২৯ লাখ টন চাল গম আমদানি হবে

17

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সচিবদের সঙ্গে সশরীরে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ এক ডজন বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকছে আলোচ্য সূচিতে। এ ছাড়াও বিবিধ প্রশাসনিক বিষয় আলোচনা হতে পারে। এক বছরের বেশি সময় পর আগামী ২৭ নভেম্বর সচিবদের সঙ্গে তিনি বৈঠকে অংশ নেবেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ কয়েকটি কারণে ২০২৩ সালটি সংকটের বছর হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বিগত মন্ত্রিসভা বৈঠকে তাই সবাইকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এ জন্য খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোসহ একগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনাও দেন তিনি। এর আগে যে কোনো মূল্যে খাদ্য আমদানির নির্দেশ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর সরকারি, বেসরকারিভাবে খাদ্যের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল-গম আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে আনা হচ্ছে আরও ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল।
বেসরকারিভাবে আমদানির জন্যও ইতোমধ্যে ১৪ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সব মিলে ২৯ লাখ মেট্রিক টন চাল-গম আমদানির উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। এছাড়াও নতুন উৎস খোঁজা হচ্ছে। সুবিধামতো হলে নতুন উৎস থেকেও আমদানি করা হবে আরও খাদ্যশস্য। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য মজুত সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সশরীরে অংশগ্রহণের সচিব সভায় সম্ভাব্য অন্যান্য আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সুসংহত রাখা, জ্বালানি নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয়তার নিরিখে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সারের জোগান নিশ্চিত করা ও পতিত জমি চাষের আওতায় আনা, সরকারি কাজে আর্থিক বিধি-বিধান অনুসরণ করা, সরকারি সেবা প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি, সুশাসন ও শুদ্ধাচার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ সচিবদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন গত বছরের ১৮ আগস্ট। সে সময় মূলত করোনা বিষয় গুরুত্ব পেলেও খাদ্য পরিস্থিতি, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আলোচনায় অগ্রাধিকার পায়। এ ছাড়া প্রশাসনে কাজের গতি আনা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন সঠিক সময়ে শেষ করার জন্য নির্দেশনা ছিল।
এক বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার নিজেই সশরীরে উপস্থিত থাকছেন আগামী সচিব সভায়। বিশ্ব পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলোতে সরকারের জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে তা তিনি সভায় আভাস দেবেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। তবে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিশ্বমন্দা ও দুর্ভিক্ষের বিষয়ে কথা বলছেন। করোনাপরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সারাবিশ্বকে মন্দায় ফেলে দিতে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে খাদ্য পরিস্থিতি সচিব সভায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা আভাস দেন।
সর্বশেষ গত সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেন। ওই বৈঠকে তিনি খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেন। এ কারণে খাদ্য আমদানিতে উৎসে কর প্রত্যাহার করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিবেচনায় আনতে বলেছেন। খাদ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব অনুষ্ঠানে বেশি করে খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পতিত জমিতে চাষ করার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশনা দিয়ে আসছেন।
দেশে যেন কোনোভাবে খাদ্য সংকট না হয় প্রধানমন্ত্রী সেদিকেও নজর রাখছেন বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। গত মন্ত্রিসভার বৈঠকে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দেশে যেন কোনোভাবে আর্থিক কোনো সংকট সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে নজরদারি রাখতে বলেছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সচিব সভায় অর্থনীতিকে সুসংহত করার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা দিতে পারেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃচ্ছ্রসাধন। রিজার্ভ ঠিক রাখা ও বাজেট সহায়তার জন্য ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৫০ কোটি ডলার ও বিশ্বব্যাংক আপাতত ২৫ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখানে সরকারের জন্য বেশ কিছুটা স্বস্তি এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জ্বালানি নিরাপত্তা ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সচিব সভায় সাশ্রয়ের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। বর্তমান জ্বালানি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট নিয়ে বেশ কিছু যুক্তি দিতে পারেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দিতে পারেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় নির্দেশনা দিয়ে থাকেন একনেক সভায়। এর পরও সচিব সভায় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে পারেন। কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সারের জোগান যেন নিশ্চিত করা হয় সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ইতোপূর্বে নির্দেশনা দিলেও আগামী সচিব সভায় কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে আবারও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন।
সরকারি কাজে কোনো ধরনের শৈথিল্য না দেখানোর জন্য ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিলেও আসন্ন সচিব সভায় এ বিষয়টি গুরুত্ব পেতে যাচ্ছে। পাশাপাশি সরকারি কাজে আর্থিক বিধিবিধান অনুসরণ করার জন্য আবারও আলোচনায় আসছে। এ ছাড়াও সরকারি সেবা প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আরও বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হতে পারে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এর পরও সবকিছু মোকাবিলায় করতে সরকার সিদ্ধহস্ত। তাই সচিব সভায় ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, বন্যাসহ যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির বিষয়ে আলোচনা হবে।
এদিকে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম কখনো অশান্ত আবার কখনো শান্ত। বান্দরবান সীমান্তে সশস্ত্র গ্রুপ দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে মরণনেশা ইয়াবার কারবার। পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি নিয়ে সচিব সভায় আলোচনা হবে। এ ছাড়াও সুশাসন ও শুদ্ধাচার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকছে আলোচ্য সূচিতে। আলোচনা প্রসঙ্গে আরও কিছু বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মধ্যে ছিলো, সর্বাবস্থায় খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কারণ, যতই খাদ্যের আমদানির কথা বলা হোক না কেন, সমস্যাটি থাকবেই। যদিও রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার যেহেতু সংকট হচ্ছে, ফেডারেল রিজার্ভের হার (নীতি সুদ হার) বেড়ে যাওয়ার ফলে যেসব দেশ ঋণ নিয়ে কাজ করে বা যাদের আমদানি বেশি, তাদের দুই দিক থেকেই অসুবিধা হচ্ছে।
এর মধ্যে একটি হলো যখন টাকা দেওয়া হচ্ছে, তখন বেশি দিতে হচ্ছে, আবার যখন নেওয়া হচ্ছে, তখন কম পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য সবাইকে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে এবং এর সম্ভাবনাও আছে। বিদেশে যেন অদক্ষ শ্রমিক না পাঠিয়ে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো হয়। তাতে উচ্চ বেতনে কাজ করা সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের চাহিদা অনুসরণ করে যেন এই সুযোগ বাড়ানো হয়। আর দক্ষতার সনদের ক্ষেত্রে যেন যথাযথ প্রতিষ্ঠানের সনদ দেওয়া হয়।
প্রবাসী আয় (রেমিটেন্স) বাড়ানোর জন্য কিছু কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি পরিপত্র দিয়েছে বা না দিলে দেবে যে এখন আর রেমিটেন্স পাঠাতে আলাদা ফি দিতে হবে না। যে ব্যাংকে পাঠাবে, সেই ব্যাংকই বিষয়টি দেখবে। আরও কিছু ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগের যেসব শর্ত আছে, সেগুলোকে আরেকটু নমনীয় করা যায় কি না, সেটি দেখতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কয়েকবার বসা হয়েছে এবং কাজ চলছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেই (বিডা) কয়েকটি শাখা থাকবে। যেমন লাইসেন্সের জন্য যেন পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনে যেতে না হয়।
এ ছাড়া খাদ্য মজুতের বিষয়টি সব সময় ভালো অবস্থায় রাখার বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ বিষয়ে মন্ত্রপরিষদ সচিব বলেন, বর্তমানে খাদ্যের মজুত পরিস্থিতি খুবই ভালো অবস্থায় আছে। বেসরকারি খাতকে অনেক পরিমাণ খাদ্য আমদানি করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিমাণটি প্রায় ১৭ লাখ মেট্রিক টন। খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে উৎস কর জাতীয় কিছু করের বিষয়ে নমনীয় হওয়ার বিষয়েও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এনবিআর আলাপ-আলোচনা করে অবিলম্বে যেন সন্তোষজনক বিধান চালু করে।