য ব্যবহারের কায়দা-কৌশল শিক্ষা দিয়ে থাকে। গর্ভনিরোধ দ্রব্যাদির ব্যবহার সম্পর্কে স্কুল-কলেজে প্রচারপত্র বের করে এবং বিশেষ কোর্সেরও প্রবর্তন করে। এর অর্থ হ’ল- সকলেই নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছে যে, যুবক-যুবতীরা অবৈধ যৌন সম্ভোগ করবেই। ‘‘নারী, পৃঃ ৮৫; আত-তাহরীক, জানুয়ারী ২০০৩, পৃঃ ৪’’।
প্রাশ্চাত্যে ক্রমবর্ধমান অবৈধ যৌন স্বাধীনতাই সবচাইতে ক্ষতি সাধন করেছে। নারীর দেহকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়ার কোন প্রচেষ্টাই বাকী রাখা হয়নি। অবিবাহিত মহিলাদের গর্ভধারণের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবৈধ সন্তান জন্ম, গর্ভপাত, তালাক, যৌন অপরাধ ও যৌন ব্যাধিই এর প্রমাণ। অপর দিকে অবৈধ যৌন সম্পর্কের ফলে কোন আইন-বিচার ও আইনী শাস্তির বিধান নেই। বরং এটাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিবেচনা করা হয়। ‘‘ ইসলাম ও আধুনিকতা, পৃঃ ২৩’’। সম্প্রতি ভারতেও অবৈধ যৌন সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলমান যুবক-যুবতীর নির্বিঘেœ বিবাহ বন্ধন এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের নামে গর্ভপাত ঘটানোর হিড়িক পড়ে গেছে।
জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব : নারীর ব্যভিচার দিনদিন প্রসার লাভ করে চলেছে। নারী স্বাধীনতার নামে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। এই অবৈধ যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মারাত্মক জটিল সব রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জীবাণু নাশক ঔষধ, পিল, কনডম ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহারের ফলে তৎক্ষণাৎ কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু বেশ কিছু কাল যাবৎ এসব ব্যবহার করার ফলে মধ্যবর্তী বয়সে উপনীত হ’তে না হ’তেই নারী দেহের স্নায়ুতন্ত্রীতে বিশৃংখলা (ঘবৎাড়ঁং রহংঃধনরষরঃু) দেখা দেয়। যেমন-নিস্তেজ অবস্থা, নিরানন্দ, উদাসীনতা, রুক্ষমেজাজ, বিষণœতা, নিদ্রাহীনতা, মস্তিষ্কের দুর্বলতা, হাত-পা অবশ, শরীরে ব্যথা, স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, ক্যান্সার, অনিয়মিত ঋতু, সৌন্দর্য নষ্ট ইত্যাদি। ‘‘ ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬২’’ নারী-পুরুষ অবৈধ যৌন মিলনে সিফিলিস, প্রমেহ, গণরিয়া, এমনকি এইডস-এর মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যে সমস্ত বিবাহিতা নারীর দেহে অস্ত্রপচার করা হয়, তাদের শতকরা ৭৫ জনের মধ্যেই সিফিলিসের জীবাণু পাওয়া যায়। ‘‘ ঐবৎ ংবষভ, উৎ. খড়ৎিু, চ-২০৪’’। সিফিলিস রোগে আক্রান্ত রোগী সুচিকিৎসা গ্রহণ না করলে মারাত্মক সব রোগের সৃষ্টি হয়। এইডস রোগের ভাইরাসের নাম এইচ. আই. ভি (ঐওঠ)। এ ভাইরাস রক্তের শ্বেত কণিকা ধ্বংস করে। এ রোগ ১৯৮১ সালে প্রথম ধরা পড়ে এবং ১৯৮৩ সালে একজন ফরাসী বিজ্ঞানী এইচ. আই. ভি ভাইরাসকে এই রোগের কারণ হিসাবে দায়ী করেন। ‘‘কারেন্ট নিউজ (ডিসেম্বর সংখ্যা ২০০১), পৃঃ ১৯’’। বল্গাহীন ব্যভিচারের ফলে এই রোগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ডাঃ হিরোশী নাকজিমা বলেন, জনসাধারণের মধ্যে এইডস বিস্তার লাভ করলে সমগ্র মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। ‘‘ঞযব ঘবি ঝঃৎধরঃং ঔরসবং, (কঁধষধষধসঢ়ঁৎ, গধষধুংরধ, ২৩ লঁহব ১৯৮৮), চ-৯’’
এছাড়া জন্ম নিরোধ পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে নানা প্রকার রোগ বদঅভ্যাসের প্রসার ঘটেছে। তন্মধ্যে কনডম ব্যবহার বা আযল করার জন্য নারীরা মিলনে পরিতৃপ্ত না হ’তে পেরে অবৈধ মিলনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, স্তনচাকা বা পিন্ড, স্তন ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে স্তনে এ ধরনের ব্যথা ও পিন্ড তৈরী হয় এবং ৭৫% নারী স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে। ‘‘প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১০, পৃঃ ৪’’ বুক ও জরায়ুর কার্সিনোমা হ’তে পারে শর্করা জাতীয় খাদ্য সহ্য হয় না, লিভার দুর্বল হয়, রক্ত জমাট বাঁধতে ব্যহত