পাকিস্তানে মুখোমুখি ইমরান ও সেনাবাহিনী

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব সর্বজনবিদিত। দেশটিতে আজ পর্যন্ত যত সরকারই এসেছে, তাদের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা। বলা হয়, সেনাবাহিনীকে খুশি না করলে পাকিস্তানে কেউ একদিনও ক্ষমতায় টিকতে পারেন না। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে সরকারপ্রধান হয়েছিলেন। তবে এর পেছনেও সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল বলে মনে করা। কিন্তু এরপর বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে পিটিআই নেতার প্রতি আস্থা কমতে থাকে সেনা কর্মকর্তাদের। যার ফলাফল, মেয়াদ পূরণ হওয়ার দেড় বছর আগেই প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান ইমরান। বাহ্যিকদৃষ্টিতে অনাস্থা ভোটের পরাজয়ে পিটিআই প্রধান ক্ষমতা হারিয়েছেন মনে হলেও এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কের টানাপোড়েনের যোগসূত্র রয়েছে বলে বিশ্বাস বিশ্লেষকদের।
ক্ষমতাচ্যুত ইমরান খানের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অনাস্থা ভোটের সপ্তাহখানেক আগে এআরওয়াই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পিটিআই প্রধান দাবি করেছিলেন, চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে সেনাবাহিনী তাকে তিনটি বিকল্প দেখিয়েছে: প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ, অনাস্থা ভোট অথবা জাতীয় নির্বাচন। এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বলেছি, নির্বাচনই সেরা উপায়। আমি পদত্যাগের কথা চিন্তাও করতে পারি না। আর অনাস্থা ভোটের কথা আসলে আমি শেষপর্যন্ত লড়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী।
একই কথা বলেছেন পিটিআই নেতা ও সাবেক মানবাধিকার মন্ত্রী শিরীন মাজারিও। একাধিক টুইটে তিনি দাবি করেছেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে ইমরান খান সামরিক বাহিনীর কাছে যাননি, সামরিক বাহিনীই তার দিকে এগিয়েছিল। মাজারির বক্তব্য, আমি পরিষ্কার বলছি- প্রধানমন্ত্রী (ইমরান) ‘রাজনৈতিক অচলাবস্থা ভাঙতে’ সাহায্যের জন্য সেনাবাহিনীকে ডাকেননি। সেনাবাহিনী তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পারভেজ খট্টকের মাধ্যমে বৈঠক করতে চেয়েছিল।
তবে ইমরান ও মাজারির এ বক্তব্যের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল বাবর ইফতিখারের কথা মেলে না। গত বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ইমরানকে তিনটি বিকল্প দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে এ সামরিক কর্মকর্তা দাবি করেন, তারা নয়, বরং পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) থেকেই সেনাপ্রধানের কাছে যাওয়া হয়েছিল।
দেশটির আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ইফতিখার বলেন, এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই সেনাপ্রধান ও ডিজি আইএসআই পিএমওতে গিয়েছিলেন এবং সম্ভাব্য তিনটি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
সম্ভাব্য সেই তিন পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, অনাস্থা প্রস্তাব যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবেই অনুষ্ঠিত হবে অথবা প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন অথবা অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হবে ও তারপর পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন দেওয়া হবে।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্রের ভাষ্যমতে, তৃতীয় কৌশলটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল এবং তিনি আমাদের তার পক্ষ থেকে (তৎকালীন) বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলেন। তাই সেনাপ্রধান তখন বিরোধীদের (পিডিএম) কাছে যান এবং তাদের সামনে ওই প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। আলোচনার পরে বিরোধীরা বলেছিল, তারা পূর্বপরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যেতে চায়। সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো রাস্তা দেখানো হয়নি।
ইমরান খানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতবিরোধ শুধু এই বিষয়েই নয়, কথিত ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ নিয়েও দেখা গেছে। পিটিআই নেতা শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন, তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের (যুক্তরাষ্ট্রের) ‘হুমকির চিঠির’ সঙ্গে এর যোগসূত্র রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইমরানবিরোধী দলগুলো এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এ নিয়ে একই কথা বলেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও।
বৃহস্পতিবার দেশটির আইএসপিআর ডিজি বলেছেন, গত মাসে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বৈঠক শেষে দেওয়া বিবৃতিতে ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি ছিল না। বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, সেটা বলতে পারবো না। তবে ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।
অর্থাৎ এ বিষয়েও ইমরান খান ও সেনাবাহিনীর বক্তব্য পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। তাদের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে কোথায় নিয়ে যায়, এখন সেটাই দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী।