জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহ হযরত শাহজালাল (রহ.)

164

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া

সিলেট দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী। গুণীজনের দেয়া এই উপাধির যথার্থতা সর্ব মহলেই স্বীকৃত। ওলীকুল শিরোমণী হযরত শাহজালাল (রহ.) ইসলাম প্রচারের মিশন নিয়ে সুদূর ইয়ামন থেকে সিলেটে আসেন। সেই থেকে সিলেট এই পরিচয়ে পরিচিত। কালের ঘূর্ণনে সময়ের পরিবর্তনে এখানে ইসলাম ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে। সুরমার শ্যামল তটে গড়ে ওঠে ইলমের পতাকাবাহী একাধিক প্রতিষ্ঠান। বিদ্ব্যানপ্রবর বুযুর্গদের প্রচেষ্টায় সিলেট হয়ে ওঠে ইসলামি শিক্ষার তীর্থভূমি। মহান আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হয় এখানে। জন্ম নেন সময়ের সাহসী সন্তানেরা। আধ্যাত্ম্যচিন্তার আলোকোজ্জ্বল পুরুষেরা। সেই আলোক কাফেলার এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের নাম আরিফ বিল্লাহ আকবর আলী (রহ.)।
মাওলানা আকবর আলী (রহ.) শিক্ষাজীবন শেষে প্রবেশ করেন কর্মজীবনে। ১৯৪৭ ঈসায়ীতে তিনি দরগাহ মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হন। আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী (রহ.) ইমামতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নামাযের পর মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে কোরআনের দরস চালু করেন। এ দরসে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুসল্লিদের অন্তরে দ্বীন শেখার ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। মহল্লার ছোট-বড় অনেকেই ইলমে দ্বীন শিক্ষার জন্যে মসজিদে এসে ভিড় জমান। আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকরব আলী (রহ.) মানুষের ঔৎসুক্য দেখে এখানে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার বিষয় নীরবে নিভৃতে ভাবতে থাকেন। ইত্যবসরে তাঁর উস্তাদ মুফতি আজম মুফতি শফি (রহ.) সিলেট সফরে এলে মাওলানা আকবর আলী (রহ.)-কে দরগাহ সংলগ্ন এলাকায় একটি মাদারাসা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়ে বলেন ‘ভাই! এখানে ব্যাপক বরকত অনুভূত হচ্ছে’ ‘তাই এখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করুন’। প্রাণপ্রিয় উস্তাদের পরামর্শে ও নিজের চিন্তার আলোকে ইমাম সাহেব রহ. ২৭ জুমাদাল ঊলা ১৩৮১ হিজরী মোতাবেক ৭ নভেম্বর ১৯৬১ ঈসায়ী সনে হযরত শাহজালাল (রহ.) মসজিদের পাশে একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় “মাদরাসায়ে তা’লিমুল কোরআন”। ১৯৭৪ ঈসায়ী সনে যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বোচ্চস্তর ‘তাকমীল ফিল হাদিস’ খোলা হয়, তখন প্রয়োজন হয় নাম পরিবর্তনের। ১৯৭৫ ঈসায়ীতে ইমাম সাহেবের মুর্শিদ ক্বারি তায়্যিব (রহ.) সিলেটে আগমন করেন। মাদরাসার ব্যাপক উন্নতি অবলোকন করে তিনি হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাম অর্থাৎ- ‘আমি হলাম ইলমের বণ্টনকারী আর মহান আল্লাহ হলেন এর দাতা’-এর আলোকে মাদারাসার নাম ‘ক্বাসিমুল উলূম’ নামকরণের প্রস্তাব করেন, যা পরবর্তীতে ২৮.০৫.১৩৯৫ হিজরী মোতাবেক ১১.০৫.১৯৭৫ ঈসায়ী তারিখে অনুষ্ঠিত মজলিসে আমেলায় গৃহীত হয় এবং মাদরাসার গঠনতন্ত্রে নামটি পুনসংযোজন করা হয়। পরে মাদরাসার ব্যাপকতর উন্নতি সাধিত হলে ‘ক্বাসিমুল উলূম’ নামের সঙ্গে ‘জামেয়া’ শব্দটি সংযোজন করা হয়।
জামেয়ার কিছু বৈশিষ্ট্য :
১। লেখা-পড়ার মান: আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী (রহ.)-এর দর্শন ছিলো, যে প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির চর্চা হয়, সেখানে উচ্চতর লেখা-পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানকে শতভাগ রাজনীতিমুক্ত মাদারাসা হিসেবে গড়ে তোলেন। শতব্যস্ততার ফাঁকেও তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতো লেখাপড়ার দিকে। লেখাপড়ার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতকরণে তাঁর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ছিলো সত্যিই অতুলনীয়। জীবন সায়াহ্নে উপনীত হয়েও তিনি ভুলে যাননি ছাত্রদের তা’লিম-তরবিয়্যতের কথা; মাঝেমধ্যে আকস্মিকভাবেই চলে যেতেন বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে। ছাত্রদের প্রশ্ন করতেন নানা বিষয়ে। লেখা-পড়ার মান উন্নয়নের প্রতি তাঁর আন্তরিক দৃষ্টি আর সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমে জামেয়া একটি উচ্চতর অবস্থানে চলে আসে।
