২০২৩ সালে জাতীয় শিক্ষা কাঠামোতে আসবে বড় ধরনের পরিবর্তন, বদলে যাবে পরীক্ষা পদ্ধতি

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
২০২৩ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রমে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। নতুন শিক্ষাক্রমে বিদ্যমান পরীক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি বদলে যাবে। শিক্ষাক্রম অনুযায়ী নতুন বই প্রস্তুত করা হবে। বদলে ফেলা হবে পরীক্ষা পদ্ধতিও। বিদ্যমান পরীক্ষা ব্যবস্থার বদলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বেশি রাখা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন বই প্রণয়ন এবং শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের প্রস্তুত করে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হবে। যতœসহকারে শিক্ষক গাইড তৈরি করা হয়েছে। তারা টিচার গাইড অনুসরণ করে পড়াবেন। আসলে অনেক বেশি পড়ানোর চেয়ে শিক্ষকরা অনেক বেশি গাইড করবেন শিক্ষার্থীদের। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে। সেভাবেই বই লেখা হবে।’
গত ৩০ মে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুমোদন দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি)। এর আগে, গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে শিক্ষাক্রম রূপরেখার খসড়াটি নীতিগত অনুমোদন দেন। যদিও এনসিসির অনুমোদনের আগেই খসড়া রূপরেখা অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় দেশের ৭২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক স্তরে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে পাইলটিং কর্মসূচি শুরু হয় গত ২২ ফেব্রুয়ারি। এ বছর পাইলটিং শেষ করে আগামী বছর থেকে সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ে পাঠদান করা শুরু হবে।
দেশের ৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে পাইলটিং শুরু হবে আগামী আগস্টে। পাইলটিং শেষ করে ২০২৩ সাল থেকে প্রথম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। প্রাথমিকের বই ছাপার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে হয়, সে ক্ষেত্রে বই ছাপতে আগে থেকে প্রস্তুতি প্রয়োজন। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই সরবরাহ করা সম্ভাবনা কম। সে কারণেই শুধু প্রথম শ্রেণির পাইলটিং হবে এবং নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এসইডিপি) আওতায় আগামী অক্টোবরে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হবে। শিক্ষাক্রম বিস্তরণ, বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ এবং মূল্যায়ন সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে পাঁচ দিন। এই প্রশিক্ষণে কোর ট্রেইনার এবং মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হবে। পরে মাস্টার ট্রেইনাররা সব শিক্ষকদের ডিসেম্বরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যদিও তার আগেই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষকদের দক্ষ করে তোলার আগেই মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করার সিদ্ধান্ত অনেকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরে আগের শিক্ষাক্রম ছিল উদ্দেশ্যভিত্তিক। আর শিখন পদ্ধতি ছিল কনটেন্ট ও লেকচার বেইজ। আর নতুন কারিকুলাম হচ্ছে যোগ্যতাভিত্তিক। শিখন পদ্ধতি হচ্ছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক।
প্রাথমিকের বিদ্যমান শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক। তবে নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন পদ্ধতি অভিজ্ঞতাভিত্তিক। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিকের শিক্ষাক্রমে শিখন পদ্ধতি নতুন। ফলে শিখন পদ্ধতি সংশোধন করেই অনুমোদন করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষাক্রম। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম সম্পর্কে আগের অভিজ্ঞতা থাকায় প্রাথমিকের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ অপেক্ষাকৃত কম। পক্ষান্তরে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও শিখন পদ্ধতি দুটিই নতুন। ফলে প্রাথমিকের চেয়ে মাধ্যমিকে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বেশি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিব) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই। ভালো কনটেন্ট, ভালো বই, ভালো টিচার গাইড এবং ভালো প্রশিক্ষণ সবগুলোই কঠিন কাজ। এগুলো চ্যালেঞ্জিং। আমাদের দিক থেকে চেষ্টা পুরোটাই আছে। আমরা আশাবাদী। আশা বেগবান হয়েছে পাইলটিং করতে গিয়ে। পাইলটিংয়ের অভিজ্ঞতায় অনেক জায়গায় ত্রুটি ধরা পড়ছে, অনেক জায়গায় পজিটিভ সাড়া পাচ্ছি। মনে করছি, আমরা রাইট ট্র্যাকে আছি। তারপরও এটাই শেষ নয়। এ বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা পাইলটিং করবো। আমাদের আরও অভিজ্ঞতা হবে, আরও ত্রুটি-বিচ্যুতি বের হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আগামী জানুয়ারিতে রিভাইজ করবো। তার পরের বছরও রিভাইজ হবে। চ্যালেঞ্জ থাকবে, তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টাও থাকবে।’
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, প্রাথমিকে যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলামে যে শিখন কার্যক্রম চলছিল তা সঠিক বিস্তরণ হয়নি। সে কারণে শিক্ষাক্রমের পরিকল্পিত কাজগুলো শ্রেণিকক্ষে ও বিদ্যালয়ে অনুশীলন করা হচ্ছিল না। দ্বিতীয়টি সমস্যাটি ছিল যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য ধারাবাহিক মূল্যায়ন থাকা যৌক্তিক কিন্তু সেটি বিগত সময় সঠিকভাবে কার্যকর করা যায়নি। পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমের কাজগুলো শ্রেণিকক্ষে অনুশীলন এবং ধারাবাহিক মূল্যায়ন কার্যকর করা গেলেই প্রাথমিকে সহজভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে। কারণ যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলাম সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষকদের আগে থেকেই ধারণা আছে, শ্রেণিকক্ষে তা অনুশীলন ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন বাস্তবায়ন করতে হবে শুধু।
অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান আরও বলেন, শ্রেণিকক্ষে ও বিদ্যালয়ে পরিকল্পিত কাজগুলো অনুশীলন করানো এবং ধারাবাহিক মূল্যায়নের কৌশলগুলো শিক্ষকদের শেখানো হবে। এ ক্ষেত্রেও শিক্ষকদের মাইন্ডসেট পরিবর্তন প্রয়োজন। ধারাবাহিক মূল্যায়নে জন্য প্রস্তুত করতেও ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে শিক্ষকদের। অভিভাবকরা ফলাফলকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাদের মাইন্ডসেটও পরিবর্তন হতে হবে। শুধু নম্বর নয় যোগ্যতা অর্জন হচ্ছে কিনা সেটি দেখতে হবে। ’
শিক্ষাক্রমে বড় যেসব পরিবর্তন
নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুক্রবার ও শনিবার দুইদিন ছুটি থাকবে। প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পরীক্ষা থাকবে না। অন্যান্য শ্রেণিতেও পরীক্ষানির্ভরতা কমবে। ধারাবাহিক মূল্যায়ন বাড়বে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়া হবে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। বোর্ডের অধীনে নেওয়া হবে হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির দুই পরীক্ষা। এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির ফল চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে। ২০২৩ সাল থেকে শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পড়বে। থাকবে না বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগ বিভাজন।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার ক্ষেত্র হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।