হয়, বুকের দুধ কমে যায় এবং খধপঃধঃরড়হ কম হয় এবং দেহে ফ্যাট জমা হয়। ‘‘গাইনিকলজি শিক্ষা, পৃঃ ১২৩’’ এছাড়া জরায়ু ক্যান্সার ও স্থানচ্যুতি সহ আরও অনেক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জন্মের হার কমে যাওয়া : আগত ও অনাগত সন্তান হত্যার ব্যাপারে মহান আল্লাহ নিষেধ করেন ‘তোমরা অভাব ও দরিদ্রতার আশংকায় তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না’ (ইসরা ১৭/৩১)। কিন্তু শয়তান আল্লাহর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘আমি অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ দিব। আর তারা তদনুযায়ী সৃষ্টির কাঠামোতে রদবদল করবে’ (নিসা ৪/১১৯)। এই রদবদল শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে বর্তমান যুগের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অন্যতম। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের নামে যারা সন্তান হত্যা বা অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের হত্যা করে চলেছে, তারা সন্তানের জন্মকেই দারিদ্রের কারণ বলে চিহ্নিত করেছে। আর সেজন্যেই ক্রমশঃ জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন নির্লজ্জভাবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জ্যামিতিক হারে হ্রাস পেয়েছে। ভবিষ্যৎ বংশধর উৎপাদন ব্যাহত হ’লে মানব জাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যার ফলশ্রুতিতে মুনাফা অর্জনের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী সক্রিয় হবে। জাহেলী যুগে সন্তানের আধিক্য থেকে বাঁচার জন্য লোকেরা সন্তান প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করত। গর্ভ নিরোধের প্রাচীন ও আধুনিক যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে, সবগুলোই মানব বংশ ধ্বংসের পক্ষে কঠিন বিপদ বিশেষ। ‘‘মাওলানা আব্দুর রহিম, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২’’ জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ইউরোপ তাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ বিবেচনা করেছে। ‘‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১২৮’’ জন্মনিয়ন্ত্রণ জন্মহার হ্রাসের একমাত্র কারণ না হ’লেও অন্যতম প্রধান কারণ একথা নিশ্চিত। ইংল্যান্ডের রেজিষ্ট্রার জেনারেল নিজেই একথা স্বীকার করেছেন যে, জন্মহার হ্রাস পাওয়ার শতকরা ৭০ ভাগ জন্ম নিয়ন্ত্রণের দরুণ ঘটে থাকে। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকাতে বলা হয়েছে, পাশ্চাত্য দেশসমূহের জন্ম হার হ্রাস প্রাপ্তির কারণ গুলোর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম উপকরণাদির প্রভাব অত্যধিক। জন্মনিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবারকে সীমিত করার প্রবণতার কারণেই জন্মহার হ্রাস পাচ্ছে। ‘‘জবঢ়ড়ৎঃ ড়ভ ঃযব জড়ুধষ ঈড়সসরংংরড়হ ড়হ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ (১৯৪৯), চ-৩৪’’
ফ্রান্স সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় ও পদ্ধতিকে পরীক্ষা করেছে। একশত বছর পর সেখানে প্রতিটি জেলায় মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার কমে যেতে থাকে। আর এই জনসংখ্যার হার কমে যাওয়ার ফলে দু’টি বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করে যে, বিশ্বে তার প্রভাব প্রতিপত্তির সমাধি রচিত হয়। ‘‘ ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১১২’’ ফিডম্যান বলেন, সমষ্টিগতভাবে আমেরিকান শতকরা ৭০টি পরিবার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর বৃটেন ও আমেরিকার অবস্থা পর্যবেক্ষণে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পরিবারগুলোর ক্ষুদ্র আকার প্রাপ্তির মূলে রয়েছে জন্মনিরোধের প্রচেষ্টা। ‘‘ঋধসরষু চষধহহরহম ঝঃবৎরষরঃু ধহফ চড়ঢ়ঁষধঃরড়হ এৎড়ঃিয (ঘবুিড়ৎশ : ১৯৫৯), চ-৫’’ যদি ম্যালথাস আজ জীবিত থাকতেন, তাহ’লে এটা নিশ্চয়ই অনুভব করতেন যে, পাশ্চাত্যের লোকেরা জন্ম নিরোধ করার ব্যাপারে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশী দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। পাশ্চাত্যের শিল্প ও নগর সভ্যতার কারণে অন্যান্য জাতিও বিপদের সম্মুখীন।
সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় : জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাতে ক্রমশঃ পারস্পরিক সদ্ভাব ও ভালবাসা হ্রাস এবং অবশেষে ঘৃণা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। তাছাড়া নারীদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যে বৈকল্য দেখা দেয় এবং তার মেজাজ দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠে, ফলে দাম্পত্য জীবনের সকল সুখ-শান্তি বিদায় নেয়। সন্তানই স্বামী-স্ত্রীকে চিরদিন একত্রে সংসার গঠনের ভূমিকা রাখে। এজন্য বলা যায়, সন্তানই পরিবার গঠনের সেতুবন্ধন।
ইউরোপ ও আমেরিকাতে দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং জন্মনিরোধ আন্দোলন প্রসারের সঙ্গে তালাকের সংখ্যাও দিন দিন দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে, সেখানে এখন দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ‘‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৮-৬৯’’
সমস্ত ইউরোপের সামাজিক দৃশ্যপট বদলে যায় শিল্প বিপ্লবের অভিঘাতে। আমূল পরিবর্তন আসে গ্রামীণ জীবনেও, ভেঙ্গে যায় পারিবারিক জীবনের ভিত। নারীরা কল-কারখানায় নির্বিঘেœ কাজ করতে শুরু করে। এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান তরুণ নিহত হ’ল। ফলে বিধবা হ’ল অগণিত নারী। যুদ্ধ বিড়ম্বিতা নারীরা বাধ্য হয়ে পুরুষের শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে কারখানা মালিকের নিকটে শ্রম বিক্রয়ের পাশাপাশি কমনীয় দেহটাও মনোরঞ্জনের জন্য দিতে হ’ল। যৌবনের তাড়নায় ইন্দ্রিয় ক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য তাকে বেছে নিতে হ’ল অবাধ বিচরণের পথ। আর নারীর মনের গভীরে পেটের ক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত হ’ল অতৃপ্ত যৌনতা এবং দামী পোশাক ও প্রসাধনীর প্রতি প্রচন্ড মোহ। ‘‘ ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, পৃঃ ৯৮-১০১’’
জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে চরিত্রের ক্ষতি সাধিত হয়। এ ব্যবস্থা নারী-পুরুষের অবাধ ব্যভিচারের সনদ দিয়ে থাকে। কেননা এতে জারজ সন্তান গর্ভে ধারণ ও দুর্নাম রটনার ভয় থাকে না। এজন্য অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অতি  উৎসাহী হয়ে ওঠে। উৎ. ডবংঃৎ গধৎপশ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ঋঁঃঁৎব ড়ভ গধৎৎরধমব রহ ডবংঃবৎহ ঈরারষধরুধঃরড়হ-এ বলেন, গর্ভনিরোধ বিদ্যা বিয়ের হার বাড়াতে পারে। কিন্তু এর ফলে বিয়ে বন্ধন ছাড়াই যৌন মিলনের পথও অত্যন্ত প্রশস্ত হয়ে যায়। ‘‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৯’’
জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে শিশুরাও তাদের মেধা বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়। যদি অন্য ছোট-বড় ভাই বোন খেলার সাথী হিসাবে থাকে, তবে তাদের সাথে একত্রে থাকা ও মেলামেশা, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি শিক্ষণীয় গুণাবলী তার মাঝেও প্রস্ফুটিত হয়। মনস্তত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, একাকিত্বের ফলে শিশুদের মন-মগজের সুষ্ঠু বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। এমনকি দু’টি শিশুর বয়সের পার্থক্য বেশী হ’লে নিকটস্থ ছোট শিশু না থাকার কারণে বড় শিশুটির মস্তিষ্কে (ঘবঁৎড়ংরংর) অনেক ক্ষেত্রে রোগও সৃষ্টি হয়। ‘‘উধারফ গ খবাু, গধঃবৎহধষ ঙাবৎ চৎড়ঃরপঃরড়হ- (ঘবুিড়ৎশ : ১৯৪৩), চ-৩৫’’
অর্থনৈতিক ক্ষতি : জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে নৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির পাশাপাশি এ সমস্ত উপকরণ ব্যবহারের জন্য জাতীয় রাজস্বে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়। এটাকে এক ধরনের অপচয় বললেও ভুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অপব্যয় কর না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’ (ইসরা ১৭/২৭)। ‘খাও ও পান কর, অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পছন্দ করে না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)।
বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ জনসংখ্যা হ্রাস জনিত যুক্তি দিন দিন অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর কারণ হ’ল- জন্মহার ধারাবাহিকভাবে (ঞড়ঢ়বৎরহম) কমে যাওয়ার ফলে একদিকে পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন হরাস পায়। পক্ষান্তরে বাড়তি জনসংখ্যার কারণে পুঁজি বিনিয়োগ ব্যবস্থা উন্নত হয়। ‘‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৭৩’’ কেনসি হাসান বলেন, জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করলে সমাজের অর্থনৈতিক তৎপরতাও অনেক বেড়ে যায়। সে সময় সম্প্রসারণকারী শক্তিগুলি (ঊীঢ়ধহংরাব) সংকোচনকারী শক্তিগুলির (ঈড়হঃৎধপঃরাব) তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী হয়। তখন অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। আর জনসংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা হ্রাস পায়।
বাংলাদেশ অতি ছোট দেশ। এদেশের সামান্য আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশী। কিন্তু প্রতিবছর এদেশ শ্রমশক্তি বিদেশে রফতানী করে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। এই বিশাল জনসংখ্যা যদি শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়, তাহ’লে এ জনসংখ্যা ক্ষতির কারণ না হয়ে আশীর্বাদের কারণ হবে। যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশের রাজস্ব খাতে বিরাট ভূমিকা রাখছে, নিশ্চয়ই তা বেকারত্ব দূর করতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
অন্যথায় ‘পরিবার পরিকল্পনার’ নামে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে জনশক্তির অপমৃত্যু, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবক্ষয়। এই জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় কনডম, ইনজেকশন, বড়ি ও খাবার পিল ইত্যাদি। সরকারের পক্ষ থেকে যে খাবার পিল বিতরণ করা হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। কিন্তু বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী যে পিল বের করেছে তা উচ্চ মূল্যে (৫০-৮০ টাকা) ক্রয় করে জনগণ ব্যবহার করছে। এতে পুঁজিবাদীরা জনগণের পকেট ফাঁকা করে চলেছে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে।
গ্রামাঞ্চলে একটি শিশুর জন্ম দানের জন্য এত টাকা ব্যয় করতে হয় না, যত টাকা ব্যয় করতে হয় জন্মনিরোধ উপকরণাদি ক্রয়ের জন্য। ‘‘ইৎরঃরংয গবফরপধষ ঔড়ঁৎহধষ, (খড়হফড়হ : ৮ ঔঁষু, ১৯৬১), চ-১২০’’
জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে শ্রমজীবী লোক দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার ফলে পুঁজিবাদীরা উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানী করে মিল-কারখানায় উৎপাদন করছে। এতে দ্রব্যমূল্য দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ফলে পণ্যের ব্যবহারও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদনও কমে আসছে। অতএব জন্মনিয়ন্ত্রণ আমাদের কোন সুফল বয়ে আনেনি বরং অর্থনৈতিক ও নৈতিকতার মহা ক্ষতির কারণ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে এর বিধান : মহান আল্লাহ পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করে আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। কিন্তু মাতা হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টির কোন প্রয়োজন ছিল কি? যদি একটু চিন্তা করি, তবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-এর একাকীত্ব দূর করতে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে হাওয়া (আঃ)-কে শুধু সৃষ্টি করেননি। বরং আরও একটি বিশেষ কারণে তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। তাহ’ল মহান আল্লাহ তাদের ঔরশজাত সন্তান দ্বারা সমগ্র পৃথিবী কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিতে চেয়েছেন। আর সমস্ত মানব তাঁর (আল্লাহর) একত্ব ঘোষণাপূর্বক দাসত্ব করবে। এ হ’ল আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর সৃষ্টির একান্ত উদ্দেশ্য। আমরা সেই অনাগত সন্তানদের নির্বিঘ্নে হত্যা করে চলেছি। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না দারিদ্রের কারণে, আমিই তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই রিযিক দান করব’ (আন‘আম ৬/১৫১)।
