মানবদেহে মোবাইল টাওয়ার বিকীরণের অশুভ প্রভাব

229

আফতাব চৌধুরী

একথা সর্বজনবিদিত যে, বৈজ্ঞানিকদের অপরিসীম গবেষণায় আধুনিক যুগে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রাদির আবিষ্কার আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে সহজসাধ্য,আরামদায়ক ও বিলাসবহুল করে তুলেছে।
বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম হল মোবাইল ফোন যা বাংলাদেশসহ তথা সমগ্র বিশ্বে এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। এই মোবাইল ফোনে অ্যান্টেনা ও টাওয়ারের উপর ভিত্তি করে দেখা ও শোনার একটি শক্তিশালী ইলেকট্রনিক যন্ত্র রয়েছে। এর হ্যান্ডসেটটি ছোট হওয়ার দরুন আমরা পকেটে রাখতে পারি। এর কার্যকারিতা বিভিন্ন প্রকারের-আমরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পৃথিবীর যে-কোনো স্থানের মানুষের সাথে বার্তালাপ, ঘরে বসে ট্রেন বা বিমানের টিকিট ক্রয়, ইন্টারনেট সহযোগে আর্থিক লেনদেন করতে পারি। এছাড়াও মোবাইল ফোনে অন্যান্য জরুরি পরিষেবার সুবিধা থাকায় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কাছে তা এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে নিত্যনৈমিত্তিক জীবনযাত্রায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। একে আমরা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ বলতে পারি।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর সমীক্ষায় জানতে পেরেছি যে, সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তা ( জধ-ফরধঃরড়হ) থেকে নানা ধরনের রোগ ছড়াতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহল আশঙ্কা প্রকাশ করায় আমরা বিরাট ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছি। বিশেষ করে জনবহুল স্থানে বা দেশের গ্রাম ও শহরাঞ্চলের যত্রতত্র মোবাইল টাওয়ার স্থাপন পরিস্থিতিকে অধিক জটিল করে তুলেছে। অবশ্য ইতিমধ্যে টাওয়ার বসানোর উপর কিছু বিধিনিষেধ কেন্দ্রীয় টেলিকম বিভাগে জারি করেছে বলে জানা গেছে।
সমীক্ষায় আরো জানা গিয়েছে যে, বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশে ৭ কোটির অধিক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আছেন এবং কয়েক লক্ষ মোবাইল টাওয়ার বসানো হয়েছে। যা হোক, আমাদের জীবনের নিরাপত্তার প্রতি লক্ষ্য রেখে মোবাইল টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তার অশুভ প্রভাব কীভাবে বিস্তার লাভ করে এবং বিকিরণজনিত সম্ভাব্য ক্ষতির মাত্রা রোধে বৈজ্ঞানিকদের এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শগুলো সুধী পাঠকবৃন্দ ও জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে এই নিবন্ধে জানাতে চেষ্টা করছি।
বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার থেকে বিকিরণের অশুভ প্রভাব মানবজাতির উপর কীভাবে বিস্তার করছে তা নিম্নে পর্যালোচনা করছি- ক) মোবাইল ফোন ও টাওয়ারসমূহ থেকে নির্গত হওয়া বিকিরণকে (জধফরড়ভৎবয়ঁবহপু জধফরধঃরড়হ) দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে- * তাপ উৎপন্নকারী (ঞযবৎসধষ) এবং * তাপ উৎপন্ন না-হয়ে ((ঘড়হ-ঞযবৎ-সধষ) বিস্তার।
তাপ উৎপন্নকারী প্রভাব হ্রস্বমেয়াদি কম্পনে তেজস্ক্রিয়তার দ্বারা উৎপন্ন করে এবং তাপ উৎপন্ন না-হওয়া সত্ত্বেও প্রভাবসমূহ এখন পর্যন্ত আয়ত্তে আন সম্ভব হয়নি যদিও এর অপকারিতা তাপ উৎপন্নকারী প্রভাবের ৩ থেকে ৪ গুণ অধিক বলে বৈজ্ঞানিকরা অনুমান করছেন। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানির টাওয়ারসমূহ থেকে নির্গত হওয়া বিকিরণকে ৮৬৯-৮৯৪ গঐ২ (ঈউগঅ), ৯৩৫-৯৬০ গঐ২ ( এঝগ) এবং ১৪১০-১৪৪০ গঐ২ (এঝগ-১৮০০) ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে, ৩-জি নেটওয়ার্কের জন্য মোবাইল ফোনের টাওয়ারসমূহ ২১১০-২১৭০ গঐ২ তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণ করছে। নির্গত হওয়া এই বিকিরণকে শক্তির ঘনত্ব ( চড়বিৎ ফবহংরঃু) অনুসারে অপকারী, কম অপকারী হিসাবে ভাগ করা হয়েছে এবং সেই অনুসারে ৪৫০ মিলিওয়াট মিটার শক্তির ঘনত্বের মাত্রা হিসাবে বাংলাদেশে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশে এই বিকিরণ ১০০০ (এক হাজার) মিলিওয়াট প্রতি বর্গমিটার পর্যন্ত  নির্গত করে যাচ্ছে অর্থাৎ নির্ধারিত মাত্রা থেকে বহুগুণ অতিরিক্ত বিকিরণ বিভিন্ন টাওয়ার কোম্পানিগুলো নির্গত করছে যা মানবজাতির জন্য সুরক্ষিত নয়।
