পানির অপচয় বন্ধ করতে হবে – প্রধানমন্ত্রী

5
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর গ্রিন রোডস্থ পানি ভবন প্রান্তে যুক্ত হয়ে বিশ^ পানি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কোন সম্পদই যে অফুরন্ত নয়, আর তা ব্যবস্থাপনায় যে সরকারকে খরচ করতে হয় সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে পানির অপচয় বন্ধ করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্মাণ কাজ, গৃহস্থালি বা গাড়ি ধোয়া সব কাজেই পানি ব্যবহারে সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অপচয় করলে কোন সম্পদই থাকে না শেষ পর্যন্ত। কাজেই আমাদের যে অমূল্য সম্পদটা রয়েছে, এই সম্পদটা আমরা কিভাবে সংরক্ষণ করে ব্যবহার করতে পারি বা ভবিষ্যত বংশধররা ব্যবহার করতে পারে, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশের বিশাল পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পানি সরবরাহ করা সম্ভব মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্পদ যদি আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি, তাহলে আমাদের মানুষের এই কষ্ট কোনদিনই হবে না। বরং আমরা বিশ্বকে পানি সরবরাহ করতে পারব। আমাদের সেই বিষয়টা মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে।
সোমবার বিশ্ব পানি দিবস-২০২২ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বৃষ্টি ও বন্যার পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি জলাধার নির্মাণ এই দুটি বিষয় মনে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। পানি সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের প্রকৃতি ভিত্তিক কৌশল খুঁজে বের করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত নগরীর গ্রীন রোডের পানি ভবনের মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন। অনুষ্ঠানে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এবং উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বক্তব্য রাখেন এবং মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবীর বিন আনোয়ার স্বাগত বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে বিশ্ব পানি দিবসের ওপর একটি অডিও-ভিডিও গান এবং বাংলাদেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি ডকুমেন্টরি প্রদর্শিত হয়। এবারের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার-মেকিং দ্য ইনভিজিবল ভিজিবল।’
বিশুদ্ধ পানির গুরুত্বের প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত এবং বিশুদ্ধ পানি সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার সুপারিশের লক্ষ্যে প্রতিবছর ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনের (ইউএনসিইডি) সুপারিশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ২২ মার্চ ‘ওয়ার্ল্ড ডে ফর ওয়াটার’ ঘোষণা করা হয়, যা ১৯৯৩ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা সকলের কাছে একটা আহ্বান জানাব, এই যে ঢাকা শহরে আমরা পানি দিই বা সেই সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনসহ উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত আমরা পানি পরিশুদ্ধ করে পাইপে সরবরাহ করার ব্যবস্থা নিয়েছি, এগুলো করতে কিন্তু অনেক খরচ হয়। কাজেই পানির অপচয়টা বন্ধ করতে হবে।
ভূগর্ভের পানির স্তর কমে যাওয়ায় শহর এলাকায় বৃষ্টির পানি যাতে মাটি দিয়ে আবার ভূগর্ভে পৌঁছতে পারে, সে দিকে নজর দেয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কথাও বলেন। সরকারপ্রধান বলেন, সব জায়গায় সিমেন্ট করে রেখে দিলাম, আর বৃষ্টির পানি গড়িয়ে চলে গেল, সেটা না। আর বৃষ্টির পানি সবই আন্ডারগ্রাউন্ডে একেবারে নদীতে পড়বে তাও না। আমাদের আশপাশে জলাধারগুলোতে যেন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যেতে পারে, সেই ব্যবস্থাটাও নিতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ভূগর্ভে জলাধার নির্মাণের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সকলকে খাল, বিল, হাওড় ও বাঁওড়ের সঙ্গে নদীর সংযোগবিন্দু সমূহ খুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, তা না হলে নদীর নাব্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি এ সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বরোপ করেন।
প্রধানমন্ত্রী নদী খননের সময় নাব্যতা সৃষ্টির পাশাপাশি অতিরিক্ত পানি কিংবা বন্যার পানি সংরক্ষণে বাফার জোন তৈরির ওপরও গুরুত্বারোপ করে বলেন, এই পানি শীতকালে চাষাবাসে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া বন্যার সঙ্গে কিভাবে বাঁচতে হয়, সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় সে সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ।
প্রধানমন্ত্রী সড়ক কিংবা বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প নেয়ার সময়ে গাছের চারা লাগানোরও নির্দেশ দেন, কারণ এ পদক্ষেপ ভূমিধস থেকে রক্ষায় সহায়ক হবে। তিনি সকলকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোরও নির্দেশ দেন। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। আর বাংলাদেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
সরকারপ্রধান এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, সরকার ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে নদীর পানি বিশুদ্ধ করে জনগণের কাছে নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং সেচকাজে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারসহ নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে। তবে তিনি গৃহস্থালী, নির্মাণ কিংবা সেচসহ সকল কাজে পানি ব্যবহারে কৃচ্ছ্র সাধনের অনুরোধ জানান, কারণ, সরকারকে পানি বিশুদ্ধ করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশ কোন ভূমিকা না রাখলেও বাংলাদেশের মতো কিছু ছোট দ্বীপ ও দেশকে এর ব্যাপক খেসারত দিতে হচ্ছে। সুতরাং দেশ রক্ষায় আমাদের নিজেদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় সরকার ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ গ্রহণ করেছে যেখানে এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তার সরকার ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রণয়ন এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিরাপদ ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এর বাস্তবায়নও শুরু করেছে।
শেখ হাসিনা নদীগুলো ড্রেজিং করে নাব্যতা বজায় রাখার পাশাপাশি অতিরিক্ত পানি বা বন্যার পানি সংরক্ষণের জন্য বাফার জোন তৈরির পরামর্শ দেন, যাতে করে ওই পানি শীতকালে চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের জানতে হবে কিভাবে বন্যার সঙ্গে বাঁচতে হয় এবং সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় (যেহেতু বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ)।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে নদীর পানি বিশুদ্ধ করে সেচ কাজে ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে জনগণকে নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সৃষ্টিতে কোন অবদান না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মতো কিছু ক্ষুদ্র দ্বীপ ও দেশকে এর প্রভাবের খেসারত বহন করতে হচ্ছে। তাই দেশকে বাঁচাতে আমাদের নিজেদেরই ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় তার সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে বলেন, তার সরকার এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেয়ায় ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নিরাপদ ও উন্নত জীবন দেয়ার লক্ষ্যে তারা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রণয়ন করেছেন এবং তা বাস্তবায়ন শুরু করেছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানীয় জল নিশ্চিত করে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি-৬ বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমরা সফলভাবে ৯৭ শতাংশ মানুষের জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করেছি এবং আমরা সকলের জন্য নিরাপদ পানীয় জল নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি উল্লেখ করেন যে, সারাবিশ্বে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন এবং ২ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশন এবং বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশের বিপুল পানিসম্পদ রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বিপুল পানি সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশবাসী কখনই নিরাপদ খাবার পানির সঙ্কটে পড়বে না। বরং বিশ্বে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে পারব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উন্নত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড’ এবং ‘ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। ফলোআপ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জাতীয় পানি নীতি, ১৯৯৯, বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ এবং নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের জন্য জাতীয় নীতি-১৯৯৮ প্রণয়ন করেছে।