বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ১৫ বছর, ভিন্ন আঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ নির্বাহী বিভাগের

18

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ১১৬(ক) অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটরাও দায়িত্ব পালনে স্বাধীন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে সংবিধানে সম্পূর্ণ স্বাধীন বলা হলেও অধস্তন আদালতের কর্তৃত্ব এখনো অনেকাংশেই আছে নির্বাহী বিভাগের হাতে। সুপ্রিম কোর্ট এখানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে শৃঙ্খলার দায়িত্ব হাইকোর্ট বিভাগের উপর ন্যস্ত করার কথা থাকলেও ১১৬ অনুচ্ছেদে নিয়ন্ত্রণ শৃঙ্খলার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে। এখানে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ দায়িত্ব পালন করলেও সুপ্রিম কোর্ট আছে পরামর্শকের ভূমিকায়।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ নিয়ে মাজদার হোসেন মামলার রায় একটি মাইল ফলক। অর্থনৈতিকসহ নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে বিচার বিভাগকে পৃথক করতে জেলা জজ ও তৎকালীন জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মাজদার হোসেন ১৯৯৪ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে রায় দেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলে ১৯৯৯ সালে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখা হয়। সেখানে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ নিয়ে ১২ দফা নির্দেশনা দেন আপিল বিভাগ। এরপর রাজনৈতিক সরকারগুলো রায় বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে মাজদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের উদ্যোগ নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ওই বছরের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে পৃথক ঘোষণা করা হয়। সেই পৃথকীকরণের ১৫ বছর পূরণ হলো আজ।
দেড় দশক আগেই ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের আলাদা করা হলেও অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা বিধানে সুপ্রিম কোর্ট পরামর্শক হলেও মূল ভুমিকা রাখছে আইন মন্ত্রণালয়। এমনকি উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগেও করা হয়নি কোনো আইন।
নির্বাহী বিভাগের তুলনায় ভাতা, গাড়ি, ঋণ সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার বিচারকরা। তাদের পদোন্নতি হলেও পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত নতুন পদের সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন তারা। পক্ষান্তরে অন্য সার্ভিসের লোকজন পদোন্নতি হওয়ার পর থেকেই সুবিধাপ্রাপ্ত হন। সারাদেশে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন তৈরির কাজ শেষ না হওয়ায় এখনো বিচার কাজে সমস্যা হচ্ছে অনেক আদালতেই। এছাড়া স্পর্শকাতর মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ এবং রায় দিলেও অনেকাংশেই সংশ্লিষ্ট বিচারক পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পান বলে জানান অনেকে। এসব বিষয়ে বিচারকদের অনেকের মান-অভিমান থাকলেও গণমাধ্যমে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
তিনি এ বিষয়ে রিটকারী মাজদার হোসেন বলেন, ১২ দফা নির্দেশনার ৮ নম্বর দফা ছিল সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে হবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। এটা হয়নি। কারণ এখনো বিচারকদের বেতন, বদলি, কর্মস্থল নির্ধারণ, ছুটিসহ সবকিছু নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হলেও নির্বাহী বিভাগই সব নিয়ন্ত্রণ করে, এটাই আসল কথা। পে-কমিশনের সুপারিশ কার্যকর এবং অবকাঠামোসহ অন্যান্য আর্থিক বিষয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার কথা নির্দেশনায় বলা হয়। এটিও দেওয়া হয়নি। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও বুঝায়।
তিনি আরও বলেন, সাংবিধানিকভাবে তিনটি বিভাগের ওপর বিচার বিভাগকে সুপ্রিমেসি দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করার পর কোনটি বিচারিক, কোনটি প্রশাসনিক কাজ তা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন তা মানে না। মোবাইল কোর্টের বিধান হাইকোর্ট বাতিল করে দিলেও আপিল বিভাগে এখনো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাই উচ্চ আদালতের রায়ের পর এখনো কাঙ্খিত ফল অর্জিত হয়নি।
মাজদার হোসেন মামলার রায়ে আপিল বিভাগ যে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার মধ্যে একটিতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিচার প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ উচ্চ আদালতের হাতে অর্পণ করার কথা বলা হয়। তবে দীর্ঘ সময়েও নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ছিল কেবলমাত্র সুপ্রিম কোর্টের হাতে। এখন সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্ট এই দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু আছে। বিরাট অংশ নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়। এজন্য স্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে। পৃথকীকরণ পুরোপুরি হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনলে বিচার বিভাগের পৃথীকরণ সম্পন্ন হবে এবং তা পুনরুদ্ধার হবে।
তিনি আরও বলেন, বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত চার ধরনের ব্যক্তিরা সরকারি কোষাগার থেকে ভাতা ও সুবিধা পেয়ে থাকেন। তারা হলেন–সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, অধস্তন আদালতের বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের আইন কর্মকর্তা এবং অধস্তন আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ও তাদর সহকর্মীরা। এদের মধ্যে কেবল অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগবিধি ও প্রক্রিয়া আছে। আর বাকিদের ক্ষেত্রে কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়া নেই। তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় খেয়াল-খুশিমতো। সবার নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়া থাকতে হবে। এটার অভাব স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করেন এই আইনজ্ঞ।
তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, পৃথকীকরণের ফলে বিচার বিভাগ এখন পূর্ণ স্বাধীনতা পাচ্ছে। বিচারকদের বদলি, পরিবর্তন শৃঙ্খলা- সব কিছুতেই হাইকোর্টের অনুমোদন নিতে হচ্ছে। সরকার কিছু করতে হলে হাইকোর্টের কাছে ফাইল পাঠাতে হয়। হাইকোর্ট অনুমোদন করলেই কেবল কার্যকর হয়। বিচারকরা এখন বেশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে।
পৃথক সচিবালায় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, হয়তো ভবিষ্যতে সচিবালয় হবে। তবে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় এখন সেই কাজটি করছে। বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া খুবই উন্নত। উচ্চমানের লোকজন এখন আসছেন বিচার বিভাগে। এই পরীক্ষা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই। অনেকে বিনা কারণে ফৌজদারি মামলা করেন। এটা বন্ধ করতে হবে। বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে লজিস্টিক সাপোর্টও বাড়াতে হবে। তাহলেই মামলা জট কমবে।