অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করলে আম-ছালা দুটোই যাবে – প্রধানমন্ত্রী

10
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্তে যুক্ত হয়ে ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে উস্কানি দেয়া হচ্ছে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘আজকে বেতন বাড়া, এটা সেটাসহ নানা ধরনের আন্দোলন করতে যায় (পোশাক শ্রমিকরা)। এই রফতানি যদি বন্ধ হয়, তাহলে পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আমও যাবে, ছালাও যাবে। বেতন আর বাড়বে না, তখন চাকরিই চলে যাবে। তখন কী করবে? কেউ অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমি বলব, শেষে এ কূল, ওকূল দুকূলই হারাতে হবে। এটাও সবাইকে মনে রাখতে হবে।
ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি আলোচনা সভায় যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, কারও কথায় কোন অশান্তি সৃষ্টি করলে দেশের ক্ষতি, নিজের ক্ষতি। এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। আমার মনে হয়- শ্রমিকদের এবং শ্রমিক নেতাদের এ কথাটি জানা উচিত। নেতাদের তো কোন সমস্যা নাই। তারা যেখান থেকে উস্কানি পাচ্ছে সেখান থেকে ভাল অঙ্কের টাকা পাবে। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্যে কি হবে? রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে তো এদের ক্ষতি করা হবে। সেটা তো মাথায় রাখতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, যেই নেতারা উস্কানি দিচ্ছে, তারা কাদের প্ররোচনায় উস্কানি দিচ্ছে- সেটাও একটু ভেবে দেখতে হবে। আমি সরাসরি বাস্তব কথাটাই বললাম। তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশে আমরা যেসব পণ্য রফতানি করি এর মধ্যে পোশাক অন্যতম। এই শিল্পের শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। আন্দোলন করছে ঠিক আছে। কিন্তু যেসব দেশ আমাদের গার্মেন্টস পণ্য কিনবে। এখন আমরা ভাল সুবিধা পাচ্ছি, উৎপাদন বাড়ছে, শ্রমিকদের বেতন বন্ধ হয়নি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ছয় দফা দাবি আদায়ে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদ এবং অন্যান্য গণআন্দোলনের শহীদসহ সীতাকু- কন্টেনার ডিপোর অগ্নিকা-ে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। সভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গণভবন থেকে সভা সঞ্চালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এমপি। এ সময় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ঢাকা উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজকে বক্তব্য দেয়ার জন্য আহ্বান জানানো হলেও তারা বক্তব্য না দিয়ে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শোনার আগ্রহের কথা জানান। পরে বক্তব্য শুরু করেন শেখ হাসিনা।
সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগই দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়েছে। আজকে আমরা আন্দোলন, সংগ্রাম, জেল-জুলুম যাই ভোগ করি না কেন, দেশে স্থিতিশীলতা আমরাই আনতে পেরেছি। তারপরেও বারবার প্রচেষ্টা কী? আমাদের সরকারকে উৎখাতই করতে হবে! তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরে এই প্রথম ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই দেশের উন্নতি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, বাংলাদেশে ভর্তুকি দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে। আমরা প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছি। রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে তুলেছিলাম। সেটাই টাকা ভেঙ্গে বিদ্যুত, গ্যাস, কৃষি ও স্বাস্থ্যের জন্য ভর্তুকি এবং সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। এইভাবে কোন দেশ করেনি। বিনামূল্যে কোভিড টিকা ও কোভিড পরীক্ষার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, তারপরেও কেউ যদি গোলমাল করার চেষ্টা করে, তাহলে এই দেশটা একেবারে স্থবির হয়ে যায়, সাধারণ মানুষের কী অবস্থাটা হবে।