আলোচ্য আয়াতে খাবারের অভাবের আশংকায় অনাগত সন্তানকে হত্যা করতে মহান আল্লাহ স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। আবার বললেন, ‘আমি তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই দিব’। ‘আমিই দিব’ এই প্রতিশ্র“তির ব্যাখ্যা হ’ল অনাগত সন্তানদের রিযিকের মালিক আল্লাহ। তাঁর খাদ্য ভান্ডারে খাবারের হিসাব অকল্পনীয়। আবার তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মারাত্মক ভুল’ (ইসরা ১৭/৩১)।
তিনি যথার্থই বলেছেন, অনাগত সন্তান হত্যা করা বিরাট ভুল। ভূপৃষ্ঠে একচতুর্থাংশ স্থল, বাকী সব সাগর, মহাসাগর। কিন্তু বর্তমানে মহাসাগরে হাওয়াইন দ্বীপপুঞ্জের মত ছোট-বড় দ্বীপ জেগে উঠেছে এবং নদী ভরাট হয়ে চর জেগে উঠেছে। এভাবে আমাদের আবাদী জমি ও বাসস্থান বাড়ছে এতে কোন সন্দেহ নেই।     মহান আল্লাহ বলেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন’ (কাহাফ ১৮/৪৬)। আল্লামা আলুসী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ধন-সম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায়। আর সন্তান হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার মাধ্যম। ‘‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৪০’’
জনৈক রুশ লেখক তার ইরড়ষড়মরপধষ ঞৎধমবফু ড়ভ ডড়সধহ গ্রন্থে বলেছেন, নারী জন্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানববংশ রক্ষা করা। ‘‘ ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৫৮’’ যৌন প্রেরণার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য মানববংশ বৃদ্ধির সঙ্গে দেহের প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে তৎপর। নারী দেহের বৃহত্তম অংশ গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মানোর উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট। ‘‘ঞযব চংুপযড়ষড়মু ড়ভ ঝবী, চ-১৭’’ মা হাওয়াসহ পৃথিবীর সমস্ত নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য মানব বংশ রক্ষা ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে পারিবারিক কাঠামোতে সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালন।
আযল-এর বিধান : প্রাচীনকালে আরব সমাজে ‘আযল’ করার যে প্রচলন ছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কোন আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে হাদীছে স্পষ্ট আলোচনা আছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল-
১. জাবির (রাঃ) বলেন, ‘আমরা রাসূলের জীবদ্দশায় ‘আযল’ করতাম অথচ তখনও কুরআন নাযিল হচ্ছিল। ‘‘মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৪’’ অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে ‘আযল’ সম্পর্কে কোন নিষেধবাণী আসেনি। আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)ও তা নিষেধ করেননি।
২. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে বনী মুস্তালিকের যুদ্ধে বের হয়ে গেলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক আরবকে (দাসী) বন্দী করে নিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রমণীদের প্রতি আকর্ষণ জাগে। যৌন ক্ষুধাও তীব্র হয়ে উঠে এবং এ অবস্থায় ‘আযল করাকেই আমরা ভাল মনে করলাম। তখন এ সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকটে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জবাবে বললেন, তোমরা যদি তা কর তাতে তোমাদের ক্ষতি কি? কেননা আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি করবেন, তা তিনি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন এবং তা অবশ্যই সৃষ্টি করবেন। ‘‘মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৬’’
৩. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তুমি কি সৃষ্টি কর? তুমি কি রিযিক দাও? তাকে তার আসল স্থানেই রাখ, সঠিকভাবে তাকে থাকতে দাও। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়ছালা রয়েছে। ‘‘সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৭৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪০৩৮’’
ইবনে সীরীন-এর মতে, এ বাক্যে ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ না থাকলেও এ যে নিষেধের একেবারে কাছাকাছি এতে কোন সন্দেহ নেই। ‘‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩৩’’  হাসান বছরী বলেন, আল্লাহর শপথ, রাসূলের একথায় ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট ভৎর্সনা ও হুমকি রয়েছে। ‘‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩৩’’ ইমাম কুরতুবী বলেছেন, ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উক্ত কথা থেকে নিষেধই বুঝেছিলেন। ফলে এর অর্থ দাঁড়ায় রাসূল (সাঃ) যেন বলেছেন, তোমরা ‘আযল’ কর না, তা না করাই তোমাদের কর্তব্য। ‘‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩৩’’ রাগিব ইসফাহানীর মতে, ‘আযল’ করে শুক্র বিনষ্ট করা এবং তাকে তার আসল স্থানে নিক্ষেপ না করা সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ। ‘‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃ: ৩৩৭’’  মুয়াত্তা গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন যে, ইবনে ওমর (রাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম যাঁরা ‘আযল’ পছন্দ করতেন না। ‘‘ ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১০১-১০২’’।
‘আযল’ অর্থ হ’ল, পুরুষাঙ্গ স্ত্রী অঙ্গের ভেতর থেকে বের করে নেয়া যেন শুক্র স্ত্রী অঙ্গের ভেতরে স্খলিত হওয়ার পরিবর্তে বাইরে স্খলিত হয়। ‘‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২’’
আইয়ামে জাহেলিয়াতে যেসব কারণে সন্তান হত্যা করা হ’ত, বর্তমান যামানায় জন্মনিয়ন্ত্রণও ঠিক একই কারণে গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সোনালী যুগের ‘আযল’-এর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে যুগে তিনটি কারণে মুসলমানদের মধ্যে ‘আযল’-এর প্রচলন ছিল।
(এক) দাসীর গর্ভে নিজের কোন সন্তান জন্মানো তাঁরা পছন্দ করতেন না, সামাজিক হীনতার কারণে।
(দুই) দাসীর গর্ভে কারো সন্তান জন্মালে উক্ত সন্তানের মাকে হস্তান্তর করা যাবে না, অথচ স্থায়ীভাবে দাসীকে নিজের কাছে রেখে দিতেও তারা প্রস্তুত ছিল না।
(তিন) দুগ্ধপায়ী শিশুর মা পুনরায় গর্ভ ধারণ করার ফলে প্রথম শিশুর স্বাস্থ্যহানীর আশংকা অথবা পুনরায় সন্তান গর্ভে ধারণ করলে মায়ের স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের আশংকা, কিংবা সন্তান প্রসবের কষ্ট সহ্য করার অনুপযুক্ত তা চিকিৎসকের পরামর্শে যথাযোগ্য বিবেচনায় এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
উপরোক্ত তিনটি কারণের মধ্যে প্রথম দু’টি কারণ আধুনিক যুগে বিলুপ্ত হয়েছে। শেষের তিন নম্বর কারণ ব্যতিরেকে সম্পদ সাশ্রয়ের জন্য ও নিজের আমোদ-প্রমোদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করা বৈধ নয়।
পরিশেষে বলব, জন্মনিয়ন্ত্রণ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সমস্যার প্রকৃত সমাধান নয়। বরং জনসংখ্যাকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর ও উৎপাদন বাড়ানো, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপকরণাদির উন্নয়নের মধ্যেই রয়েছে এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থ হচ্ছে না বুঝে পরাজয় বরণ করা। একটি কাপড় কারো শরীরে ঠিকমত ফিট না হ’লে কাপড়টি বড় করার পরিবর্তে মানুষটির শরীর কেটে ছেঁটে ছোট করার মতই জন্মনিরোধ ব্যবস্থা অন্যায় ও অস্বাভাবিক। কেননা বিজ্ঞানের যুগে আমরা মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী তার শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!!

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট।