ফেসবুক : ইতিবৃত্ত ও ব্যবহার

91

॥ আতিকুর রহমান নগরী ॥

প্রথম কথা:দিন যত যাচ্ছে প্রযুক্তিতে উন্নতির ছোঁয়া লাগছে। আমাদের সামাজিক যোগাযোগ আসান করে দিয়েছে প্রযুক্তির নানা আবিষ্কার। জীবনকে টেকসই করতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শির্ক্ষার্থী মার্ক এলিয়ট জুকারবার্গ যোগ করলেন আরেকটি মাত্রা। সবাই এখন ফেসবুকমুখী। সবাই এখন ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ফেসবুক‬ ছেয়ে গেছে ছাত্রদের আপলোড করা বাহারী ছবিতে। ছবি দিয়ে “মি-এন্ড মাই অমুক”। তা দেখতে দেখতে মাথা ঘুরাচ্ছে। ‎দাঁড়িয়ে‬-বসে, হেলেদুলে, শুয়ে কত ঢংয়ের ছবি তুলে দিচ্ছেন তারা ফেসবুকে। শুধু আপলোড করে শতাধিক লাইক হাসিলের চেষ্টা। কেউ কেউ চ্যাট অথবা ইনবক্সে লাইক প্রার্থনাও করে থাকেন। পড়ালেখা‬ ছেড়ে দিয়ে ফেসবুকেই বেশী সময় কাটাতে দেখা যায় অনেককে। ফেসবুকে‬ আমি নিজেকে জড়িয়েছি বছর পাঁচেক আগে। প্রথমদিকে ফেবুপাড়ায় কীভাবে চলবো? কী করবো? কী করা উচিত? প্রতিনিয়ত এ নিয়ে অনেক ঝামেলায় পড়তে হতো। এখন যে সব পারছি, তা নয়। অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীরা রয়েছেন এ ভার্চুয়াল জগতে। তাদের বিরাট একটা অংশ হচ্ছে কচি-কাঁচারা। আমি-আমরা, তারা সহ আমরা সবাই যাতে ফেসবুকে ভালোভাবে, অনুপম আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে অনাদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যেতে পারি এ মনমানসিকতা সামনে রেখে লেখা হয়েছে ‘ফেসবুকঃ ইতিবৃত্ত ও ব্যবহার’ নামে এই প্রবন্ধটি। হুড়-রে…ভঙ্গিমায় তাড়াহুড়ো করা হয়েছে। ভুল নজরে পড়লে ফেসবুকের দরজায় নক করার অনুরোধ রইলো। লেখার জন্য যারা যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তাদেরকে এবং যারা উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিয়ে সাহস যুগিয়েছেন তাদের প্রতি রইলো ফেসবুকিয় শুভেচ্ছা।
ফেসবুকের শুরুর কথা: ফেসবুক একটি আধুনিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। পৃথিবীর সব দেশেই ফেসবুক জনপ্রিয়। ফেসবুকের জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারণ- এর নানা ধরনের অ্যাপ্লিকেশনসÑ যা অন্য কোনো সামাজিক সাইটে একত্রে পাওয়া যায় না। ব্যবহারবিধিও অপেক্ষাকৃত সহজ ও শৈল্পিক। বর্তমানে এটি প্রত্যাহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তারুণ্যের নতুন জানালা এবং স্বাধীন মত প্রকাশের একটি প্রযুক্তি মাধ্যম। একটি সৃজনশীল মুক্তচিন্তা বিকাশের যোগসূত্রও বটে। এ সৃজনশীলতার পাশাপাশি আবার অনেক নোংরামি, অশ্লীলতা, ভাষার বিকৃতি, অপপ্রচার, সময় ও মেধার অপপ্রয়োগসহ বিভিন্ন পোস্ট, স্ট্যাটাস, মন্তব্য, টুইট, অসংলগ্ন আলাপ, বিকৃত ভাষার ব্যবহার; ব্যাংক, অনলাইন মিডিয়ায় আইডি হ্যাকসহ বন্ধুদের দীর্ঘ তালিকা তরুণ-তরুণীদের মূল্যবোধকে সহজেই পরাস্ত করে প্রতারণার সুযোগ গ্রহণ করছে বুঝে না বুঝে অনেক ব্যবহারকারী।
ফেসবুক পৃথিবীর জননন্দিত একটি নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্র“য়ারিতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি রুমে ফেসবুকের কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানকার শির্ক্ষার্থী মার্ক এলিয়ট জুকারবার্গ বন্ধুদের সঙ্গে মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে বসে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য একটি ওয়েবসাইট চালু করেন। তখন বিষয়টি কেবল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই সীমিত ছিল। ইন্টারনেটভিত্তিক এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে, চালু হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকের বেশি ছাত্র-ছাত্রী এর সদস্য হয়। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে আশেপাশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থীরাও সদস্য হতে শুরু করলে সদস্য সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যায়। এরপর শুধুমাত্র আমেরিকায় বসবাসরত ব্যবহারকারীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় সারা বিশ্বের জন্য। এভাবেই ইতি-নেতির ভাবনার ডানায় ফেসবুক দশদিগন্তে উড়াল দিতে সমর্থ হয়েছে।
ফেসবুকের অগ্রযাত্রা ও জয়জয়কার: ফেসবুক ব্যবহার করে না এমন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন নেই বললেই চলে। এমনকি এখন যারা ইন্টারনেট দুনিয়ার নতুন সদস্য হচ্ছেন, তাদের সূচনাই হচ্ছে ফেসবুক রেজিস্ট্রেশনের মধ্য নিয়ে। নচেৎ মাত্র ২০০৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে যাত্রা শুরু করে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরেই এর গ্রাহক সংখ্যা ৫৫ লাখে দাঁড়াত না। ২০০৬ সালে কৌশলগত কারণে ফেসবুকের সঙ্গে মাইক্রোসফট সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে সারাবিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ফলে এক লাফে গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখে। ২০০৭ সালে ভার্চুয়াল গিফট শপ চালুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহক সংখ্যা ২ কোটি এবং মাত্র একবছর পর ২০০৮ সালে ফেসবুকে জনপ্রিয় ‘চ্যাট’ সেবা চালু হয়। এ বছরই ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটিতে। ২০০৯ সালে ফেসবুকে ‘লাইক’ সেবার পাশাপাশি এর গ্রাহক সংখ্যা উন্নীত হয় ১৫ কোটিতে। মাত্র এক বছর পর ২০১০ সালে ব্যবহারকারী দাঁড়ায় ৫০ কোটিতে। আর তাই প্রায় ৭০০ কোটি জনসংখ্যার এই বিশ্বে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ওয়েবসাইট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রতিদিন ৬১ কোটি ৮০ লাখ ব্যবহারকারী দিনে অন্তত একবার ফেসবুকে লগইন করেন। মোবাইল ফোন থেকে প্রতিদিন লগইন করেন ১৫ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারী। বাংলাদেশে ৩০ লাখেরও বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭০টিরও বেশি ভাষায় ফেসবুক ব্যবহার করা হচ্ছে। তার উপর ফেসবুকে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে প্রায় দুই লাখ নতুন ব্যবহারকারী। সম্মিলিতভাবে ব্যবহারকারীরা প্রতিমাসে ফেসবুকে সময় কাটান ৭০ হাজার কোটি মিনিট। এই অবস্থা চলতে থাকলে পৃথিবীর সব মানুষ খুব শিগগিরই হয়তো যুক্ত হয়ে যাবে ফেসবুকের রাজত্বে। মানুষের পরস্পরের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিনিময় করার পাশাপাশি সমাজনীতি, রাজনীতির গন্ডি পেরিয়ে এখন অর্থনীতির চূড়ায় আরোহন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে পৃথিবীর সবচে বড় এই সোস্যাল মিডিয়াটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রকাশ্যেই এক সভায় বলেছিলেন, ফেসবুক আমেরিকার গর্ব। তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণায়ও এর ব্যাপক ব্যবহারে উপকৃত হয়েছেন। এর আগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন টাইম ম্যাগাজিন ২০১০ সালের জন্য বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে নির্বাচন করে জনপ্রিয় নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক এলিয়ট জুকারবার্গকে। ফেসবুকের বিপুল ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষের জীবনে এবং বছরের ঘটনাপ্রবাহে এর প্রভাব বিবেচনা করে জুকারবার্গকে এ খেতাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় টাইম ম্যাগাজিন। (চলবে)