দুকূলই হারাতে হতে পারে : করোনাকালীন সময়ে শ্রমিকদের আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যারা তৈরি পোশাক কিনবে তাদের ক্রয় ক্ষমতাই নাই। যাদের কাছে রফতানি করি তাদের ক্রয় ক্ষমতাও সীমিত হয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছে। আমরা আমেরিকা, ইউরোপে পাঠাই। সেসব জায়গায় জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। সেখানে কত মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সবার খাদ্য, পোশাক, ভ্যাকসিন অন্তত আমরা দিয়ে যেতে পারছি। সেখানে যদি কেউ কেউ অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে আমি বলব- শেষে একূল-ওকূল দুকূলই হারাতে হতে পারে। এটাও যেন সবাই মনে রাখে।
তিনি আরও বলেন, কেউ যদি মনে করেন আন্দোলন করে এই কারখানা বন্ধ ওই কারখানা বন্ধ করে দেব। তাহলে কারাখানা বন্ধ হলে কিন্তু চাকরিও চলে যাবে। তখন বেতন বাড়ানো নয়, বেতনহীন হয়ে যাবে। সেটা যদি না বোঝে আমাদের কিছু করার নেই। বেসরকারী খাতে আমরা আর কত দেব? আমরা তো ভর্তুকি দিয়েই যাচ্ছি। সব ধরনের প্রণোদনা দিয়েই যাচ্ছি। এর চেয়ে বেশি দেয়া সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাকালীন তো আমরা কোন কারখানা বন্ধ হতে দেয়নি। চালু রাখার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলাম। আমরা সেখানে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছি, ভর্তুকি দিয়ে গার্মেন্টেসের শ্রমিকরা যাতে বেতন পায় সেই ব্যবস্থা করেছি। আমরা সরাসরি ফোনের মাধ্যমে এই শ্রমিকদের টাকা দিয়েছি। মালিকদের হাতেও দেইনি। এখন তার সুফল পাচ্ছি। কাজ পাচ্ছি, রফতানি বাড়ছে। সেটা মাথায় রেখেই সবাইকে চলতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সবাইকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই যুদ্ধ কিন্তু এত তাড়াতাড়ি থামবে বলে মনে হয় না। কাজেই আমাদের সবাইকে মিতব্যয়ী হতে হবে। কোন খাদ্য যেন নষ্ট না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। প্রত্যেকে যার যার নিজের সঞ্চয় করা, নিজের ব্যবস্থা নিজেকে করতে হবে। সব তো আর সরকার করে দিতে পারবে না। কাজেই নিজেদের করতে হবে। এটা আমাদের নেতা-কর্মীদের বলব এবং সাধারণ জনগণকেও আমি বলব।
তিনি আরও বলেন, জাহাজে যে খাদ্য পরিবহন করি, সেটা ৮০০ ডলার থেকে আড়াই-তিন হাজার ডলার ভাড়া হয়ে গেছে। কাজেই জিনিসের দাম তো বাড়বেই। আমাদের নিজেদের মাটি আছে, আমাদের চেষ্টা করতে হবে যতটা পারি উৎপাদন বাড়াব। আমাদের খাদ্যটা আমরা নিজেরা যেন উৎপাদন করতে পারি। এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি পুনর্বার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
শ্রমিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন বেতন বন্ধ হওয়ার কথা তখন সরকার থেকে প্রণোদনা দিয়ে তাদের বেতন আমার দিয়ে গেছি। আর আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর ১৬শ’ টাকা থেকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন আমরা কত দফা বাড়িয়েছি, সেটাও হিসেবে নিতে হবে। যারা ১৬শ’ টাকা পেত তারা ৮ থেকে ১০ হাজার এবং ওভার টাইম ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যথেষ্ট বেশি পাচ্ছে। জিনিসের দাম বেড়েছে, এটা ঠিক। এটা যে আরও কত বাড়বে তারও ঠিক নেই। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। আমাদের দেশে তাও আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি, আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামীতে আমরা যে বাজেট দিতে যাচ্ছি। সেখানেও আমরা চেষ্টা করছি, আমাদের উন্নয়ন ও সবকিছুর যাতে সমন্বয় থাকে। সেই ব্যবস্থা আমরা নিতে যাচ্ছি।
