রুশ হামলার মূল লক্ষ্যস্থল এখন কিয়েভ ॥ শহরটি দুই দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে

2

কাজিরবাজার ডেস্ক :
রণকৌশলে সামান্য পরিবর্তন এনেছে রাশিয়া। ফলে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দিকে ধেয়ে যাওয়া দীর্ঘ সাঁজোয়া বহরের গতি সামান্য শ্লথ করেছে পুতিন বাহিনী। ক্রেমলিনের টার্গেট প্রথমেই রাজধানী নয়, দেশটির আশপাশের পরিকাঠামো ধ্বংস করে ইউক্রেন সৈন্যদের মনোবল দুর্বল করে ফেলা। এরপর প্রধান টার্গেট কিয়েভে চূড়ান্ত হামলা পরিচালনা করা। যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের বিশ্লেষকেরা বুধবার এসব তথ্য জানান। তারা বলেন, কিয়েভ এখন মস্কোর মূল লক্ষ্যবস্তু। শহরটির পূর্ব ও পশ্চিম দিকে রুশ সৈন্যরা অগ্রসর হচ্ছে। বিশাল সাঁজোয়া বহর শহরটি ঘিরে ফেলছে। বহরটি কিয়েভের উত্তর দিকে অবস্থান করছে। আর পশ্চিম দিকে রাশিয়ার বিপুল স্থল সৈন্য রয়েছে। সাঁজোয়া বহর থেকে হামলার পর পশ্চিম দিকের সৈন্যরা তাদের সহায়তার এগিয়ে আসবে বলে ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন বলেছে, ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ রুশ সাঁজোয়া বহর বুধবার কিয়েভের মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। মঙ্গলবার রাতে ইউক্রেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী খারসনের নিয়ন্ত্রণ নেয় রুশরা। বুধবার ইউক্রেন যুদ্ধের সপ্তম দিন দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী খারকিভে রাশিয়ার শ’ শ’ ছত্রী সেনা নেমে আসে। তবে শহরটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ইউক্রেন সৈন্যরাও প্রাণপণ লড়াই করে।
বুধবারের হামলায় শহরটিতে অন্তত ২১ জন ইউক্রেনীয় নিহত হয়। ইউক্রেনে রুশ হামলা নিয়ে মঙ্গলবার স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার বক্তব্যে ভøাদিমির পুতিনকে নিয়ে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়াবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বাইডেন বলেন, পুতিন একজন স্বৈরশাসক। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা পাঠানোর জন্য তিনি এখন একঘরে। এই যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও ধ্বংসাত্মক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে, যা দেশটির অর্থনৈতিক শক্তি শুষে নেবে এবং সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে ফেলবে। ইউক্রেন হামলার নির্দেশ দেয়া পুতিনের সমালোচনায় বাইডেন আরও বলেন, রাশিয়ার একজন স্বৈরশাসক আরেকটি দেশে হামলা চালাচ্ছেন যার মূল্য দিতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকে। কিন্তু গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের লড়াইয়ে এ মুহূর্তে গণতন্ত্রেরই উত্থান ঘটছে এবং গোটা বিশ্ব স্পষ্টতই শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষ নিয়েছে। এদিকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, যদি একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তাহলে এতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হবে। এটি হবে ধ্বংসাত্মক। বুধবার তিনি এই মন্তব্য করেন। ল্যাভরভ বলেন, ইউক্রেন যদি পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করে তার পরিণতি ভাল হবে না।
মঙ্গলবারও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে। এটি একটি ‘সত্যিকারের বিপদ যার জন্য রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন দেশটির পারমাণবিক বাহিনীকে প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেয়ার পর পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বিশ্বে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।’
ইউক্রেনে হামলার ফলে রাশিয়ার ওপর কয়েকদফা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমারা। এ বিষয়ে মঙ্গলবার মস্কো সাফ বলে দিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কখনই রাশিয়াকে টলানো যাবে না। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, যেহেতু দুই দেশের মধ্যে এখন মুখোমুখি আলোচনা শুরু হয়েছে তাই উভয় দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে আপাতত বৈঠকের সম্ভাবনা নেই। ইউক্রেনে সাধারণ জনগণকে লক্ষ্য করে গুচ্ছবোমা ও ভ্যাকুয়াম বোমা নিক্ষেপের অভিযোগকে ডাহা মিথ্যা বলে খারিজ করেন পেসকভ।
গত সপ্তাহে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পশ্চিমারা রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংক ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাদের সম্পদ জব্দ করেছে।
ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ার বাহিনীকে অবশ্যই থামাতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে মঙ্গলবার টেলিফোন আলাপে তিনি এ কথা বলেন। এর পর টুইটার বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। এ সময় আমেরিকান নেতা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও ইউক্রেনকে প্রতিরক্ষা সহায়তা দেয়ার কথা বলেন।
হোয়াইট হাউস জানায়, দুই নেতা ৩০ মিনিট ধরে কথা বলেন। এ সময় তারা ববি ইয়ার হলোকাস্ট মেমোরিয়ালের কাছে অবস্থিত কিয়েভের প্রধান টেলিভিশন টাওয়ারে মঙ্গলবারের গোলাবর্ষণসহ বেসামরিক বিভিন্ন স্থাপনায় রাশিয়ার বিমান হামলা জোরদারের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নাৎসিরা ববি ইয়ার গিরিখাতে ৩০ হাজারেরও বেশি ইহুদীকে হত্যা করেছিল।
এ স্মৃতিসৌধের কাছে মঙ্গলবারের গোলাবর্ষণে পাঁচজন নিহত হয়। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা এটিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়ায় মস্কোকে দায়ী করেছে। রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার ষষ্ঠদিনে তারা এ ফোনালাপ করেন। হোয়াইট হাউস জানায়, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন চলমান নিরাপত্তা সহায়তা, আর্থিক ও মানবিক সাহায্য সরবরাহ করাসহ ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের টেকসই সহায়তার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন।’
শুক্রবার জরুরী বৈঠকে বসছে ন্যাটো : ন্যাটো জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ নিয়ে আলোচনার জন্য শুক্রবার ব্রাসেলসে জরুরী বেঠকে বসছেন। ন্যাটো জোটের এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে।
ইউক্রেন ন্যাটো জোটভুক্ত নয়। তাই ইউক্রেনে রুশ হামলার জবাবে সামরিক পদক্ষেপ না নেয়ার ব্যাপারে এখনও অটল ন্যাটো। এছাড়া রুশ বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ইউক্রেনের ওপর নো ফ্লাই জোন কার্যকরে কিয়েভের দাবিও প্রত্যাখ্যান করেছে ন্যাটো। ন্যাটো বলছে, এতে মস্কোর সঙ্গে সামরিক সংঘাত শুরুর আশঙ্কা রয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বিতীয় দফা বৈঠক : রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের বুধবার দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে বসার কথা। সোমবার প্রথমবার যেসব প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নেন তারাই ফের আলোচনা করতে যাচ্ছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের একজন উপদেষ্টা বলেন, ইউক্রেন ও দখলদারদের মধ্যে বুধবারই দ্বিতীয় দফা আলোচনা হবে। প্রতিনিধিরাও একই থাকবে। মঙ্গলবার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আরআইএ জানায়, দ্বিতীয় দফার আলোচনাও হবে পোলান্ড-বেলারুশ সীমান্তের কাছে। সোমবার প্রথম দফার বৈঠকটি ৫ ঘণ্টা স্থায়ী ছিল। কিন্তু ওই আলোচনা থেকে কোন সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি দুই পক্ষ।
বাড়ছে পুতিনের জনপ্রিয়তা : ইউক্রেনে পুরোমাত্রায় হামলা শুরু করায় একদিকে পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, অন্যদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমালোচনা করছে বিশ্ব। কিন্তু একটি জরিপে দাবি করা হয়েছে, গত সপ্তাহে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর রুশ প্রেসিডেন্টের প্রতি দেশটির নাগরিকদের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জরিপ পরিচালনা করেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত মতামত জরিপ ফাউন্ডেশন এফওএম।
ইউক্রেনে ১৩ শিশুসহ ১৩৬ জন নিহত : রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনে এ পর্যন্ত ১৩টি শিশুসহ অন্তত ১৩৬ জন নিহত হয়েছে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর দুই পক্ষের লড়াই বুধবার সপ্তম দিনে গড়িয়েছে। লড়াইয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার লিজ থ্রসেল বলেছেন, হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত আরও অনেক বেশি হবে। তিনি জানান, অধিকাংশ হতাহতের ঘটনাই কামানের গোলা, বিমান হামলা ও অন্যান্য বড় ধরনের বিস্ফোরণের কারণে হয়েছে।
তবে ইউক্রেনের সরকারের প্রকাশিত হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তাদের হিসাবে এ পর্যন্ত ৩৫২ জন বেসামরিক নিহত ও ১৬৮৪ জন আহত হয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে বোয়িং : বিশ্বের অন্যতম বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বোয়িং রাশিয়ার অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১ মার্চ) প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়ে জানায়, এটি মস্কোর সঙ্গে সব কার্যক্রম স্থগিত করবে। বোয়িংয়ের এই ঘোষণার ফলে মার্কিন বিমান নির্মাতাকারী প্রতিষ্ঠানটি রাশিয়ার বিমানের জন্য আর প্রযুক্তিগত সহায়তা বা রক্ষণাবেক্ষণ বা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করবে না। গত সোমবার কোম্পানিটি কিয়েভের কার্যালয় বন্ধ করে দেয় এবং মস্কোতে পাইলট ট্রেনিং কার্যক্রমও বন্ধ করে। প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র বলেছেন, বোয়িং ওই অঞ্চলে সতীর্থদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকে মনোনিবেশ করছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পরই পশ্চিমাদের একের পর নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে রাশিয়া। স্থানীয় সময় ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্য রাশিয়ার জাতীয় এয়ারলাইন্স এ্যারোফ্লোটের চলাচল নিষিদ্ধ করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি আরও দুটি ইউরোপীয় দেশ রাশিয়ার বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বলেছে, এটি বিমানের যন্ত্রাংশ রফতানির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা এঁটে দেবে। পোল্যান্ড এবং চেক রিপাবলিকও জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আনছে। জাপান এয়ারলাইন্সও ২৪ ফেব্রুয়ারি মস্কোর সঙ্গে তাদের ফ্লাইট বাতিল করেছে। এর আগে জার্মানির লুফথানসা এয়ারলাইন্স জানিয়েছে, তারা রাশিয়ায় তাদের বিমানের সব ফ্লাইট বাতিল করেছে।