এ-বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মোবাইল টাওয়ার থেকে নির্গত বিকিরণ মানবজাতির স্বাস্থ্যের খুবই ক্ষতি করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভীতি প্রদর্শন যুদ্ধে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সময় হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার তথা বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণের মাত্রা কমানোর  অনুরোধ করা হচ্ছে।
মোবাইল টাওয়ার থেকে কী ধরনের রোগ ছড়াতে পারে তা নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করছি। মনুষ্য বসবাসকারী স্থানের ১০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে মোবাইল টাওয়ার বসানোর ফলস্বরূপ মানবদেহে বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তা ছাড়া, এইসব টাওয়ারের জেনারেটর দিন-রাত চালু থাকার ফলে ভয়াবহ শব্দ হওয়ায় পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত এবং ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনার অত্যন্ত ক্ষতি হয়। খ) মানবদেহে ৭০ শতাংশ পানি থাকায় অতি সহজে টাওয়ার থেকে নির্গত হওয়া বিকিরণ শোষণ করার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ বিকিরণ মানবদেহে উত্তাপ উৎপন্ন করার ফলে চোখ, মস্তিষ্ক, হৃৎপিন্ড, পেট ইত্যাদি শুকিয়ে দিতে পারে। এমনকি মস্তিকে ৯০ শতাংশ পানি থাকার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং গর্ভবতী মহিলারও চরম ক্ষতির ভয় থাকে। বর্তমানে দুঃশ্চিন্তার বিষয় যে, এই ধরনের বিকিরণ পুরুষদেরও বন্ধ্যাত্ব সমস্যা বহুলভাবে বৃদ্ধি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মোবাইল টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তায় যে শুধুমাত্র মানবদেহে প্রভাবিত হয় তা নয়, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের উপরও সাংঘাতিকভাবে অশুভ প্রভাব বিস্তার করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছে যে, ‘যেখানে শক্তি শোষণের ঝুঁকি বেশি, সেখানে মোবাইল ফোন ব্যবহারে ছাত্রদের স্মৃতিশক্তি লোপ, দৈনন্দিন পড়াশোনাতে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা প্রচুর। ১২ বছরের নিচের শিশুদের নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া ঠিক না। অন্যথায় মস্তিষ্কের যথেষ্ট ক্ষতি হতে পারে।’ এই ব্যাপারকে আমরা বিজ্ঞানের অভিশাপও বলতে পারি।
সম্প্রতি ‘আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা’ মোবাইল টাওয়ার বা অন্যান্য উৎস থেকে বিকিরণ কমানোর ক্ষেত্রে মানবজাতির নিরাপত্তার জন্য নিম্নলিখিত সতর্কতামূলক নির্দেশাবলি অবলম্বন করতে পরামর্শ দিয়েছে-
১) মস্তিষ্কে বিকিরণ হ্রাস করার ক্ষেত্রে হাতমুক্ত ( ঐধহফংভৎবব) মোবাইল ফোন ব্যবহার করুন। ২) শরীর থেকে দূরে মোবাইল ফোন রাখুন এবং ৩) বহিস্থ ( ঊীঃবৎহধষ) অ্যান্টেনা ছাড়া গাড়িতে মোবাইল ফোন ব্যবহার করবেন না। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণ ( জধফরধঃরড়হ ) থেকে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সেলফোনের পরিবর্তে ল্যান্ডলাইন ফোন ব্যবহার অনেকটাই নিরাপদ।
মোবাইল টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শ থেকে জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলি অনুসরণ করা উচিত এবং এ সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। পরিশেষে, সু-স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে মোবাইল ফোন ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা গ্রহণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সবাইকে বিনম্র অনুরোধ জানাচ্ছি। সাংবাদিক-কলামিস্ট।