জাতীয় কাউন্সিল করার ইচ্ছা নেই বিএনপি হাইকমান্ডের

1

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। এর পর ৬ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রম হয়ে গেলেও জাতীয় কাউন্সিল করার কোন ইচ্ছে নেই দলীয় হাইকমান্ডের। জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই তারা দলের নতুন নির্বাহী কমিটি করতে চান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেশ ক’দফা জাতীয় কাউন্সিল করার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত আর তা করার চেষ্টা করেনি বিএনপি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিএনপির গঠনতন্ত্রেও ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার কথা উল্লেখ রয়েছে। সে হিসেবে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করার কথা। কিন্তু আরপিও এবং দলের গঠনতন্ত্রকে তোয়াক্কা করছে না বিএনপি। যদিও দলের একটি অংশ জাতীয় কাউন্সিল করার জন্য বরাবরই চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। কিন্তু লন্ডন প্রবাসী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা না পাওয়ায় যতবারই কাউন্সিলের চেষ্টা হয়েছে ততবারই এ পথ থেকে পিছিয়ে এসেছেন দলের সিনিয়র নেতারা। সূত্র মতে, তারেক রহমানের নেক নজরে থাকা বিএনপির কিছু নেতা দলের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদ প্রত্যাশী। তারা মনে করছেন, জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি হলে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবেন না। তাই তারা চাচ্ছেন কাউন্সিল ছাড়া কমিটি হলে সে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবেন তারেক রহমান। তাই তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে সহজ হবে। এ ছাড়া নিজেদের পছন্দের আরও কিছু নেতাকে পদ পাইয়ে দেয়া যাবে।
এদিকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগসহ যেসব রাজনৈতিক দল ২০১৬ সালে বিএনপির কাছাকাছি সময়ে জাতীয় কাউন্সিল করেছে সেই সব দল ২০১৯ সালেই পরবর্তী কাউন্সিল করেছে। আবারও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু বিএনপির এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে খোদ বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেই ক্ষোভ বিরাজ করছেন না।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, নানা সমস্যার কারণে আমরা যথাসময়ে দলের জাতীয় কাউন্সিল করতে পারিনি। তবে তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছানোর কাজ চলছে। আশা করছি যথোপযুক্ত সময়ে আমরা জাতীয় কাউন্সিল করতে পারব।
বিএনপি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, অধিকাংশ নেতাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় কাউন্সিল করে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের পক্ষে। তবে বারবার কাউন্সিলের জন্য নির্বাচন কমিশনে সময় চেয়েও হাইকমান্ডের অনীহার কারণে করতে না পারায় এখন কাউন্সিল ছাড়াই নির্বাহী কমিটি গঠনের পক্ষে অবস্থান করছেন দলের কিছু নেতা।
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাইকমান্ড দলের বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিল করতে চাচ্ছেন না। তাই দলের একটি বড় অংশ চাইলেও জাতীয় কাউন্সিল করে নতুন কমিটি করা যাচ্ছে না। তবে এ নিয়ে দলের অনেক সিনিয়র নেতার মধ্যে চাপা ক্ষোভ থাকলেও তা প্রকাশ করছেন না।
এদিকে জাতীয় কাউন্সিল করতে না পারা ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কর্মকৌশল ঠিক করতে গতবছর প্রথম দফায় ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর এবং দ্বিতীয় দফায় ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর দলের নির্বাহী কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি হাইকমান্ড। এর পর ৮ ও ৯ অক্টোবর পেশাজীবীদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। নির্বাহী কমিটির প্রায় ৪শ’ নেতা ও প্রায় ২শ’ জাতীয়তাবাদী পেশাজীবী নেতার সঙ্গে বৈঠককালে দলের পরবর্তী নির্বাহী কমিটি গঠনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়।
বিএনপি হাইকমান্ড জাতীয় কাউন্সিল ছাড়া নতুন নির্বাহী কমিটি করতে চায় বলেই ৬ বছরেরও বেশি সময় আগে জাতীয় কাউন্সিল করলেও নতুন কাউন্সিল করে নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠনে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এতদিন করোনা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন অজুহাতে নির্বাচন কমিশনের কাছে জাতীয় কাউন্সিলের জন্য সময় চেয়ে নিলেও এখন সে সুযোগ অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন কৌশলের সন্ধান করছে বিএনপি।
বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল না হওয়ায় দলের একটি অংশ চরম ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে যারা দলের পরবর্তী নির্বাহী কমিটিতে পদ প্রত্যাশী তারা ক্রমেই সিনিয়র নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা ঘরে-বাইরে চাপের মুখে রয়েছেন। কারণ, বিএনপির পরবর্তী নির্বাহী কমিটিতে স্থান পেতে দুই শতাধিক নেতা অপেক্ষায় রয়েছেন। এ ছাড়াও অপেক্ষায় রয়েছেন সংস্কারপন্থী কিছু বিএনপি নেতা। তাদের দলীয় হাইকমান্ড আগেই পরবর্তী কমিটিতে স্থান দেয়ার আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া যারা ৫৯২ সদস্যের বর্তমান নির্বাহী কমিটির অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন তারাও ভাল ভাল পদে যাওয়ার জন্য নতুন কমিটির অপেক্ষায় রয়েছেন।
৩ বছরেরও বেশি সময় আগে বিএনপির বর্তমান নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে দলের এমন কিছু নেতা কাউন্সিল ছাড়া কমিটি করতে তৎপর রয়েছে। সবকিছু অনুকূলে থাকলে সুবিধাজনক সময়ে জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই নির্বাহী কমিটি গঠনের কাজ শেষ করতে চায় তারেকসহ এসব নেতারা।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দল ঢেলে সাজাতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় কাউন্সিলের দাবি তুললেও এ বিষয়ে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তারেক রহমান রাজি না থাকায় তখন জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি বিএনপি। এর পর আরও কয়েক দফা দলের সিনিয়র নেতারা জাতীয় কাউন্সিলের দাবিতে সোচ্চার হন। তারপরও হাইকমান্ড জাতীয় কাউন্সিলের জন্য সায় দেননি।
সূত্র মতে, নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে আর বেশিদিন সময় দেবে না। তাই জাতীয় কাউন্সিল না করলেও বিএনপিকে নতুন কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি হাইকমান্ডও কাউন্সিল না করেই নির্বাহী কমিটি গঠনের সুযোগ নিতে চান।
জানা যায়, এক সময় বিএনপির অধিকাংশ নেতা জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের পক্ষে অবস্থান করলেও হাইকমান্ডের বিরাগভাজন না হতে এখন কেউ কেউ সে অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেছেন। এ ছাড়া লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও চান দলের বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই নতুন কমিটি গঠনের পক্ষে দলের সব নেতা সমর্থন করুক। শর্ত সাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসায় অবস্থান করলেও দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ নেই। আর তারেক রহমানও আপাতত দেশে ফিরে আসছেন না। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে দলের জাতীয় কাউন্সিল হলে তারেক রহমানের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না বলে দলের একাংশের নেতারা মনে করছেন।