শিক্ষকমণ্ডলীর উন্নত পাঠদান প্রক্রিয়া, নির্ধারিত সিলেবাস নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করণের বাধ্যবাধকতা জামেয়ার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যই জামেয়াকে সামনে এগিয়ে নেয় দ্রুতগতিতে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের সাথে সাথে ছাত্রদের মধ্যে যোগ্যতা তৈরির দিকটিও অর্জিত হয় এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই।
আলহামদু লিল্লাহ! জামেয়ার উন্নতমানের লেখা-পড়ার কারণে প্রতিবছরই ভর্তি পরীক্ষায় ছাত্রদের উপচে পড়া ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু আবাসিক সংকটের দরুন অনেক যোগ্য ছাত্রই ভর্তির সুযোগ পায় না।
২। শিক্ষা বিভাগ ও পাঠ্যসূচী: সাবাহী মক্তব (প্রাইমারী) বিভাগ, হিফজ বিভাগ, সাধারণ বিভাগ ও তাখ্সসুস ফিল ফিক্বহ ওয়াল ইফতা (ইসলামী আইন) বিভাগে শিক্ষাবোর্ডের নির্ধারিত পাঠ্যসূচীর পাশাপাশি জামেয়ার স্বতন্ত্র সিলেবাসে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যুগ চাহিদা পূরণে বাংলা সাহিত্য, ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, পৌরনীতিসহ ফেরাকে বাতেলার খণ্ডনে বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ উপযুক্ত ক্লাসে নেসাবের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সতর্ক তত্ত্বাবধান: শিক্ষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নীতি নৈতিকতা ও মানবিকতার লালন ও বিকাশ সাধন। শিক্ষা গ্রহণের পর ব্যক্তি জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে শিক্ষার কোনো ফলাফল আসে না। তাই জামেয়া তার সন্তানদের শিক্ষার সাথে নৈতিক মূল্যবোধের লালন ও বিকাশে মগ্ন থাকতে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। ইলমের সাথে আমলের সমন্বয় ঘটাতে সর্বোচ্চ সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয় প্রতিটি ছাত্রের ওপর। নিয়মিত স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় উত্তম চরিত্র ও গুণাবলির কথা। আকাবির আসলাফের আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলার তরবিয়াত দেয়া হয় বিভিন্ন উপায়ে।
৪। সাপ্তাহিক আলোচনা সভা: ছাত্রদের মেধা বিকাশের জন্য জামেয়া বহুমুখী কর্মসূচী পালন করে থাকে। বাকশক্তি বিকাশে প্রতি বৃহস্পতিবার চারটি গ্র“পে বক্তৃতাচর্চার অনুষ্ঠান হয়। উস্তাদদের সক্রিয় তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় সাপ্তাহিক বক্তৃতা শিক্ষা কর্মসূচি। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাতৃভাষা বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা। ইসলামের দাওয়াত সর্বশ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এ ভাষায় দক্ষ হওয়া অপরিহার্য। এ-গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রতি সপ্তায় সাহিত্য আসর অনুষ্ঠিত হয়। একজন উস্তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এই আসর। যেখানে লেখালেখির নিয়ম, বানানরীতি সাহিত্য সমালোচনাসহ নানা বিষয়ে অনুশীলন হয়। সেসব আসর একত্র করে ‘শাণিত কলম’ নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। আলহামদু লিল্লাহ! জামেয়ার এমন কর্মসূচি ছাত্রদের মেধা বিকাশে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করছে।
৫। আরিফ বিল্লাহ আকবর আলী পাঠাগার: প্রাজ্ঞ আলেম হওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর পড়া-শুনার। নির্ধারিত পাঠ্য কিতাব-গ্রন্থাদির বাইরে রয়েছে জ্ঞানের অকূল দরিয়া। তাই জামেয়া বিভিন্ন উপায়ে ছাত্রদের কাছরাতে মুতালাআ বা প্রচুর পাঠাভ্যাসে উৎসাহ দিয়ে থাকে। আর এ জন্য জামেয়া ছাত্রদের জন্য “আরিফ বিল্লাহ আকবর আলী (রহ.) পাঠাগার” নামে একটি পৃথক পাঠাগারের ব্যবস্থা করেছে। এখানে জামেয়ার ছাত্ররা নির্ধারিত বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থাদি ও পত্র-পত্রিকা পাঠ করে নিজেদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করে থাকে।
