আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশে পরিবর্তন আসছে। ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে গড়ে ওঠা এই বাহিনী সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশকে আমরা দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হতে দেখেছি।
সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছেন পুলিশ এ রকমই হয়। জনবান্ধব হওয়ার পরিবর্তে পুলিশ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ। বিশেষ করে মানুষ যখন প্রতিবাদী হয়েছে, পুলিশ তখন আন্দোলন দমনের নামে নির্যাতকের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ভিন্ন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশ চলেছে। এখন জন-আকাক্সক্ষা হচ্ছে পুলিশ কোনো অবস্থাতেই আর নিপীড়ক হবে না, হবে জনবান্ধব। মানুষ পুলিশকে প্রকৃত জনসেবকের ভ‚মিকায় দেখতে চায়।
৫ আগস্টের আগে পুলিশ কঠোরভাবে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছে। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ পুলিশকে ঘিরে তীব্রতর হয়েছে। আন্দোলনের শেষ মুহ‚র্তে পূর্ববর্তী সরকারের পশ্চাদপসারণের বিষয়টি যখন নিশ্চিত হয়ে যায়, পুলিশ তখন প্রতিশোধমূলক আক্রমণের শিকার হয়। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ৪৪ জন পুলিশ নিহত হন, আহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এই মৃত্যু যেমন জনরোষের তীব্রতাকে প্রকাশ করছে। তেমনি আতঙ্কের বিষয়টিও সামনে নিয়ে এসেছে। দেশ শান্ত হয়ে এলেও পুলিশ এভাবে ট্রমায় আক্রান্ত হওয়ায় তাদের স্বাভাবিক সেবামূলক কাজগুলো শ্লথ আর দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে পুলিশের মনোবলে।
আশার কথা, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। থানাগুলো সক্রিয় হওয়ায় মানুষ থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছেন, সেবা পাচ্ছেন। মহানগরীর মহাসড়কে ফিরছে শৃঙ্খলা। পুলিশ নতুন কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষক, রাজনীতিবিদদের নিয়ে গঠন করেছে নাগরিক কমিটি বা সিটিজেন ফোরাম। যানজট নিরসনে পরীক্ষামূলকভাবে ডাইভারশনসহ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এতে কোথাও কোথাও কিছুটা জটিলতা তৈরি হলেও সামগ্রিকভাবে পুলিশের উদ্দেশ্য ইতিবাচক। আমরা এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু এটাও মনে করি, এসবই শেষ কথা নয়। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর যে জন-আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে, পুলিশ বাহিনীকে সেই আকাক্সক্ষা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য প্রথমেই পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে।
শুধু সরকার ও জনমানুষের দিক থেকে নয়, পুলিশ বাহিনী কী চায়, সেটা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।
পুলিশের এই চাওয়া-পাওয়া নিয়ে গলিশের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খোলাখুলিভাবে মতপ্রকাশ করেছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক বলেছেন, পুলিশ আর কোনো রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হতে চায় না। আইনের রক্ষক হিসেবে কাজ করবে। সিলেটে প্রায় একই সুরে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ‘পুলিশে রাজনৈতিক কুপ্রভাবটা যেন আর না আসে। কুপ্রভাব থেকে যেন আমরা মুক্ত হতে পারি, এটাই আমরা চাই।’
পুলিশ বাহিনীর এই চাওয়াটা স্পষ্ট। অতীতে যেভাবে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তারা আর সেটা চাইছেন না। আমরাও তাদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করছি। পুলিশকে দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা প্রয়োজন। এমনকি সরকারের জনবিরোধী প্রভাব থেকেও মুক্ত রাখতে হবে। তাদের এ রকম ভাবমূর্তি তৈরি করতে হবে যে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে পুলিশকে এভাবেই জনবান্ধব বাহিনী করে তোলা হয়েছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশেও এখন এর বিকল্প নেই। পুলিশকে নেতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে ইতিবাচক ধারায় নিয়ে আসতে হবে। পুলিশকে হতে হবে নির্দলীয়, সেবাপরায়ণ, দুর্নীতিমুক্ত, জনবান্ধব। পুলিশপ্রধান বলেছেন, এই বাহিনীকে সেভাবেই পুনর্গঠন করা হচ্ছে।
আমরাও এ বিষয়ে আশাবাদী হতে চাই। পুলিশের কর্মকাÐ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ায় জনজীবনে স্বস্তি ফিরছে। জাতীয়ভাবে এই বাহিনীকে আস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।