একটা সিদ্ধান্তে দেশের ভাবমূর্তি আজ উচ্চ আসনে : প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের জন্য সম্পৃক্ত সকলকে ধন্যবাদ জানান। এই কাজে দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন পাওয়ার কথা জানিয়ে তাদেরও ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এ কারণেই নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতু করতে পেরেছি। আমি বলব একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশে^র কাছে অনেক উচ্চ আসনে চলে গেছে। এভাবেই আমরা বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে চলব।
তিনি বলেন, জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, এই স্বাধীনতার সুফল বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। ২০৪১ সালের যে লক্ষ্য স্থির করেছি। ২১০০ সালের জন্য ডেল্টা প্ল্যান দিয়েছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কেমন চলবে আমি সে পরিকল্পনাটাও দিয়ে গেলাম। একটা কাঠামো দিয়ে গেলাম। তারই ভিত্তিতে সময়পোযোগী পরিকল্পনা নেয়া হবে। প্রয়োজনে সংশোধন করা হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা এগিয়ে যাব। এদেশকে কেউ যেন আর পেছনে টানতে না পারে। দেশের জনগণকে সেইভাবে সচেতন থাকার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পরে দেশে স্থিতিশীলতা এসেছে। আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। জেল-জুলুম যা-ই আমরা ভোগ করি কিন্তু বাংলাদেশে একটু স্থিতিশীলতা আমরাই আনতে পেরেছি। তারপরও প্রচেষ্টা বারবার, আমাদের সরকারকে উৎখাতই করতে হবে। ২০০৮-এ নির্বাচনে এসেছিলাম বলে ২০২২ পর্যন্ত আমাদের ধারাবাহিকতা ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ইতিহাসে এই প্রথম একটা দীর্ঘ সময় একটা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আজকে দেশের উন্নতিটা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আজকে করোনায় বিশ্বব্যাপী মন্দা। তার ওপর আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে উন্নত দেশগুলো অর্থনীতিতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে খাদ্য সঙ্কট চলছে। আমরা ভর্তুকি দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়নে তুলেছিলাম। সেই টাকা ভেঙ্গে ভেঙ্গে কিন্তু আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি। কারণ এভাবে কোন দেশ কিন্তু করেনি।
গ্রামের মানুষ এখনও অনেক ভাল আছে জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, তারা যাতে ভাল থাকে সেজন্য আমরা দৃষ্টি দিচ্ছি। এজন্য আমি বলেছি- এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব, পণ্য সঙ্কট। সেখানে আমাদের মাটি আছে মানুষ আছে ফসল ফলাতে হবে। নিজেদের খাবারের ব্যবস্থাটা অন্তত আমরা নিজেরা করব।
ছয় দফার প্রণেতা বঙ্গবন্ধু নিজেই : ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ-বঞ্চনা থেকে বাংলার জনগণকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবনের লক্ষ্যই ছিল বাংলার জনগণকে এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দেয়া। তিনি বলেন, সব সময়ই বঙ্গবন্ধুর আকাক্সক্ষা ছিল বাঙালী জাতিগোষ্ঠীকে একটি মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ছয় দফা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন। ছয় দফার প্রণয়ক বঙ্গবন্ধু নিজেই। তিনি তখন আলফা ইন্স্যুরেন্সে চাকরি করতেন। হানিফ (প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) সাহেব তখন বিএ পাস করেছেন। তাকে নিয়ে আসেন জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু যখন বলতেন তখন হানিফ সাহেব ছয় দফা ড্রাফট করতেন। ছয় দফা সম্পর্কে জানলে শুধু জানতেন হানিফ। কারণ তিনিই এই ছয় দফা বাংলা ও ইংরেজীতে টাইপ করে দিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক ৬ দফার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই অঞ্চলে আসলে জনগণের অধিকার ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পরে কোন শাসনতন্ত্র, সংবিধান দিতে পারেনি। সব সময় বঞ্চনার শিকার হতে হতো। জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যা বেশি। পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল আমাদের থেকে অনেক কম। তারপরও দেখা গেল রাজধানী নিয়ে যাওয়া হলো করাচীতে। সেই মরুভূমি করাচীতে ফুল ফোটানো হলে বাংলাদেশের অর্থ দিয়ে। শোষণ-বঞ্চনা এবং আমাদের ওপর বারবার যে আঘাত, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ হাসিনা বলেন, ঐতিহাসিক ছয় দফার দাবি ছিল দেশের স্বাধীনতার জন্য জনগণকে পুরোপুরি প্রস্তুত করা এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পক্ষে জনগণকে প্রস্তুত করা। প্রকৃতপক্ষে, এটি ছিল ‘ম্যাগনা কার্টা’ যার মাধ্যমে দেশের মানুষ নিজেদের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিল। আর ১৯৭০ এর নির্বাচন ও এই ৬ দফার ভিত্তিতেই হয়। সেখান থেকেই আমরা এক দফায় চলে এসে স্বাধীনতা অর্জন করেছি এবং ৬ দফা কিন্তু মনু মিয়াদের রক্ত দিয়েই রক্তের অক্ষরে লিখে দেয়া হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, এই ৬ দফা মূলত এক দফাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। যেটা জাতির পিতা ইশারায় দেখাতেন এক হাতের পাঞ্জা এবং আর এক হাতের তর্জনি প্রদর্শন করে এবং আবার তর্জনির ওপর জোর দিতেন অর্থাৎ আসলে এক দফা। তিনি বলেন, এই ৬ দফার ভিত্তিতেই ’৭০-এর নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। যেটা পাকিস্তানীরা কোনদিনই আশা করেনি।
জাতির পিতা মে মাসে গ্রেফতারের পর ৬ দফা বাস্তবায়ন এবং জাতির পিতার মুক্তির দাবিতে ৭ জুন আহূত হরতালে তার মা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃত তার কতিপয় ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ৭ জুনের হরতাল সফল করার জন্য আমার মা’ বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের চক্ষু বাঁচিয়ে আমাদের ছাত্রদের সঙ্গে, সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে হরতাল সফল করার জন্য অনেক কাজ করেছেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জাতির পিতার ৬ দফার দাবি উত্থাপনের পর তিনি কারাগারে থাকাকালীনই এর বিরুদ্ধে ৮ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করা হয়। তৎকালীন অনেক বড় বড় নেতৃবৃন্দও ৮ দফার পক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু বঙ্গমাতার কঠোর অবস্থানের কারণেই সেই ৬ দফাকেই সকলে মানতে বাধ্য হন।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সে সময়কার স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেই সময় ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করাটা ছিল কঠিন একটি কাজ। যেখানে বঙ্গমাতা একটি দৃঢ় পদক্ষেপ নেন। আসলে ৮ দফা ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। কেননা ৬ দফার মধ্যেই আমাদের স্বাধীকার এবং স্বাধীনতার বীজ বপিত ছিল। পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জাতির পিতাকে ক্যান্টনমেন্টে আটককালীন তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব বঙ্গমাতা নাকচ করে দেন, যেটাকে জাতির পিতাও সমর্থন করেন।
’৭৫’এর পর দেশে সংঘটিত ১৯-২০টি ক্যুর প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময়ে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা দেশে বিরাজ করে। কত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে, সিপাহী জনতা বিপ্লবের নামে ঘরে ঘরে ঢুকে অফিসার-স্ত্রী পরিজনকেও হত্যা করা হয়েছে। দফায় দফায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পরই বলতে গেলে এদেশে স্থিতিশীলতা ফিরেছে। এ জন্য তার দলের নেতা-কর্মীকে অনেক জেল জুলুম অত্যাচার-নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, জেল-জুলুম সহ্য করে আজকে দেশে স্থিতিশীলতা আমরাই আনতে পেরেছি। তারপরও বার বার প্রচেষ্টা, আমাদের সরকারকে উৎখাতই করতে হবে! তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই প্রথম ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে দেশে টানা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই দেশের উন্নতি হয়েছে। ক্ষমতায় থেকে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সুযোগ দেয়ার জন্য দেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।