৬. কম্পিউটার প্রশিক্ষণ: তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে কম্পিউটার মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেছে। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা ও বাণিজ্য, দাওয়াতের প্রচার-প্রসারসহ অনেক ক্রিয়াকর্মে কম্পিউটারের গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। ইসলামের প্রচার প্রসারে ইন্টারনেট এখন একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তাই জামেয়া ছাত্রদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য ‘কম্পিউটার বিভাগ’ চালু করেছে। এখানে ছাত্ররা নির্ধারিত সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে।
৭। প্রকাশনা: অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে লিখনীর গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম বিরোধী দেশী-বিদেশী নানাচক্র প্রতিনিয়ত আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার চালাচ্ছে। তথ্যসন্ত্রাসের মাধ্যমে মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার অশুভ পাঁয়তারা চলছে অহরহ। ইসলাম ও মিল্লাতের ওপর আরোপিত জঘন্য মিথ্যাচার আর প্রপাগাণ্ডার মোকাবিলার জন্য কলমী আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। ইসলামের সৌন্দর্যগুলো গণমানুষের কাছে তোলে ধরতে বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন পত্র-পত্রিকা বরাবরই ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে থাকে। লেখা-লেখির অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনায় জামেয়া ক্বাসিমুল ঊলূম দীর্ঘদিন থেকে অনিয়মিতভাবে ‘মাসিক আল-ক্বাসিম’ প্রকাশ করে আসছে। এখন থেকে ইনশা আল্লাহ নিয়মিতভাবে মাসিক আল-ক্বাসিম প্রকাশিত হবে।
৮। অডিট ব্যবস্থা:  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত অডিট টিম দ্বারা প্রতি বছর জামেয়ার আয়-ব্যয়ের হিসাব অডিট করানো হয়।
জামেয়ার অবদান :
নীতি-নৈতিকতার বিশাল ঘাটতি আজ আমাদের চারপাশ কলুষিত করছে। বর্তমানের চিত্র উদ্বেগজনক পর্যায়ে অবস্থান করছে। খুন, সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের কবলে পড়ে দেশের শান্তিকামী মানুষ অস্থির সময় পার করছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে আইন শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দেশের এমন পরিস্থিতিতে বরাবরই বার্তা বাহকের ভূমিকায় থাকেন দেশের সম্মানিত আলেম সমাজ। দেশের সংকটময় যে কোনো মুহূর্তে ওলামায়ে কেরামই সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এই আলেম সমাজের কারণেই দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির একটা ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাজমান থাকে। জাতির কাণ্ডারি আলেম তৈরির কারখানা হচ্ছে কওমী মাদরাসা। কওমী মাদরাসা থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত একজন আলেম কখনও ডাকাত, সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি হয় না। কওমী মাদরাসাগুলোতে কখনও অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনা যায় না। এদেশের সিংহভাগ সুনাগরিক তৈরি হয় কওমী মাদরাসা থেকেই।
আপনাদের জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহ হযরত শাহজালাল (রহ.) সুনাগরিক সৃষ্টিতে অসামান্য অবদান রাখছে। এখান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত আলেমগণ দেশ জাতি ও ইসলামের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছেন। জামেয়ার ফাযিলগণ সমাজের বিভিন্ন স্তরে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছেন। এ পর্যন্ত এ জামেয়া থেকে ১৪৩০ জন শিক্ষাসমাপনকারী আলেম ও ৮৬ জন মুফতি ইসলামি আইন ও গবেষণা কোর্স সম্পন্ন করে পেশাগত বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছেন। জামেয়ার বিস্তারিত অবদান এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে বর্ণনা করার সুযোগ নেই। সংক্ষেপে এতটুকু বলতে চাই; জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম এ পর্যন্ত শত শত বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। মুহাদ্দিস, মুফতি, মুফাসসির ও দক্ষ শিক্ষকের সংখ্যা মাশা আল্লাহ সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। দেশের শত শত মাদরাসায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আছেন জামেয়ার সন্তনেরা। শতাধিক আলিম রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। জামেয়ার ফাযিলদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ রচনা সংকলন, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার কাজে নিয়োজিত থেকে সর্ব সাধারণের দোরগোড়ায় ইসলামের বাণী পৌঁছে দিচ্ছেন।
