জামিনে মুক্ত ভয়ঙ্কর অপরাধীদের ওপর নজরদারি রাখতে হচ্ছে ‘বিশেষ মনিটরিং সেল’

13

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাদেশের যে সব ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধী জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তাদের বিষয়ে তদারকি, নজরদারি ও তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলার জন্য গঠন করা হচ্ছে ‘বিশেষ মনিটরিং সেল।’ মনিটরিং সেলের প্রধান অফিস হবে রাজধানী ঢাকায়। দেশের ৬৪ জেলায় হবে শাখা অফিস। বিশেষ মনিটরিং সেলের প্রধান হবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব। ডিআইজি পদমর্যাদার থাকবেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের এই উদ্যোগ সফল করার জন্য সব ধরনের সহায়তা করবে আইন মন্ত্রণালয়। খুব শীঘ্রই বিশেষ মনিটরিং সেলের কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
গত এক বছরে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে গেছে শতাধিক ভয়ঙ্কর অপরাধী। জামিন নিয়ে বের হয়ে যাওয়া এই ধরনের অপরাধী কারা কখন কিভাবে বের হয়ে কোথায় আছে তার কোন তথ্য পায় না পুলিশ। যেসব ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধী জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে আছে জঙ্গি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ডাকাত, মাদক কারবারি, চোরাকারবারি ধরনের দুর্র্ধষ অপরাধী। এই জন্য উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্থাগুলো। দুর্র্ধষ অপরাধীদের জামিন পাওয়ার পর কারাগার থেকে বের হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তথ্য ভা-ার করার উদ্দেশ্যে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করা হচ্ছে। বিশেষ মনিটরিং সেল গঠনের পর পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, দুর্ধর্ষ অপরাধীরা কে কখন কিভাবে জামিনে মুক্ত হয়ে কোথায় অবস্থান করছে সেই তথ্য পাচ্ছে না আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। অপরাধীরা কীভাবে জামিন পাচ্ছে সেটাও জানে না তারা। ফলে কে কখন জামিন নিয়ে আত্মগোপন করছে বা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা সংস্থাগুলোর নজরের বাইরেই থাকছে। এতে গুরুতর ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এই ধরনের আশঙ্কা থেকে গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বিশেষ মনিটরিং সেল।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের জামিনে বেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, জামিন নিয়ে আর আদালতে হাজিরা না দেয়ার তথ্য। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের জামিন পাওয়ার বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তারা জামিন প্রক্রিয়ায় থাকা সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে আরও কঠোর হওয়ার তাগিদও দিয়েছেন। বিশেষ মনিটরিং সেলটি গঠন হলে বিশেষ সুবিধায় কোন অপরাধী জামিন পাচ্ছে কি না, জামিন পাওয়ার পর এসব আসামি কী করছে এবং মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে কি নাÑ এসব বিষয় জানতে পারবে এবং তদারকি করার সুযোগ হবে। কতজন তালিকাভুক্ত অপরাধী জামিনে রয়েছে এবং তাদের সর্বশেষ অবস্থা তাও তদারকি করবে বিশেষ এই মনিটরিং সেলটি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠনের বিষয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধীরা জামিন পাচ্ছে কি না তা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মনিটরিংয়ে সরকারী আইনজীবীদের আরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি আইন মন্ত্রণালয়কে যথাযথ পদক্ষেপ নিতেও অনুরোধ করা হয়। ওইসব বৈঠকে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত আসামি, র্দুর্র্ধষ জঙ্গি ও তালিকাভুক্ত অপরাধীদের মধ্যে কতজন জামিনে রয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সেই হিসাব নেই। এমনকি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর কতজন নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে আর কতজন গা-ঢাকা দিয়েছে তাও কেন্দ্রীয়ভাবে আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলো জানতে পারছে না। প্রতিদিন দেশের মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও জেলাগুলোর জজ আদালত থেকে কে কখন জামিন পাচ্ছে, সে হিসাবও নিয়মিত রাখা হচ্ছে না। কারা জামিন পাচ্ছে বা কারা কারাগার থেকে বের হয়ে যাচ্ছে সেই হিসাব থাকা খুবই জরুরী। বিশেষ দুর্বলতার কারণে জামিনের দৈনন্দিন পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সমন্বয় ও নজরদারি না থাকায় একাধিক মামলার আসামি একটি মামলাতেই জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়। তবে এর সংখ্যা আগের চেয়ে কমে এসেছে। পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে আলোচিত মামলাগুলোর কতজন আসামি জামিনে রয়েছে তার পরিসংখ্যান প্রস্তুত করা হচ্ছে। তা ছাড়া তাদের মধ্যে কতজন নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে, কতজন ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলেছে সেই তালিকাও তৈরি হচ্ছে। আসামি গ্রেফতারের পর জামিন পাওয়া ও কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার বিষয়গুলো কঠোর নজরদারিতে রাখার জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আসামি কারাগারে যাওয়ার পর তারা কী করছে তাও মনিটরিং করতে হবে। অপরাধীরা জামিন পেলে তাৎক্ষণিক জানাতে হবে। তা ছাড়া আদালতে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা থাকেন তাদেরও তথ্য জানাতে বলা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিশেষ মনিটরিং সেল সেল গঠন করতে সম্প্রতি কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই মনিটরিং সেলের কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়। কার্যক্রম শুরুর জন্য বিশেষ সেলের প্রধান অফিস থাকবে ঢাকায়। দেশের ৬৪ জেলায় থাকবে শাখা অফিস। এই সেলকে সব ধরনের সহায়তা করার কথা রয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের। বিশেষ মনিটরিং সেলের প্রধান হবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব। আরও থাকবেন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা। তাদের সহায়তা করবেন র‌্যাবসহ কয়েকটি সংস্থার কর্মকর্তারা। মনিটরিং সেলে জেলা পর্যায়ে আদালত পুলিশসহ জেলা পুলিশের কয়েক কর্মকর্তা থাকার বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। এ বিষয়ে চলতি বছর পুলিশ সদর দফতরে হওয়া একাধিক বৈঠকে বলা হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, গত এক বছরে অন্তত শতাধিক দুর্ধর্ষ অপরাধী জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে গেছে। অথচ পুলিশ ওইসব সন্ত্রাসীর জামিনের বিষয়ে কিছু জানে না। অপরাধীরা পুনরায় একই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- চালাচ্ছে। তাদের তালিকা করতে বৈঠক থেকে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্ত, দুর্ধর্ষ জঙ্গি, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, একাধিক মামলার আসামি ও মাদক কারবারি, স্মাগলারসহ গুরুতর ধরনের অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধী জামিনে বের হয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ সরকারবিরোধীদের সঙ্গে মিলে দেশে নানা নাশকতা চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। দুর্ধর্ষ অপরাধীরা কারাগার ছাড়ার আগে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আগাম তথ্য পাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও বিশেষ কারণে তা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। আদালতের সরকারের নিয়োগ করা আইনজীবী থেকে শুরু করে কারাগারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিয়ে ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে পুলিশসহ অন্য সংস্থাগুলো সমালোচনার মধ্যে পড়েছে। যেসব দাগী অপরাধী জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে গেছে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পুরনো পেশায় সক্রিয় আছে বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে। অপরাধীদের জামিনের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও একাধিক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, জামিন নিয়ে অপরাধীরা বের হয়ে যাচ্ছে। অথচ জামিনের বিষয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য থাকছে না। মনিটরিং সেলটির কার্যক্রম শুরু হলে অপরাধীরা জামিন পাওয়ার পর পরই তথ্য চলে আসবে। কোন কোন পথ অনুসরণ করে তারা জামিন পেয়েছে সেই তথ্যও আসবে সেলে। তাছাড়া কারাগার থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে আগাম তথ্য মনিটরিং সেলের কাছে চলে আসবে।