কওমী মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য: আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে তিনটি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। ১. সাধারণ শিক্ষা ২. সরকারি মাদারাসা শিক্ষা ৩. কওমী মাদারাসা শিক্ষা।
কওমী মাদারাসা শিক্ষাব্যবস্থা একটি ঐহিত্যবাহী শিক্ষাধারা। প্রায় দেড় হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত এ শিক্ষাব্যবস্থা যুগে যুগে মানুষকে চিরস্থায়ী কল্যাণের দিকে আহবান করে আসছে। এ শিক্ষাধারা মানুষকে নীতি নৈতিকতার পাঠ শেখায়। দেশ জাতি রাষ্ট্র ও ধর্মের কল্যাণমুখী অগ্রযাত্রাই এর প্রতিপাদ্য বিষয়। কওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি কোরআন-হাদিস এবং পরিপূর্ণ দ্বীনের সার্বিক বিষয়বস্তু এর পাঠ্যসূচী। বৈষয়িক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও এর পাঠ্যক্রমের অর্ন্তভুক্ত থাকে। তাই সংগত কারণেই কওমী মাদারাসা তাদের নিজস্ব ধারায় চলে। স্বকীয়তা স্বাতন্ত্র্য ধারণ করেই শিক্ষা-দীক্ষার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এ মাদরাসাগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে কওমী মাদারাসা শিক্ষায় সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে খোদ কওমী অঙ্গনেই পক্ষে বিপক্ষে মতামত রয়েছে। যুক্তি রয়েছে উভয় পক্ষেরই। এ ব্যাপারে শুরু থেকেই কওমী মাদারাসার নেতৃত্ব থেকে যে বক্তব্যটুকু আসছে, তা হলো সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বীকৃতি। এই দাবিটুকু সরকার কতটুকু আমলে নিচ্ছে? না আদৌ নিচ্ছে না, তা পুরোপুরি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এমন স্বীকৃতি কওমী মাদরাসা নিতে পারে না, যে স্বীকৃতির কারণে কওমী মাদরাসা তার স্বকীয়তা হারাবে। স্বীকৃতি বিষয়ে আরো আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রিয় নবী (সা.) কাউকে কোনো গুরু দায়িত্ব প্রদানের সময় মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দিতেন। এটি তাঁর দায়িত্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিশালতার প্রতি ইঙ্গিত করে। দশম হিজরীতে হুজুর (সা.) হযরত আলী (রা.)-কে তিনশত লোকের নেতা বানিয়ে যুদ্ধাভিযানে ইয়ামন প্রেরণ করেন। রাসূল (সা.) তখন নিজ হাতে হযরত আলী (রা.)-এর মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দেন। অতঃপর গুরুত্বপূর্ণ নসীহত পেশ করে তাঁকে বিদায় জানান। (যারকানী ১০৩, সিরাতে মুস্তফা ১৪৭/৩)
দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ফাযিলদের পাগড়ি পরিয়ে সম্মাননা জানানোর রীতি শুরু থেকেই চলে আসছে। জামেয়া ক্বাসিমুল উলূমের এটা দ্বিতীয় দস্তারবন্দী (সমাবর্তন) সম্মেলন। প্রথম দস্তারবন্দী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৮৯ ঈসায়ী।
আজ যাদের মাথায় পাগড়ি পরিয়ে সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে; তাদেরকে বলবো, এটা শুধু সম্মাননা নয়, বরং এটা হচ্ছে দ্বীনি উলূমের হেফাজতের গুরুদায়িত্ব প্রদানের এক স্মারক। দেশ-জাতি ও ইসলামের সুরক্ষায় পর্বতসম দায়িত্ব সমঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। আপনারা জীবনের সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলবেন। এখলাছ ও তাক্বওয়াকে সঙ্গী বানিয়ে দায়িত্বের সবটুকু আনজাম দিয়ে যাবেন। দ্বীন রক্ষার যে কোনো সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবেন। লাখো জনতার সামনে আকাবিরদের দেয়া এই আমানতটুকু রক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের তাওফীক দান করুন। আমীন!
জামেয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে আপনারা এ মহতী সম্মেলনে যোগদান করেছেন। আমরা সানন্দে পুলকিত হৃদে আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আল্লাহ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন।
জামেয়া ক্বাসিমুল উলূমের আমন্ত্রণে আপনারা ঐতিহাসিক এ সম্মেলনে শুভাগমন করেছেন। সত্যিই আমরা পুলতিক হয়েছি। হৃদ্যিক উষ্ণ অভিনন্দন রইলো আপনাদের প্রতি। আল্লাহ পাক আপনাদের উভয় জগতে সফলতা দান করুন। আমীন!